প্রথম অংশ দ্বিতীয় অংশ তৃতীয় অংশ
৬)
ভুরুটা কুঁচকে প্রায় আট দশ সেকেন্ডের মতো অবন্তীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো তাশফিন হাসান। অবন্তীও ঠিক বুঝে উঠতো পারলো না যে তার নামটা শুনে হঠাৎ করেই এমন গম্ভীর হয়ে গেলো কেন তাশফিন। শেষে সাহস করে সে তাশফিনকে জিজ্ঞেসই করে বসলো, "স্যার কোন সমস্যা?"
কিছু একটা আসলেই চিন্তা করছিলো তাশফিন, হঠাৎ অবন্তীর প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত লাগলো তাকে, সে মুখাবয়বটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করেই বললো, "আসলে ঘটনাটা কি বুঝলেন অবন্তী, আপনার নামটা শোনার সাথে সাথেই কেন যেন মনে হলো--এই নামটা ইদানিংকালেই আমি যেন কোথাও শুনেছি, কিন্তু মনে করতে পারছি না, আমার আবার স্মৃতিশক্তির অবস্থা খুব একটা ভালো না, সকালে কোন কথা শুনলে বিকালেই তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কাজেই কোনভাবেই এখন মনে করতে পারছি না নামটা কোথাও এবং কিভাবে শুনেছি--কথাগুলো বলেই ছোট্ট একটা হাসি দিলো তাশফিন।
সব কথা শুনে অবন্তী বললো, "স্যার এমন হতেই পরে, একই নাম নিয়ে কত হাজারো মানুষ আমাদের চারিধারে ঘোরাফেরা করে, হবে হয়তো আপনার চেনা পরিচিত কেউ।"
তাশফিন বললো, "তা আপনি ঠিকই বলেছেন, সে যাই হোক, আপনি চলে যাচ্ছিলেন, শুধুই শুধুই আপনাকে এতক্ষণ আটকে রাখালাম, মাফ করবেন, আপনি আসতে পারেন এখন।"
"জ্বি স্যার" বলে তাশফিনের রুম থেকে বের হয়ে আসলো অবন্তী। দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায় আসি আসি করছে। সূর্য্যের তেজটাও অল্প করে অল্প কমতে শুরু করেছে। তাশফিনের চেম্বারটা কোম্পানীর জোনাল অফিসের যে দিকটায় অবস্থিত সেখান থেকে কোম্পানীর ৩নম্বর সেক্টরেরে দুটো চাবানের মাঝখান দিয়ে একটা লালচে মেঠো পথ সাপের মতো সরু হয়ে চলে গেছে অফিসের মূল ফটকটা পর্যন্ত। নিজের মন প্রাণ উজাড় করে দৃষ্ট শক্তির সমস্তটুকু ব্যয় করে চাবাগানের বৈকালিক প্রকৃতির অনন্ত রূপ লহমা আর নৈসর্গিক আবেদনের মাঝে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়ে বেশ ধীর পায়েই লালচে সেই মেঠো পথটা ধরে মূল ফটকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো অবন্তী। দুধারে বিকালের নরম আলোয় ক্লান্তির পরশ নিয়ে নিবিড় হয়ে থাকা চা গাছগুলোর অনন্ত সবুজের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবন্তীর মনে হচ্ছিলো হয়তো সে কোন স্বপ্নই দেখছে। প্রাণহীন , রংহীন ঢাকার শুন্যতা মনটাকে এমন ভাবে আষ্ঠে পৃষ্ঠে বন্দী করে ফেলে যে সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তির উপায়টাও যেন মানুষ এক সময় ভুলে যায়। অবন্তীও যেন তা ভুলতে বসেছিলো, তাই ঢাকা থেকে সহস্র মাইল দুরে অবস্থিত সিলেটের এই নির্জন চা বাগানের বিকালের লাজুক রূপসী প্রকৃতি আজ যখন তার সমস্ত রুপ সৌন্দর্য্য আর লাবণ্যতা নিয়ে অবন্তীর সামনে হাজির হলো, অবন্তীর মনে হলো--সে যেন হঠাৎ করেই তার চেনা জানা পৃথিবীটা ছেড়ে অন্য আরেকটা জগতে এসে উপস্থিত হয়েছে--যেখানে কোন কোলাহল নেই, কোন হট্টগোল নেই, যানবাহনের দানবীয় কোন ঝনঝনানিও নেই; এখানে আছে শুধু সবুজ, এখানের কোলাহলটা কেবলই প্রাকৃতিক, প্রকৃতি তার অথৈ রূপ আর রংয়ের অপার্থিব ছান্দসিক সুর দ্যোতনায় যে অদৃশ্য সংগীতের অবতারণা করে এখানে তার কলতানেই কেবল মুখরিত থাকে এখানকার সমস্ত পরিবেশ।
মুগ্ধতার সবগুলো দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে চা বাগানটা পার হয়ে এক সময় কোম্পানীর অফিস চত্বরের মূল ফটকটায় চলে এলো অবন্তী। সেখান থেকে কিছু দূরে মূল রাস্তার ধারে কয়েকটা রিকশা ঝট পাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। নিজের কোয়ার্টারে ফিরে যাবে বলে একটা রিকশা ডাকতে যাচ্ছিলো অবন্তী, হঠাৎ করেই পিছন থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে ডেকে উঠলো, ঘাড়টা ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো অবন্তী। সে যা ভেবছে তাই--তাশফিন হাসান, ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসেই তাশফিন ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো, "কি ব্যাপার? যান নি এখনো?"
অবন্তী লাজুক হাসি হেসে বললো, "না স্যার, এতো সুন্দর একটা জায়গা, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না, তাই একটু রয়ে সয়ে এগুচ্ছিলাম, ঢাকায় তো এতো সুন্দর কোন জায়গাই নেই, তাই মুগ্ধতার রেশ হয়তো এতো তাড়াতাড়ি কাটবে না।"
তাশফিন এবার কিছুটা শব্দ করেই হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে বললো, "প্রথম প্রথম আমারও এমন মনে হয়েছিলো বুঝলেন, ঢাকা থেকে সবে মাত্র এসে এই পরিবেশটা দেখে মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তখন, পরে পরে মুগ্ধতা কেটে যেতে আরম্ভ করলো, এখন তো এসবকেই আমার এক ঘেঁয়েমি লাগে।"
তাশফিনের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গেলো অবন্তী, সে বললো, "কি বলেন স্যার? এতো সুন্দর একটা পরিবশকে আপনার এক ঘঁয়ে লাগছে? আজব মানুষ তো আপনি"--কথাটা বলেই একটু লজ্জা পেলো অবন্তী।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাশফিন অবন্তীকে একটু সহজ করার জন্য বললো, "কিছুদিন থাকুন ম্যাডাম, তারপরেই বুঝবেন, কোন কিছুই মানুষের বেশীদিন সহ্য হয় না, মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী।"
অবন্তী কিছু বললো না, শুধু একটু মুচকি হাসলো। তাশফিন বললো, "আপনি তো নিশ্চয় কোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছেন, তাই না?"
অবন্তী হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
তাশফিন বললো, "যান তাহলে, আমিও আজ আসি, শরীরটা ভালো লাগছে না, কাল দেখা হবে, ভালো থাকবেন।"
কথাগুলো বলেই একটূ দূরে পার্ক করে রাখা "G" মডেলের সিলভার কালারের একটা "Corolla" র ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো তাশফিন। দূর থেকে দাঁড়িয়েই তা দেখলো অবন্তী। সে ভেবেছিলো চলে যাওয়ার আগে তার দিকে হয়তো আরেকবার তাকাবে তাশফিন। তাশফিন তাকায়নি, গাড়িটাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে একটানেই অতি দ্রুত চলে গেলো সে অবন্তীর দৃষ্টি সীমানার বাইরে। এই ধরনের ভাবনা হঠাৎ করেই কেন যে মনে আসলো--তা ভেবে নিজের মনে মনেই কিছুটা লজ্জা পেলো সে। শেষে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসে সন্ধ্যা হওয়ার ক্ষাণিক আগেই কোয়ার্টারে ফিরে গেলো অবন্তী।
(৭)
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অফিসে কিংবা চা বাগানে থাকা অবস্থায় সময়গুলো বেশ ভালোই কাটে অবন্তীর। দুপুরের খাওয়ার খেতে মাঝে মাঝে সে কোয়ার্টারে ফিরে যায়, মাঝে মাঝে আবার অফিসেই সেরে নেয়। চা বাগানের শ্রমিকগুলোর সাথেও বেশ ভালো একটা বোঝাপোড়া হয়ে গেছে তার। কেউ কেউ তো আবার অবন্তী ম্যাডাম বলতেই পাগল। তার এই তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে তাশফিন মাঝে মধ্যেই হেসে হেসে অবন্তীকে বলে, "আচ্ছা অবন্তী, ব্যাপারটা কি বলুন তো? আপনি এলেন যে মাত্র কয়েকদিন হলো, এরই মধ্যে আপনি কি যাদু করে ফেললেন যে চা বাগানের বেশীর ভাগ শ্রমিকের মুখেই কেবল আপনারই গুণগান।"
অবন্তী কিছুই বলে না, কেবলই হাসে। অবশ্য তাশফিনের সাথেও অবন্তীর পার্টনারশিপটা বেশ ভালোই জমেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে কোম্পানীর উইকলি রিভিউতে দেখা গেছে তাশফিন আর অবন্তীদের সেক্টরটাই সবচেয়ে ভালো করেছে। প্রতিদিন বিকালে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের মতো তাশফিন আর অবন্তী পুরো দিনের কর্মকান্ডের উপর একটা রিপোর্ট তৈরী করে। প্রথম দিকে কাজের ব্যাপারগুলো বুঝতে অবন্তী একটু কষ্ট হলেও পরে পরে তা একদমই কেটে যায়, তাশফিনও তাকে যথেষ্টই সহযোগিতা করেছে এই ব্যাপারে। এখন অবন্তীর কাজ কর্মে তাশফিনও বেজায় খুশি। তাশফিন আর অবন্তী দু' দুজনের সঙ্গটাও বেশ উপভোগ করে। ঢাকা থেকে চলে আসার পর এমনিতেই খুব বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলো অবন্তী। তার উপর অফিস থেকে কোয়ার্টারে ফিরে এসে রাতের বেলা আর তেমন কিছুই করার থাকতো না তার। টিভি দেখে আর কতক্ষণই বা কাটানো যায়--নিজের এই কথাগুলোই যখন একদিন অবন্তী বলছিলো তাশফিনকে, সঙ্গে সঙ্গেই তাশফিন বলে বসলো, আপনি আমায় ফোন দিলেই তো পারেন, আমিও তো বেশ একাই থাকি, রাতের বেলাটা আমার জন্যও খুব বোরিং একটা সময়, সিলেট শহরটা রাত হলেই কেমন যেন ঘুমন্ত নগরীতে পরিণত হয়ে যায়, কিছুই তেমন ভালো লাগে না, আপনি ফোন দিলে আমার ভালোই লাগবে--কথাগুলো বলেই কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলো তাশফিন। কথাগুলো আদৌ অবন্তীকে বলা ঠিক হলো কিনা তাই নিয়ে যখন তার ভেতরেরটা তোলপাড় করছে, তখনই অবন্তী বললো, "হুম! তা অবশ্য খারাপ বলেন নি, ফোন করাই যায়, কিন্তু ব্যাপারটা একটু কেমন দেখায় না?"
তাশফিন বললো, "দুজন মানুষ যদি নিজেদের ইচ্ছাতেই একে অপরের সঙ্গ কামনা করে তাতে তো আমি দোষের কিছু দেখি না।"
তাশফিনের কথা শুনে অবন্তী সেদিন আর বিষয়টা নিয়ে তেমন কিছু বলে নি। তবে গত কয়েকদিন ধরেই তাশফিনের সাথে অবন্তীর ফোনে কথা হচ্ছে, শুরুটা তাশফিনই করেছে, এখনও অবন্তীও মাঝে মধ্যে ফোন দেয়। চা বাগানের নিঝুম পরিবেশে শত ব্যস্ততার মাঝেও এই দুটি মানব হৃদয় যে নিজেদের অজান্তেই একে অপরের আরো কাছাকাছি চলে আসছিলো-- তা বলাই বাহুল্য।
...............................................................................(চলবে)