somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’র হলে আমার কাটানো প্রথম রাত

২৭ শে নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০৯ সালের শুরুর দিকের কথা (ফেব্রুয়ারী বা মার্চ), সঠিক তারিখ টা মনে নেই। আমি তখন সদ্য চান্সপ্রাপ্ত ঢাবি’র ছাত্র। অনেক আশা হলবাসী হবার। জানুয়ারি ১০ তারিখে ক্লাস শুরু হবার পর থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম হলে চলে আসার। এরই ধারাবাহিকতায় আমার জন্য সংযুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের এক বন্ধুকে অনুরোধ করলাম হলে উঠার ব্যাপারে। যদিও প্রথম বর্ষেই হলে উঠা অনেক ঝামেলার ব্যাপার বলে জানতাম। ও বল্‌ল যে কোন ব্যাপার না, আজই উঠে পর (সেও ছিল আমার মত প্রথম বর্ষের ছাত্র)। ও হ্যা, দিনটি ছিল কোন এক বৃহষ্পতিবার। ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসলাম (সাভার)। বাসায় এসে বললাম যে আমি আজ থেকে হলে থাকব। আব্বু-আম্মু আমার উপর খুব রাগ করলেন। অনেক মানা করলেন। আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা! বিকেলের দিকে সাভার থেকে রওনা দিলাম ক্যাম্পাসে। পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করে গেলাম সূর্যসেন হলে বন্ধু’র সাথে দেখা করতে। একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম ওখানে।


এখানে একটি কথা বলে রাখি, আমি ঘরকুনো স্বভাবের ছিলাম বরাবরই। বাড়ির বাইরে আত্নীয় স্বজনের বাসা ছাড়া এই প্রথম আমার থাকা। কী যে এক রোমঞ্চকর অনুভূতি, তা বোঝাতে পারছি না। মনে হয়েছিল আমি বড় হয়ে যাচ্ছি।


তো সূর্যসেন হল থেকে বের হয়ে রাত প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধু হলে। সোজা গিয়ে উঠলাম ১০৪ নম্বর রুমে, যেখানে আমার বন্ধুটি থাকে। দেখি আরো কয়েকজন আছে ওখানে। সবাই স্বাগত জানাল আমাকে। সব কিছু দেখেশুনে মনে মনে হিসেব করে দেখলাম যে রুমের চার্‌টি সিটের মোট আটজন থাকতে হবে। আমার নাকি ভাগ্য ভাল ছিল যে, ঐ দিন রুমের আরো দু’/তিন জন আজ নেই, তা না হলে ফ্লোরিং (মেঝেতে বিছানা) করতে হত। কী সৌভাগ্যবান আমি! প্রথম রাতেই বেড-এ থাকতে পারছি।


রাত দশটায় রুমমেটরা বলল গেষ্টরুম করতে হবে। আমি না বুঝেই ওদের সাথে রওনা দিলাম। পরে জানলাম হলে থাকতে হলে কোনো ভাইয়ের আন্ডারে পলিটিক্স জয়েন করতে হয়। তো ঐ ভাইয়াদের সাথে প্রতি রাতে মিটিং করতে হয় হলের গেষ্টরুমে। ওখানে গিয়ে দেখি বিশাল কারবার! আমার মত অনেক ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রকে সামনে দাড় করিয়ে রেখে ভাইয়ারা বসে আছেন। কী যেন সলাপরামর্শ করলেন অনেক্ষণ...।
তারপর হঠাৎ সব ফার্ষ্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের সামনে নিজেদের পরিচয় দিলেন তারা (এখন মনে নেই)। তারপর সব ছাত্র একে একে সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের নাম, ডিপার্টমেন্টের নাম এবং হোম ডিস্ট্রিক্ট এর নাম বলতে লাগল। আমিও সবার সাথে তাল মিলিয়ে সামনে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বললাম রাতুল, এম. আই. এস, হোম ডিস্ট্রিক্ট – চিটাগং।
সবার পরিচয়ের পালা শেষ করে হলে এক ভাইয়া বলতে লাগলেন যে আমাদের হলে বাথরুমের, এবং বেসিনের কিছু সমস্যা আছে। এসব সমস্যা আমাদের হল প্রভোষ্টকে জানানো দরকার। আমিও মনে মনে সায় দিলাম ব্যাপারটায়। যদিও আমি এখনো বাথরুম বা বেসিনের দিকে যাইনি। হঠাৎ তারা সবাই জড়ো হয়ে একটি মিছিল বের করলেন। শ্লোগান টা আমার হুবহু মনে নেই, তবে এই সমস্যাগুলোর প্রতিকারের দাবী জানিয়ে। আমি তখন রোমাঞ্চের চরম অবস্থায়। রাত ১১ টায় মিছিলে বের হয়েছি আমি!


তো মিছিলটি হলের নিচতলা, দোতলা প্রদক্ষিণ করতে লাগলো। আমিও জোরে জোরে শ্লোগান দিতে লাগলাম। যে ছেলে জীবনে প্রথমবারের মত বাবা-মা’কে ছেড়ে নতুন কোনো স্থানে রাত্রে থাকছে,সে কিনা প্রথম রাতেই এই তারুণ্যদীপ্ত মিছিলের সক্রিয় কর্মী!


মিছিলটির শেষের দিকে শ্লোগানটি কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগলো, “হল প্রভোষ্টের পদত্যাগ চাই” জাতীয়। আমি কেন জানি ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না। সমস্যার তো সমাধান করা যায়, তাই বলে সরাসরি পদত্যাগ !!?? কী আর করা। মিছিল চলতে চলতে এক সময় হলগেটে এসে থামলো। ভাইয়ারা একেকজন ছোট খাট ভাষণ দিতে লাগলো যে হল প্রভোষ্টের পদত্যাগ ছাড়া কোন সমাধান হবে না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, ভাইয়াদের বলি শুধু শুধু পদত্যাগ-এর কী দরকার। পরে বুঝতে পারলাম যে “রাজনীতির ভেতর পলিটিক্স ঢুকে গেছে”। চুপ থাকাই শ্রেয়।
সব কিছু শেষ করে করে প্রায় সাড়ে এগারটায় গেলাম রুমে। সবার সাথে আড্ডা দিলাম। যদিও আমি একেবারে হলে উঠার প্ল্যান করে এসেছি, কিন্তু কাপড়-চোপড় কিছুই আনিনি। এই অবস্থায় ওখানকার নতুন বন্ধুরা তাদের বালিশ, কম্বল (শীতের রাত) শেয়ার করতে রাজী হল। এর মধ্যে আব্বুর ফোন চলে এসেছে। কেমন আছি, কী করছি, খেয়েছি কী না জানতে। সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম আব্বু’র মন আমার জন্য কাঁদছে।
বান্ধবীকে জানালাম এস.এম.এস করে যে আমি হলে থাকছি। বরাবরই আমি ঘুমকাতুরে ছিলাম, সর্বোচ্চ সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতাম। আব্বু-আম্মু’র ভয়ে বান্ধবীর সাথে কথা বলতাম না রাতে। এনিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ছিল। সে আমাকে মোটামুটি পছন্দ করতো এবং রাতে কথা বলতে চাইত, যা আগে কখনো হয়ে উঠে নি। সে রাতে তো আর বাধা নেই; কিছুক্ষন পরই ফোন দিল, আর শুরু হল কথা। কথা... আর কথা...। জীবনের সব কথা যেন উগরে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার। রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম কথা। কখনো হাটছি, কখনো দাঁড়িয়ে আছি, কখনো বসে আছি, কখনো সিড়িতে, কখনো রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো গেষ্টরুমের ভিতর সোফায় গা এলিয়ে। ভাল লাগা, না লাগা, সুখ-দুঃখ সব শেয়ার করতে থাকলাম। এরই মধ্যে মিছিলের লীডার এক ভাইয়া এসে গেষ্টরুমে দেখলেন আমাকে ফোনে কথা বলছি। বলেই ফেললেন যে,যাও ঘুমাও গিয়ে, শরীর খারাপ করবে রাত জাগলে। মনে মনে হয়তো ভাবলে, “বেয়াদব ছেলে, প্রথম রাতেই এত কান্ড !” তো এদিকে আমাদের কথা থামতেই চায় না। কথা বলতে বলতে যখন রুমের বারান্দায় যেতাম, রুমের বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতে লাগলো। আমার কোনো দিকে খেয়াল নেই। রাত প্রায় দু’টার দিকে কথা থামালাম। ঘুমুতে হবে এখন। সবাই আমাকে বলছিল কী ব্যাপার, “এত গভীর প্রেম !” হা হা..


তো জীবনের প্রথম ডাবলিং, তাও আমি বিছানার বাইরের পাশে। ভয় হতে লাগলো যদি ঘুমের মধ্যে বিছানা থেকে পড়ে যাই! লাইট অফ করে ঘুমুতে গেলাম প্রায় আড়াইটায়। শুয়ে শুয়ে এক জন আরেক জনকে পচানোর চেষ্টায় বিভোর। যেই আমি কিনা রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে পড়ি, আজ বাজলো আড়াইটা! খুব ঘুম পাচ্ছিল...... অবশেষে ঘুমোলাম। কখন ঘুমোলাম টের পাইনি। সারারাতে ঘুম হলো তিন-চার ঘন্টা। ঘুম থেকে অনেক কষ্টে উঠলাম ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ শেষ করে দেখি আমি চোখে কিছু দেখছিনা যেন। আরে ভাই ঠিকমতো দাড়াতেই পারছিলাম না। মাথাটা প্রচন্ডভাবে ঘুরছে, অনেক খারাপ লাগছিল। রাত জেগে প্রথমবারের মত কথা বলার পরিণাম! প্রচন্ড দূর্বল ও অসুস্থবোধ করতে লাগলাম।

হঠাৎ মনে পড়ল বাবা-মা’র কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। এই ভোরেই রওনা (পালিয়ে গেলাম বলা যায়) দিলাম। না বাবা, আমার হলে উঠে কাজ নেই। আমি যা আছি, যেভাবে আছি, তাই ভালো,

“নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা”

বাসায় এসে বললাম আমি হলে থাকবোনা। বাসায় থেকেই পড়ালেখা করবো। আব্বু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন...

(অনেকে হয়ত ভেবে বসবেন যে আমি হল এর অসুবিধার কথা একরোখা ভাবে বলেছি, কিন্তু আসলে তা না। ঐ রাতে সৃষ্টি হওয়া আমার নিজের সমস্যা লিখেছি মাত্র। এরপর অবশ্য অনেক রাত থেকেছি হলে, কিন্তু পার্মানেন্টলি না।)

ফেসবুকে আমার নোটেও প্রকাশিত

বিঃ দ্রঃ আমার এই অনুভূতিগুলো একান্ত ব্যক্তিগত। কাউকে হেয় করার জন্য নয়, হয়ে থাকলে আমি খুবই দুঃখিত। তবে অযাচিত কমেন্টস মুছে দেয়া হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৬
২১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×