এখানে একটি কথা বলে রাখি, আমি ঘরকুনো স্বভাবের ছিলাম বরাবরই। বাড়ির বাইরে আত্নীয় স্বজনের বাসা ছাড়া এই প্রথম আমার থাকা। কী যে এক রোমঞ্চকর অনুভূতি, তা বোঝাতে পারছি না। মনে হয়েছিল আমি বড় হয়ে যাচ্ছি।
তো সূর্যসেন হল থেকে বের হয়ে রাত প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধু হলে। সোজা গিয়ে উঠলাম ১০৪ নম্বর রুমে, যেখানে আমার বন্ধুটি থাকে। দেখি আরো কয়েকজন আছে ওখানে। সবাই স্বাগত জানাল আমাকে। সব কিছু দেখেশুনে মনে মনে হিসেব করে দেখলাম যে রুমের চার্টি সিটের মোট আটজন থাকতে হবে। আমার নাকি ভাগ্য ভাল ছিল যে, ঐ দিন রুমের আরো দু’/তিন জন আজ নেই, তা না হলে ফ্লোরিং (মেঝেতে বিছানা) করতে হত। কী সৌভাগ্যবান আমি! প্রথম রাতেই বেড-এ থাকতে পারছি।
রাত দশটায় রুমমেটরা বলল গেষ্টরুম করতে হবে। আমি না বুঝেই ওদের সাথে রওনা দিলাম। পরে জানলাম হলে থাকতে হলে কোনো ভাইয়ের আন্ডারে পলিটিক্স জয়েন করতে হয়। তো ঐ ভাইয়াদের সাথে প্রতি রাতে মিটিং করতে হয় হলের গেষ্টরুমে। ওখানে গিয়ে দেখি বিশাল কারবার! আমার মত অনেক ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রকে সামনে দাড় করিয়ে রেখে ভাইয়ারা বসে আছেন। কী যেন সলাপরামর্শ করলেন অনেক্ষণ...।
তারপর হঠাৎ সব ফার্ষ্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের সামনে নিজেদের পরিচয় দিলেন তারা (এখন মনে নেই)। তারপর সব ছাত্র একে একে সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের নাম, ডিপার্টমেন্টের নাম এবং হোম ডিস্ট্রিক্ট এর নাম বলতে লাগল। আমিও সবার সাথে তাল মিলিয়ে সামনে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বললাম রাতুল, এম. আই. এস, হোম ডিস্ট্রিক্ট – চিটাগং।
সবার পরিচয়ের পালা শেষ করে হলে এক ভাইয়া বলতে লাগলেন যে আমাদের হলে বাথরুমের, এবং বেসিনের কিছু সমস্যা আছে। এসব সমস্যা আমাদের হল প্রভোষ্টকে জানানো দরকার। আমিও মনে মনে সায় দিলাম ব্যাপারটায়। যদিও আমি এখনো বাথরুম বা বেসিনের দিকে যাইনি। হঠাৎ তারা সবাই জড়ো হয়ে একটি মিছিল বের করলেন। শ্লোগান টা আমার হুবহু মনে নেই, তবে এই সমস্যাগুলোর প্রতিকারের দাবী জানিয়ে। আমি তখন রোমাঞ্চের চরম অবস্থায়। রাত ১১ টায় মিছিলে বের হয়েছি আমি!
তো মিছিলটি হলের নিচতলা, দোতলা প্রদক্ষিণ করতে লাগলো। আমিও জোরে জোরে শ্লোগান দিতে লাগলাম। যে ছেলে জীবনে প্রথমবারের মত বাবা-মা’কে ছেড়ে নতুন কোনো স্থানে রাত্রে থাকছে,সে কিনা প্রথম রাতেই এই তারুণ্যদীপ্ত মিছিলের সক্রিয় কর্মী!
মিছিলটির শেষের দিকে শ্লোগানটি কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগলো, “হল প্রভোষ্টের পদত্যাগ চাই” জাতীয়। আমি কেন জানি ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। সমস্যার তো সমাধান করা যায়, তাই বলে সরাসরি পদত্যাগ !!?? কী আর করা। মিছিল চলতে চলতে এক সময় হলগেটে এসে থামলো। ভাইয়ারা একেকজন ছোট খাট ভাষণ দিতে লাগলো যে হল প্রভোষ্টের পদত্যাগ ছাড়া কোন সমাধান হবে না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, ভাইয়াদের বলি শুধু শুধু পদত্যাগ-এর কী দরকার। পরে বুঝতে পারলাম যে “রাজনীতির ভেতর পলিটিক্স ঢুকে গেছে”। চুপ থাকাই শ্রেয়।
সব কিছু শেষ করে করে প্রায় সাড়ে এগারটায় গেলাম রুমে। সবার সাথে আড্ডা দিলাম। যদিও আমি একেবারে হলে উঠার প্ল্যান করে এসেছি, কিন্তু কাপড়-চোপড় কিছুই আনিনি। এই অবস্থায় ওখানকার নতুন বন্ধুরা তাদের বালিশ, কম্বল (শীতের রাত) শেয়ার করতে রাজী হল। এর মধ্যে আব্বুর ফোন চলে এসেছে। কেমন আছি, কী করছি, খেয়েছি কী না জানতে। সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম আব্বু’র মন আমার জন্য কাঁদছে।
বান্ধবীকে জানালাম এস.এম.এস করে যে আমি হলে থাকছি। বরাবরই আমি ঘুমকাতুরে ছিলাম, সর্বোচ্চ সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতাম। আব্বু-আম্মু’র ভয়ে বান্ধবীর সাথে কথা বলতাম না রাতে। এনিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ছিল। সে আমাকে মোটামুটি পছন্দ করতো এবং রাতে কথা বলতে চাইত, যা আগে কখনো হয়ে উঠে নি। সে রাতে তো আর বাধা নেই; কিছুক্ষন পরই ফোন দিল, আর শুরু হল কথা। কথা... আর কথা...। জীবনের সব কথা যেন উগরে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার। রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম কথা। কখনো হাটছি, কখনো দাঁড়িয়ে আছি, কখনো বসে আছি, কখনো সিড়িতে, কখনো রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো গেষ্টরুমের ভিতর সোফায় গা এলিয়ে। ভাল লাগা, না লাগা, সুখ-দুঃখ সব শেয়ার করতে থাকলাম। এরই মধ্যে মিছিলের লীডার এক ভাইয়া এসে গেষ্টরুমে দেখলেন আমাকে ফোনে কথা বলছি। বলেই ফেললেন যে,যাও ঘুমাও গিয়ে, শরীর খারাপ করবে রাত জাগলে। মনে মনে হয়তো ভাবলে, “বেয়াদব ছেলে, প্রথম রাতেই এত কান্ড !” তো এদিকে আমাদের কথা থামতেই চায় না। কথা বলতে বলতে যখন রুমের বারান্দায় যেতাম, রুমের বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতে লাগলো। আমার কোনো দিকে খেয়াল নেই। রাত প্রায় দু’টার দিকে কথা থামালাম। ঘুমুতে হবে এখন। সবাই আমাকে বলছিল কী ব্যাপার, “এত গভীর প্রেম !” হা হা..
তো জীবনের প্রথম ডাবলিং, তাও আমি বিছানার বাইরের পাশে। ভয় হতে লাগলো যদি ঘুমের মধ্যে বিছানা থেকে পড়ে যাই! লাইট অফ করে ঘুমুতে গেলাম প্রায় আড়াইটায়। শুয়ে শুয়ে এক জন আরেক জনকে পচানোর চেষ্টায় বিভোর। যেই আমি কিনা রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে পড়ি, আজ বাজলো আড়াইটা! খুব ঘুম পাচ্ছিল...... অবশেষে ঘুমোলাম। কখন ঘুমোলাম টের পাইনি। সারারাতে ঘুম হলো তিন-চার ঘন্টা। ঘুম থেকে অনেক কষ্টে উঠলাম ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ শেষ করে দেখি আমি চোখে কিছু দেখছিনা যেন। আরে ভাই ঠিকমতো দাড়াতেই পারছিলাম না। মাথাটা প্রচন্ডভাবে ঘুরছে, অনেক খারাপ লাগছিল। রাত জেগে প্রথমবারের মত কথা বলার পরিণাম! প্রচন্ড দূর্বল ও অসুস্থবোধ করতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল বাবা-মা’র কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। এই ভোরেই রওনা (পালিয়ে গেলাম বলা যায়) দিলাম। না বাবা, আমার হলে উঠে কাজ নেই। আমি যা আছি, যেভাবে আছি, তাই ভালো,
“নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা”
বাসায় এসে বললাম আমি হলে থাকবোনা। বাসায় থেকেই পড়ালেখা করবো। আব্বু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন...
(অনেকে হয়ত ভেবে বসবেন যে আমি হল এর অসুবিধার কথা একরোখা ভাবে বলেছি, কিন্তু আসলে তা না। ঐ রাতে সৃষ্টি হওয়া আমার নিজের সমস্যা লিখেছি মাত্র। এরপর অবশ্য অনেক রাত থেকেছি হলে, কিন্তু পার্মানেন্টলি না।)
ফেসবুকে আমার নোটেও প্রকাশিত
বিঃ দ্রঃ আমার এই অনুভূতিগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। কাউকে হেয় করার জন্য নয়, হয়ে থাকলে আমি খুবই দুঃখিত। তবে অযাচিত কমেন্টস মুছে দেয়া হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




