অনেক অনেক দিন আগের কথা। এই ধরার কোন একপ্রান্তে ছিল একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম সূবর্ণপুর। সেই গ্রামে বাস করতেন এক ঋষি দিনমনি ও তার স্নিগ্ধ মায়াময়ী স্ত্রী চন্দ্রাবতী। তাদের ছিল এক কন্যা। কন্যার নাম ছিল বিভাবরি। অনিন্দ্য রূপসী বিভাবরি অহর্নিশি সরস্বতী বন্দনায় ব্রতি থাকতেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিলেন। সকল রাগ-রাগিনীর শুদ্ধতা তাকে ঘিরে থাকবে আজীবন। সহজ সরল বিভার অবয়ব থেকে যেন বিচ্ছুরিত হত সেই শুদ্ধতার দ্যূতি, যা ওর সৌন্দর্যকে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছিল। গ্রহে উপগ্রহে ছড়িয়ে পড়েছিল তার খ্যাতি।
ওদিকে দেবতাধামে স্বমগ্ন নামে এক দেবতা এক ভীষনই কঠিন যজ্ঞে দেবতাকূলাধিপতি ব্রহ্মাকে প্রীত করলেন। সন্তূষ্ট দেবরাজ তাকে দুইটি ইচ্ছাপূরন বর দিলেন। তার বহুদিনের সখ মিটিয়ে তাকে মর্তে ঘুরে বেড়াবার অনুমতিও দিলেন। ইচ্ছাপূরন বর পেয়ে স্বমগ্নের খুশীতো আর ধরে না। তার যেকোন দুইটি ইচ্ছা ব্রহ্মা নিজে পূরন করবেন। সে চাইলেই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব সম্পদ করায়ত্ব করতে পারে, চাইলেই হতে পারে সবচেয়ে সুদর্শন, চাইলেই পেতে পারে সবচেয়ে সুন্দরী দেবী বা রমনীদের সহচর্য! কিন্তু বুদ্ধিমান স্বমগ্ন জানে তাড়াহুড়ো করে বর চাইলে হয়ত ভুল জিনিষ চেয়ে ফেলবে—তাই সে ব্রহ্মার কাছ থেকে সময় নিয়ে মর্তে চলে আসল। কি পেলে তার সবচেয়ে লাভ, কি পেলে তার সবচেয়ে সুখ? সূবর্ণপুরের কাছে মুদ্রাপাঠি নামে এক জ্ঞান সরোবরের পাশে বসে এই নিয়ে ভাবতে লাগল সে আত্মমগ্ন হয়ে।
বিভাবরি সেদিন গোধূলী লগ্নে তার বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সেই সরোবরের তীরে বনভোজন করতে গিয়েছিল। হাস্যোজ্জল বিভার হাসির কলতানে স্বমগ্নের যেন ধ্যান ভাঙল। তিনি অবাক দেখলেন এক অনিন্দ্য সুন্দরী দ্যূতিময়ী কন্যা সংগীতে, গল্পে তার বন্ধুদের মাতিয়ে রাখছে—তার উপস্থিতি যেন চারপাশকে উজ্জ্বল করে তুলছে। স্বমগ্ন ভাবলেন এই কন্যাই তার উপযুক্তা—তার সহধর্মিনী হবার জন্য যথোপযুক্ত গুন-সম্পন্না। এত জনপ্রিয় যে, তার সঙ্গই তো চিরদিনের জন্য কাম্য। স্বমগ্ন বিভাকে নিয়ে সুখ-স্বপ্ন দেখলেন।
পরদিন প্রাতে শুভক্ষনে বিভার কাছে প্রেম নিবেদন করলেন স্বমগ্ন—তাকে জানালেন প্রনয় থেকে পরিনয়ের ইচ্ছা। বিভাকে দিলেন স্বর্গের সংগ্রহশালা থেকে খুঁজে এনে একটি পদ্য, যার ছত্রে ছত্রে ভালবাসার গভীরতার বয়ান—
কেবলই তোমার স্তবে নয়, শুধু সঙ্গীতরবে নয়,
শুধু নির্জনে ধ্যানের আসনে নহে—তব সংসার যেথা জাগ্রত রহে,
কর্মে সেথায় তোমারে স্বীকার করিব হে।
প্রিয়ে অপ্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
জানি না বলিয়া তোমারে স্বীকার করিব হে।
জানি বলে নাথ তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
শুধু জীবনের সুখে নয়, শুধু প্রফুল্লমুখে নয়,
শুধু সুদিনের সহজ সুযোগে নহে—দুখশোক যেথা আধাঁর করিয়া রহে
নত হয়ে সেথা তোমারে স্বীকার করিব হে।
নয়নের জলে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
ব্যাজোক্তিতে পারদর্শী স্বমগ্ন জানতেন বিভা সাধারন মেয়ে নয়। শুধু স্তুতিতে তার মন গলবে না। তাই অনেক ভেবে এই পদ্য, যাতে সর্ব কর্মে, সুখে দুখে, সর্বস্ব বিলিয়ে দেবার কথা আছে, তাই তাকে দিলেন। ক্ষমা চাইলেন তার অক্ষমতার জন্য, ভালবাসার গভীরতা না বুঝাতে পারার অপরাগতার জন্য--স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল—ত্রিলোকে কোথাও কোন ভাষা বা মাধ্যম নেই যা বিভার প্রতি তার অভিব্যক্তির সঠিক প্রকাশ করতে পারে, তার অনুভূতির ব্যাপ্তি কিম্বা ব্যাষ্টিকে ধারণ করতে পারে।
সব শুনে বিভা কিছুটা বিহবল হয়ে পরল। সরলতা বিভার সহজাত। এক দেবতা তার পাণিপ্রার্থী, এইটেই তাকে হতবাক করে দিল ক্ষনিকের তরে! বিভা কি বলবে খুঁজে না পেয়ে বললে, “আমি অতি নগন্য মানবী আর আপনি দেবতা, আপনি অমর আর আমার ক্ষয় আর মৃত্যু অবধারিত—এই মিলনের শেষ পরিনতি বেদনায়। আমি এতে কি করে সম্মতি দেই?”
স্বমগ্ন উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। বললেন, “বিভা আমি স্বমগ্ন, আমি দেবতা। আমি তোমাকে ভালবেসেছি। এই সমস্যা অতি নস্যি, এ আমাদের মিলনের অন্তরায় হতে পারে না।“
স্বমগ্ন ভাবলেন অনন্ত কালের জন্য সুশীলা সুযোগ্য পত্নী পেতে একটি ইচ্ছাপূরন বর ব্যবহার করাই যায়। তিনি চোখ বন্ধ করে প্রার্থনায় রত হলেন, তীব্র আকূলতায় ব্রহ্মার স্মরনাপন্ন হলেন, প্রার্থনা করলেন বিভার অমরত্ব। ব্রহ্মা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।
বিভা আর স্বমগ্ন সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলেন। কিন্তু বিবাহের দুই দশক পরে বিভা পৌঢ়ত্বে উপনীত হলে তার সৌন্দর্যে ভাটা পরে এল। স্বমগ্ন লোভের আতিশ্চর্যে বিভার চিরযৌবন প্রার্থনা করেননি, শুধু অমরত্ব চেয়েছিলেন। এখন তিনি যেন এক মহা বিপদে পড়লেন। যত কাল ক্ষয় হচ্ছিল, বিভার প্রতি আকর্ষন হ্রাস পেতে লাগল, তার বিতৃষ্ণার মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। তিনি হতাশার সাথে বুঝতে পেরেছিলেন এই জরাগ্রস্থ, জীর্ণা, কুরূপা পত্নী নিয়ে তাকে অনন্তকাল থাকতে হবে, কারন বিভা অমর। অগ্নি সাক্ষী রেখে পরিণিতা পত্নী অপরিত্যাজ্য। তিনি অনেক ভেবে একদিন রাতে সবাই যখন নিদ্রামগ্ন, তখন মাটি খুঁড়ে বিভাকে পুতে দিলেন। তারপর পালালেন সূবর্ণপুর থেকে।
জীবন্ত বিভা মাটির নীচে পিষ্ট হয়ে অবর্ননীয় কষ্টে, বেদনায় নিজের মৃত্যু কামনা করলেন দিন রাত। ব্রহ্মার আসন নড়ে উঠল সেই আহাজারীতে। তিনি প্রতিকার করলেন দ্রুত। তিনি তার প্রতিশ্রুত বর সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্জন করলেন না। তিনি বিভার দেহকে একটি বৃক্ষে আর তার অন্তঃকরনকে আকাশের তারায় রূপান্তর করলেন। তাকে চির অমরত্বের সাথে চির যৌবন দান করে তার দূর্বিষহ কষ্টের পরিত্রান করলেন। পূর্বাকাশে প্রতি সন্ধ্যায় ইমনের সুরে সরস্বতি-অনুরক্তা বিভা হাসে, খুব ভোরে ভৈরবীর সুরে গুনগুনিয়ে গান গায়!
আর যে বৃক্ষটি মাটি ফুড়ে মহীরূহের রূপ নিল, তার প্রতিটি পত্রপল্লবের রস মৃতসঞ্জিবনী সুধাবৎ। বিভা যেন তার অমরত্ত্ব সেই বৃক্ষের প্রতি অনু-পরমানুতে বিলিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুপ্রায় সৎ যেকোন মানব সেই সুধা পান করে নব জীবন ফিরে পান, দূরারোগ্য রোগ সেরে যায় এক নিমিষেই। কিন্তু সকলে সেই পল্লবের দেখা পান না। শুধুমাত্র পবিত্র অন্তরের মানুষ সেই বৃক্ষের নীচে প্রার্থনা করলে গাছ থেকে একটি পাতা তার কোলে খসে পড়ে। সেই বৃক্ষটিতে কেঊ বাইতে পারে না, এত দীর্ঘ তার কান্ড, কেউ তার পাতা দেখতে পায় না, এতটাই সুউচ্চ সেটি!
এদিকে স্বমগ্নের সূবর্ণপুর থেকে পলায়নের পরবর্তী ঘটনা আরো চমকপ্রদ। তিনি উত্তরায়ন নামক একটি নুতন গ্রামের কাছে পৌছেন সেই রাত্রে। একটি সরোবরের ধারে বিশ্রামের জন্য একটি ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নেন। বিভার ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল সে কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন প্রত্যুষে এক রমনীর হাসির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। কৌতুহলী স্বমগ্ন দেখেন যে এক কামার্তা, গুঢ় শ্রোণী ও পয়োধরা তরুনী সরোবরে নাইতে এসেছে, যে নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ, আত্মপ্রসাদের হাসি হাসছে জলকেলি করতে করতে। স্বমগ্ন যেন প্রথম দেখাতেই এই উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলেন।
তিনি এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলেন। ব্রীড়াবনত মেয়েটি তার নাম জানালে --অম্বুকুক্কুটিকা। সেও দেবতা স্বমগ্নকে দেখে মুগ্ধ। দেবতাকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার লোভ তার মনকে আচ্ছন্ন করে তুলল। উভয়ের মনের স্থিতি যেন সম্যক সমবস্থ। তারা মিলনের আগ্রহে অধীর হয়ে উঠলেন। স্বমগ্ন আবারো প্রার্থনায় রত হলেন। এই বার তিনি আর ভুল করলেন না। জরা বার্ধক্য অসুন্দর তার খুবই অপছন্দ। তাই অম্বুকুক্কুটিকার চিরযৌবন ভিক্ষা চাইলেন ব্রহ্মার কাছে।
ব্রহ্মা স্বমগ্নের উপর বেশ বিরক্ত ছিলেন। তিনি জানালেন এই বর গ্রাহ্য হবার পর স্বমগ্ন আর কোনদিন কোন অনুগ্রহ পাবেন না, এরপর অন্য কোন নারীর কাম বা প্রেম কোনটাই আর পাবেন না। স্বমগ্ন তখন ভাবলেন উর্বশী তন্বী চিরযৌবনা স্ত্রী তার, আর কিছুই তার নেই প্রয়োজন।
স্বমগ্ন আর অম্বুকুক্কুটিকা সুখে সংসার করতে লাগলেন। বছর ঘুরতেই অম্বুকুক্কুটিকা সন্তানসম্ভবা হলেন। স্বমগ্ন আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু প্রসবের সময়ে অম্বুকুক্কুটিকার জীবন সংশয় দেখা দিল। স্বমগ্ন উন্মাদ প্রায় হয়ে গেলেন। তিনি অম্বুকুক্কুটিকার চির যৌবন চেয়েছিলেন কিন্তু অমরত্ব চাননি। তিনি দিশেহারা হয়ে গেলেন তার ভবিষ্যত একাকীত্বের কথা ভেবে। যে দাই প্রসবে সাহায্য করছিলেন, তিনি স্বমগ্নকে জানালেন সূবর্ণপুরের মৃত সঞ্জীবনী বৃক্ষের কথা।
স্বমগ্ন এক পল কালক্ষয় না করে তার মৃতাপ্রায় স্ত্রী, নবজাতক ছেলেকে নিয়ে সূবর্ণপুর গেলেন। বৃক্ষের নীচে বসে আকূল প্রার্থনা করলেন কিন্তু একটি পাতাও ঝরে পড়ল না। স্বমগ্ন বুঝতে পেরেছিলেন বৃক্ষের প্রানশক্তি আসলে বিভা কারণ ঠিক একই স্থানে তিনি বিভাকে জীবন্ত গোর দিয়েছিলেন। বিভা তাকে ক্ষমা করবেন না তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ভগ্নমন নিয়ে তিনি বসে বসে কাদঁছিলেন স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে।
তার নবজাতক পুত্র ক্ষুধার তাড়নায় তাড়স্বরে কেঁদে উঠল—সেদিকেও স্বমগ্নের কোন ধ্যান নেই। কাঁদতে কাঁদতে দুধের শিশুটিরও জীবন সংশয় দেখা দিল। তখন হঠাৎ কোথা থেকে প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল। আর শত শত কচি সবুজ পাতা ঝরে পরতে লাগল। শিশুটি হাত বাড়িয়ে সেই পাতা মুখে দিল, তৎক্ষনাত নুতন জীবন ফিরে পেয়ে হাত পা নেড়ে খেলতে লাগল। স্বমগ্ন দ্রুত অম্বুকুক্কুটিকাকে পাতার রস খাওয়ালেন। জীবন ফিরে পেলে সেও। স্বমগ্ন বুঝতে পারলেন তাকে এই বৃক্ষের আশ্রয়েই বাকী জীবন কাটাতে হবে তার-- কারন অম্বুকুক্কুটিকা মরনশীল, একমাত্র এই বৃক্ষের অনুগ্রহে এই পাতার রসেই তার প্রানরক্ষা হবে।
সেই সময় থেকেই আজ অবধি স্বমগ্ন ও তার পরিবার সেই বৃক্ষের নীচে বাসা বেঁধে আছে, তাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় বৃক্ষের গোড়ায় জল দিয়ে, তার যত্ন করে।
“Men are not punished for their sins, but by them.”
------
অম্বুকুক্কুটিকাঃ মৎস্য শিকারী পাখি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৫৫