১
১৮৪৬ সালে মার্কস এবং এঙ্গেলস মিলে “The German Ideology” নামে একটা বইয়ের পান্ডুলিপি লিখেছিলেন। কিন্তু বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। এই বইতে তারা শুধু ভাববাদকেই না ফয়েরবাখের বস্তুবাদী দর্শনকেও চ্যালেন্জ করেছিলেন। যাইহোক এই বইয়ে তারা যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে,
১. দর্শন এবং চেতনা তা ভাববাদীই হোক বা বস্তুবাদী তা যদি প্রয়োগ করা না যায় এবং সে প্রয়োগ যদি পরিবর্তন না ঘটায় তবে সে দর্শন কিংবা চেতনার কোন মূল্য নেই। অর্থ্যাৎ ফল আসতে হবে।
২. মানুষকে বুঝতে হবে প্রকৃতি, সমাজ, তার কর্ম, তার স্বাধীনতা, পরাধীনতা এবং সবকিছুর সাথে তার যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান তার আলোকে। অর্থ্যাৎ একটা সমাজে মানুষ যেভাবে সক্রিয় থাকে তার আলোকে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত মানুষ হিসাবে মানুষকে বুঝলে তার কোন প্র্যাকটিক্যাল আউটকাম থাকবেনা।
৩. ব্যাখা করে কোন লাভ নাই যদি সে ব্যাখ্যার আলোকে পরিবর্তন না করা যায়।
যাইহোক ১৮৪৬ সালের লেখা। আজ ২০২০ সালে এসে মনে হচ্ছে এই যে প্রয়োগ আর রেজাল্ট অরিয়েন্টেড চিন্তা ভাবনা এবং কর্মের কথা মার্কস এবং এঙ্গেলস বলেছেন তা তাদের ফলোয়ার কম্যুনিস্টদের চাইতে বরং শত্রুপক্ষ ক্যাপিটালিস্টরাই বেশী মেনে চলেছে।
সারকথা হচ্ছে মগজে যতই উন্নত চেতনা, বিশ্বাস, ডগমা থাকুকনা কেন তা চর্চা করে পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে তা দিনশেষে অন্তঃসারশূন্য কিছু একটাটেই পরিনত হয়। এ দেশের বামরাও তেমন কিছু একটাতে পরিনত হয়েছেন।
২
জর্জীয় আগামবেন একজন ইতালীয় দার্শনিক এবং মনোঃসমীক্ষক। তার একটা লেখা নিয়ে দার্শনিক এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে। আগামবেন তার সে লেখায় যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হচ্ছে,
১ কতৃত্বপরায়ন সরকার “কভিড-১৯” কে উছিলা বানিয়ে মানুষকে আরো বেশী নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
২ মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে এবং
৩ মানুষের মাঝে সামাজিক দুরুত্ব চর্চার মাধ্যমে মানবিক বোধ কমে যাচ্ছে।
এই লেখার যৌক্তিক পাল্টা জবাব অনেকেই দিয়েছেন। এবং তারা বলতে চেয়েছেন এই মুহূর্তে সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখাটাই বরং মানবিক আচরণ এবং জরুরি অবস্থা জারি করার বিকল্পও নেই।
এই আলোচনা সমালোচনা থেকে একটা জিনিস আবারো স্পষ্ট যে যেকোন মতবাদ বা মডেল কেন্দ্রীক বিশ্লেষনের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সে সীমাবদ্ধতাটা তাত্ত্বিক ভাবে বুঝতে পারা না গেলেও প্রয়োগে খুব প্রকট হয়ে উঠে। যেমন একজন ক্যাপিটালিস্ট যদি মানুষকে ইতিহাসের আলোকে ব্যাখ্যা করে সে বলবে মানুষ স্বার্থপর এবং প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে সে টিকে থাকে। মার্কসবাদী বলবে সবটাই শ্রেণী সংগ্রাম। লিবারেল বাম বা অ্যানার্কিস্টরা বলবে পারষ্পরিক সহযোগীতার মধ্যে দিয়ে কমিউনিটি গড়ে তোলার কথা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এসব পর্যবেক্ষণের সবগুলোই সত্য। আর এই কারনেই যে কোন একটা পর্যবেক্ষণ থেকে মডেল বানিয়ে অ্যাপ্লাই করলে তা যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে আর কাজ করেনা।
যেমন আগামবেনের পর্যবেক্ষণ ঠিক আছে। কতৃত্বপরায়ণ সরকার যেকোন পরিস্থিতিতে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। তবে সেটা ভালোর জন্যও হতে পারে আবার খারাপ উদ্দেশ্যও হতে পারে। নির্ভর করে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কোনটা দরকার?
অন্যদিকে মাস পিপল তাদের জীবনের দায়িত্ব নিতে কতটা প্রস্তুত? নাকি তারা চায় রাষ্ট্র পরিচালকরা দায়িত্ব নিক? তারা প্রজা হতে চায় বলেইত কেউ রাজার ভূমিকায় আছে। এই প্রজা হতে চাওয়ার মধ্যেও একধরনের দায়িত্বকে এভয়েড করার মানসিকতা আছে।
হাইপোথিসিস আর প্রয়োগ ভিন্ন জিনিস। কারন মানুষের আবেগ এবং প্রবৃত্তি বহুমুখী। একমুখী নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনের অভিশাপও বলা যেতে পারে এটাকে।
৩
বিশ্বায়ন হয়েছে মূলত মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রয়োজনে। এবং বাজার অর্থনীতির ইঁদুর দৌড়ে কিছু রাষ্ট্র হয়েছে রাজা । কিছু রাষ্ট্র নিয়েছে দালালের ভূমিকা। কিছু রাষ্ট্র হয়েছে প্রজা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে পরনির্ভরশীল। এবং এ রাষ্ট্র যারাই পরিচালনা করতে এসেছে তাদের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার নামে বিপুল ক্ষমতা এবং অর্থ সম্পদ ব্যাক্তি এবং দলীয় স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে ফেলা। এবং এটা সম্ভব হয়েছে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকার কারনে। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করবে যে নাগরিকরা তারাই জবাবদিহিতা আদায়ের চাইতে দলীয় লেজুড়বৃত্তির চর্চা করে গেছে দীর্ঘ সময়। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালকরা পরিণত হয়েছে রাষ্ট্র মালিকে। এবং জনগণ পরিণত হয়েছে প্রজায়। গনতন্ত্রের নামে আমাদের দেশে এক প্রকার রাজতন্ত্রই চলেছে। রাজায় রাজায় এবং তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর লড়াই চলেছে। কোন চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নাই। জবাবদিহিতা নাই।
স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টাত নিয়তেই ছিলনা।
৪
এই মুহুর্তে করোনা ক্রাইসিস সামাল দেওয়ার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা সরকারের কাছে নেই। সুতরাং তাদের হাতে অপশন একটাই ছিল। তা হচ্ছে কইয়ের তেলে কই ভাজা। আর সেই ভাজার ফলাফল হচ্ছে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। ৯ শতাংশ হারে সুদ। ব্যাংকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিল্প খাতকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা। অনেকেই এই প্রণোদনা প্যাকেজের সমালোচনা করছে যার যার জায়গা থেকে। তবে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সবার উপর শিল্পপতিরা সত্য। তারা সারভাইভ করলে শ্রমিকদের সারভাইভ করার একটা সম্ভাবনা আছে। আর সরকারের স্বার্থত আছেই। আর যারা দূর্বল তাদের নিয়ে ভাবার অপশন এখন সরকারের নাই। ইচ্ছাও নাই। সে প্রেশারও খুব একটা আছে বলে মনে হয়না। তাছাড়া সুদের অর্ধেক তারা দেবে। অর্ধেক দেবে লোনগ্রহীতা। সরকারের জায়গা থেকে সরকার প্র্যাগমেটিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা প্রেশার ক্রিয়েট করতে পেরেছে এবং যাদের সারভাইভ না করলে বিপদ তাদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৪৭