মতিঝিলে গত ৫ মে দিবাগত রাতে শাপলা অভিযানে হেফাজতে ইসলামের নিহত ৬১ জনের নাম-পরিচয়সহ তালিকা দিতে সরকারকে তিনটি শর্ত দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার।
বুধবার তথ্যমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে অধিকার এই শর্তজুড়ে দিয়েছে। সংগঠনটির পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলান এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
এর আগে গত ১০ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অধিকার’র কাছে শাপলা চত্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের পরিচয়সহ প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন চাওয়া হয়।
এর জবাবে আজ অধিকার চিঠিতে বলেছে, অবশ্যই অধিকার এসব তথ্য দিতে সম্মত আছে। তবে ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তার আইন বাংলাদেশে না থাকায় সরকারকে তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর এগুলো নিশ্চিত করলে অধিকার সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলেও চিঠিতে বলা হয়েছে।
অধিকার’র শর্ত তিনটি বিষয় হলো;
১. নিহতদের তালিকা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেসব মানবাধিকার সংগঠন কাজ করছে তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা।
২. তথ্য প্রদানকারী, ভিকটিম/তাদের পরিবার এবং সাক্ষীদের জন্য সুরক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়া ও সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. এই তথ্য প্রদানকারী, ভিকটিম/তাদের পরিবার এবং সাক্ষীদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে না সেই ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকার এসব বিষয়ে নিশ্চিত করলে অধিকার অবশ্যই সেই কাঙ্ক্ষিত কমিশনের কাছে প্রাসঙ্গিক সমস্ত তথ্য সরবরাহ ও সহযোগিতা করবে। অধিকার তার তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টসহ নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সেই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের কাছে হস্তান্তর করবে।
এতে আরো বলা হয়েছে, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়তা বিধান ছাড়া নিহতদের নাম, ঠিকানাসহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরবরাহ করা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়তা বলে বিবেচিত হবে। মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে
অধিকার’রর পক্ষে এই দায় নেয়া সম্ভব নয়।
চিঠির শুরুতে অবশ্য অধিকার সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। ৬ মে রাতের অভিযানের পর তাদের ধারাবাহিক প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের কিছু বিষয় রেফারেন্সসহ ফের উল্লেখও করেছে।
গত ১০ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় অধিকার- কে পাঠানো চিঠিতে বলে, ‘হেফাজতের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তা আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ও ঘটনা জনগণের কাছে প্রকাশে সরকার আন্তরিক।’
এ বিষয়টিকে আশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে অধিকার বলেছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হবে যদি সরকার কোনো তালিকা করে থাকে এবং আমরা পরস্পরের সঙ্গে তালিকা মিলিয়ে দেখতে পারি। সরকার আন্তরিক হলে অধিকার সব রকম সহযোগিতা প্রদানে আগ্রহী।
‘তবে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, ৫ মে দিবাগত রাতে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। সে রাতে মানুষকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে এবং এখনো সেইসব প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়া অধিকার’র তথ্যানুসন্ধানেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।’
চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বলে আসছে যে, ৫ মে দিবাগত রাতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ, জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় নেতৃস্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৫ মে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর কোনো গুলিবর্ষণ করা হয়নি বরং হেফাজতের কর্মীরা লাল রঙ লাগিয়ে মৃতের অভিনয় করেছে। হেফাজতের কর্মীরা গায়ে লাল রঙ মেখে রাস্তায় শুয়ে ছিল। পরে পুলিশ আসলে তারা
ভয়ে দৌড়ে পালায়।’
সরকারের এই বক্তব্য তুলে ধরে অধিকার তথ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছে, ‘উল্লেখযোগ্য যে, সরকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও বিধিবিধানের মানদণ্ডে অপরাধী বলে অভিযুক্ত। তারপরেও সেই রাতে কিছুই ঘটেনি বা কোনো প্রাণহানি হয়নি দাবি করার মধ্যে দিয়ে এটাই সরকার প্রমাণ করছে যে, সরকার তাদের দায় অস্বীকার করতে চায় এবং এই ঘটনার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত করতে আগ্রহী নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে সরকারের এই আচরণ অত্যন্ত গুরুতর একটি বিষয়। যেখানে সরকার নিজেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত এবং কোনো প্রাণহানি হয়নি বলে বক্তব্য দিচ্ছে সেই পরিস্থিতিতে এই ঘটনা সম্পর্কে অনুসন্ধান ও নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জনগণকে জানানোর বিষয়ে সরকার আন্তরিক নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।’
এতে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও পরবর্তী দমনপীড়নের কারণে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। গত ৫ মের ঘটনায় অন্তত: ১,৩৩,৫০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে ২৩টি মামলা দায়ের করেছে সরকার। ভিকটিম পরিবারগুলোর আশঙ্কা তাদের পরিবারের সদস্যদের সরকার হয়রানি করতে পারে এবং এই কারণে তারা জনসমক্ষে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে ভিকটিমদের নিরাপত্তা বিধান আমাদের কর্তব্য। সুতরাং ভিকটিমদের পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে দায়িত্বশীল মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে অধিকার উপরোক্ত শর্তগুলোর নিশ্চয়তা পেলে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে রাজি আছে।
তবে অধিকার তথ্যমন্ত্রীকে তাদের প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের কপি সরবরাহ করেছে।