somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবদুল্লাহ কটকী (সঞ্জীব পট্টনায়েক)-এর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার

০৩ রা মে, ২০১২ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবদুল্লাহ কটকী (সঞ্জীব পট্টনায়েক)-এর
সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার

আমার ধারণা এই যে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ইসলামের মুসলমানদের কাছে কোন কদর নেই। কিম্বা তাদের খান্দানী সূত্রে পাওয়া এই সম্পদে তাদের অনুভূতিও নেই যে, ইসলাম থেকে বঞ্চিত মানুষ কত বড় বিপদের মধ্যে আছে এবং তারা কতটা সহানুভূতি পাবার যোগ্য। আল্লাহর কসম! তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করুন এবং তাদেরকে জাহান্নামের কষ্টদায়ক আগুন থেকে বের করবার চিন্তা করুন, ভাবুন। কমপক্ষে তাদের কষ্ট ও ব্যথাই অনুভব করুন।

আহমদ আওয়াহ. আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
আব্দুল্লাহ কটকী. ওয়া আলাইকুমুস সালাম ও রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
প্রশ্ন. আমার নাম আহমদ। মাওলানা কালীম সাহেবের পুত্র। গতকাল আব্বা আপনার ঠিকানা দিয়েছিলেন। আপনার শরীর-স্বাস্থ্য কেমন?
উত্তর. হ্যাঁ, আহমদ ভাই, আমি আপনাকে জানি ও চিনি। আজ প্রায় এক মাস হলো আমি ফুলাতে আছি। আমার শরীর-স্বাস্থ্য আলহামদুলিল্লাহ এখন ঠিক আছে।
প্রশ্ন. আব্বা বলেছিলেন আমাকে, ‘আরমুগান' পত্রিকার জন্য আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিতে।
উত্তর. অবশ্যই ভাইয়া! মাওলানা সাহেব আমাকেও বলেছিলেন, আমি আহমদকে পাঠাব। আপনি আপনার জীবনের কাহিনী তাকে শোনাবেন।
প্রশ্ন. আপনি আপনার পরিচয় দিন।
উত্তর. আমার পুরানো নাম সঞ্জীব পট্টনায়েক। উড়িষ্যার কটক নামের এক জায়গায়, এক শিক্ষিত পরিবারে ১৯৩০ সালের ৯ই জানুয়ারি তারিখে আমার জন্ম। পিতাজী এক ইন্টার কলেজে লেকচারার ছিলেন। তিনি হঠাৎ করেই হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ায় আমার পক্ষে বিএসসির পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নাই।
প্রশ্ন. আপনার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
উত্তর. পিতার মৃত্যুর পর মা ও বোনের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। বোনের বিয়ের কথাবার্তা আব্বাই পাকাপাকি করে রেখে গিয়েছিলেন। আমি টাকা-পয়সা ঋণ করে কোনভাবে বিয়ে দিই। আমি দু'বছর পর্যন্ত পিতা যে স্কুলে ছিলেন সেই স্কুলে জুনিয়র সেকশনে শিক্ষকতা করি। কিন্তু স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে তেমন বনিবনা না হওয়ায় আমাকে বাধ্য হয়ে স্কুল ছাড়তে হয়। এরপর আরও দু'চার জায়গায় অল্প-স্বল্প সময়ের জন্য আমি কাজ করি। কিন্তু ঋণ পরিশোধের কোন ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি। আমার উপর ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধি পায়। ছ' বছর পর্যন্ত আমি রুজি-রোজগারের জন্য অস্থির ও পেরেশান থাকি। অবশেষে আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিই এবং এক বড় নদীর পুলের উপর উঠি। সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে ডুবে মারা যাব। আমি পুলের উপর চড়ছিলাম, এমন সময় সেখানে একজন মাওলানা সাহেব এসে উপস্থিত হন। তিনি শীত মৌসুমে ঠাণ্ডার ভেতর আমাকে পুলের উপর চড়তে দেখে মোটর সাইকেল থামান এবং আমার হাত ধরে নিচে টেনে নামান এবং আমি পুলের উপর কেন চড়েছি তা জানতে চান। আমি আমার সংকল্পের কথা বলি। মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন, “আমার কথা আগে শোন। এরপর যা চাও কর।” তিনি আমাকে বলেন, “নদীতে লাফ দিয়ে পড়লেই তুমি মারা যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। হতে পারে যে, তুমি কোনভাবে বেঁচে যাবে এবং পানি তোমার ফুসফুসের ভেতর ঢুকে তোমাকে অসুস্থ করে ফেলবে। না জানি এই অসুস্থ অবস্থা তোমার কতদিন থাকে। আর পানিতে ডুবে মারা যাওয়াই যদি তোমার ভাগ্যে লেখা থাকে তাহলে মনে রেখো এই মৃত্যুই শেষ নয়। এই মৃত্যুর পর আরেকটি জীবন আছে যার শেষ নেই। তোমার মালিক এই জীবন ও জান আমানত হিসেবে তোমার কাছে গচ্ছিত রেখেছেন যা রক্ষা করা তোমার দায়িত্ব। যদি তা রক্ষা করার পরিবর্তে আত্মহত্যা কর তাহলে কিয়ামত (পরকাল) পর্যন্ত তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে আর সে শাস্তি হলো তোমাকে বারবার পানিতে ডুবে মরতে হবে। এর থেকে ভালো হলো মৃত্যুর আগে মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের চিন্তা কর, ভাব।” আমি তাকে বললাম, মৃত্যুর পর মানুষ তো গোলে পচে যায়।” মাওলানা সাহেব খুব ভালোবেসে উদাহরণ সহযোগে আমাকে বোঝাতে থাকেন। মাঝে মাঝে কুরআন মজীদের আয়াত পড়তে থাকেন যা আমার দিলের ওপর আছর করতে থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সফল বানাবার রাস্তা কি সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আমাকে মুসলমান হতে বলেন এবং আমাকে আমাদের পীর সাহেবের কাছে ইউপিতে যাবার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দেন যে, আপনি সেখানে গিয়ে আর কিছু পান আর না পান, অবশ্যই শান্তি পাবেন। আমি তাকে আমার ঋণ সম্পর্কে বলি এবং এও বলি যে, এতদূর যাবার ভাড়ার পয়সা আমার কাছে নেই। তিনি আমাকে মোটর সাইকেলে চড়িয়ে ঘরে আনেন এবং আমাকে একটি চিঠি লিখে দেন ও ৫০০ টাকাও আমাকে দেন।
আমি মা'র কাছে গেলাম এবং তাকে বললাম, “দিল্লীতে আমার চাকুরী হচ্ছে।” মা আমাকে খুশি হয়ে অনুমতি দিলেন। আমি ট্রেনে চড়ে দিল্লী পৌঁছলাম। এখান থেকে অন্য ট্রেন ধরে খাতুলী পৌঁছলাম। এরপর ফুলাত পৌঁছি। মাওলানা সফরে গিয়েছিলেন। আকস্মিকভাবেই মাওলানা সাহেবের এক মুরীদ মাওলানা আকীক সাহেব কটকী এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি হিন্দী বলতে পারতাম না। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার জানে পানি এল। তিনি আমার গোটা কাহিনী শুনলেন এবং আমাকে মুবারকবাদ দিলেন যে, “আপনি খুব উপযোগী ফয়সালা করেছেন। হযরত কাল এসে যাবেন।” তিনি মাওলানা সাহেবের খুব প্রশংসা করলেন। পরদিন চারটার সময় তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। সাক্ষাত হলো। মাওলানা সাহেব আমাকে কালেমা পড়ালেন এবং আমার নাম রাখলেন : আব্দুল্লাহ। আমি কেবল ইংরেজি আর উড়িয়া ভাষা জানতাম। আমি ইংরেজি ভাষায় মাওলানা সাহেবের কাছে দরখাস্ত করলাম, “আমি এখানেই থাকতে চাই। আর আমি রুযী-রোযগারও করতে চাই।” মাওলানা সাহেব আমাকে মাওলানা আকিক সাহেবের সাথে জসোলা গ্রামে থাকার জন্য পাঠিয়ে দিলেন যে, “আপনি সেখানে থেকে কিছুদিন হিন্দি ও উর্দূ বলা শিখে নিন, আর কিছু দ্বীনও শিখে নিন। আমি বাইরের এক সফরে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে এসে কোন ইস্কুলে আপনাকে কাজে লাগিয়ে দেব।” আমি পরদিন সকালে মাওলানা আকীক সাহেবের সঙ্গে খসোলা গ্রামে চলে যাই। সেখানে আমি কায়েদা পড়তে শুরু করি। ওযূ-গোসলের নিয়ম-কানুন শিখি। নামায শিখতে শুরু করি। মাওলানা আকীক পাক-পবিত্রতা ও বহুবিধ অসুখ-বিসুখের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাকে খতনা করার পরামর্শ দিলেন। আমি খোদ আসল মুসলমানী বলতে খতনাই বুঝতাম। এজন্য আমি নিজেই খতনা করার ওপর জোর দিলাম। হাজাম ডেকে খতনা করালাম। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। আজ আমি পাক্কা মুসলমান হলাম।
প্রশ্ন. আপনি খাতূলী থানায় আব্বার বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট করিয়েছিলেন, কারণ বলুন তো?
উত্তর. আহমদ ভাই! এ ছিল আমার কাপুরুষতা। সম্ভবত কুকুরও এরকম কাপুরুষতা ও বোকামীপনার কাজ করত না। আপনার আব্বার সঙ্গে আমার সাক্ষাত ছিল কেবল কয়েক ঘণ্টার বরং এক্ষেত্রেও ব্যস্ততার কারণে বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশি আমার কথা হয়নি। কিন্তু এই বিশ-পঁচিশ মিনিটেই আমি অনুভব করলাম যে, এই মানুষটি এই কলি যুগের মানুষ নন। এ লোকটিতো গোটা মানবতার ব্যথায় কাতর কোন পুরনো যুগের মানুষ, যাঁর মুখে প্রতিটি দুঃখী মানুষের দিলের প্রতিষেধক। আমি শত বছরের হতাশ মানুষ যেন পুনর্বার জন্মগ্রহণ করেছি। আমার মেযাজে ক্রোধ ছিল জন্মসূত্রে। কিন্তু এত দীর্ঘ হতাশ জীবন আমাকে সীমাতিরিক্ত তিরিক্ষি মেযাজের বানিয়ে দিয়েছিল। মাওলানা সাহেব এক দীর্ঘদিনের জন্য দুবাই ও ওমরার জন্য চলে গিয়েছিলেন। আমি ছিলাম খসোলায়। সেখানেও আমাকে বারবার উস্তাদদের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া করতে হত। কিন্তু মৌলভী আকীক সাহেব আমাকে বোঝাতেন। এমন সময় আকস্মিকভাবে মৌলভী আকীক সাহেবের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে উড়িষ্যায় যেতে হয়। আমি তাঁকে আমার মা'র খবর নেয়ার জন্য বলি। তিনি আমার সঙ্গে লড়াই-ঝগড়ার ভয়ে ফুলাত ছেড়ে চলে যান। আমি সেখানে খানকায় থাকতাম। মাস্টার ইসলাম সাহেব ছিলেন একজন নও মুসলিম। তিনি ছিলেন এর যিম্মাদার। সেখানে আমার বারবার মেহমানদের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া হত। মাস্টার সাহেব আমাকে বোঝাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে লড়াই-ঝগড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাকে তিনি মসজিদের কামরায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে মুওয়াযযিন সাহেবের সঙ্গে আমার লড়াই হতে থাকল। একদিন আমি মুওয়াযযিন সাহেবকে খুব গালি দিলাম। মাস্টার ইসলাম সাহেব আমাকে খুব ধমক দিলেন যে, রোজ রোজ লড়াই-ঝগড়া আমরা কতদিন আর বরদাশত করব? আমার রাগ হলো। মাস্টার সাহেবকে আমি গালি বকতে থাকলাম। অবশেষে আমি তার ঘাড় ধরলাম। তাঁরও রাগ হলো। তিনিও আমাকে ধরে দু'চারটে থাপ্পড় লাগালেন। ব্যাস আর কি! আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এরপর আমি আমার সামানপত্র উঠিয়ে নিলাম এবং সোজা খাতূলী থানায় গিয়ে রিপোর্ট লেখালাম যে, মাওলানা কালীম সাহেব আমাকে দিল্লী থেকে গাড়ির ডিব্বায় তুলে জোরপূর্বক এনেছেন। এরপর আমাকে মেরে-পিটে কালেমা পড়িয়েছেন এবং মুসলমান বানিয়েছেন। হাত-পা বেঁধে আমার খতনা করিয়েছেন। এরপর তিনি নিজে তো আরব সফরে গেছেন এবং দু'জন পাহলোয়ান ইসলাম ও আব্দুল্লাহকে আমার ওপর খবরদারির জন্য রেখে গেছেন, যারা আমাকে মেরে মেরে নামায পড়ায়। আমি কোনক্রমে তাদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। পুলিশ ইন্সপেক্টর আমার কথা শুনে খুব হাসলেন এবং বললেন, “আরে ভালো মানুষ! কিছু সত্যি কথাও তো বল! আজকের যুগেও এটা হয়? তুমি যুবক মানুষ। কথা বল কি হয়েছে? কার সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া করে এসেছে?” আমি বলি, “আপনি আমার রিপোর্ট লিখুন। নইলে আমি এসপি সাহেবের কাছে গিয়ে লেখাব।”
প্রশ্ন. আপনি আব্বুর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখালেন অথচ আপনি এও বললেন যে, তাঁর সহানুভূতি দ্বারা আপনি খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন?
উত্তর. আহমদ ভাই! সত্যি বলতে কি, আমার বিবেক সম্ভবত মৃত্যু অবধি এই বোকামীপনাকে ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু আমার মত কুকুরের ঘেউ ঘেউ দ্বারা প্রেম ও ভালোবাসার গাড়ি কি আদৌ থামবে? আমি থানায় রিপোর্ট করলাম। রিপোর্ট কাঁচা কাগজে লেখা হলো। থানা ইন-চার্জ দু'জন সেপাইকে ফুলাতে মাওলানা সাহেবকে ডেকে আনবার জন্য পাঠালেন। মাওলানা সাহেব বাইরের সফরে গিয়েছিলেন, মাওলানা সাহেবের বড় ভাই উকীল সাহেব একজন ডাক্তার সাহেবকে সাথে করে থানায় আসেন। থানায় একটি বিপজ্জনক মামলা খুব জোরদারভাবে জ্বলছিল। কয়েকদিন আগে কিছু শিব সৈনিক এক গ্রামের জঙ্গলে এক পঞ্চদশী মুসলিম বালিকাকে সকলে মিলে বলাৎকার করে। অতঃপর তাকে হত্যা করতঃ মাটিতে পুঁতে ফেলে। মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লে মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর নির্দেশে আসামীদেরকে বন্দী করা হয়। এর প্রতিবাদে শিব সৈনিকরা সমগ্র এলাকায় একতাবদ্ধ হয়ে আসামীদেরকে মুক্ত করার জন্য থানায় ধর্ণা দিচ্ছিল। এরকম উত্তপ্ত পরিবেশে উকীল সাহেব চিন্তা করলেন যে, যেকোনভাবেই হোক ব্যাপারটা আপোষ-রফা করা যাক। থানার পক্ষ থেকে বড় রকমের অর্থ দাবি করা হচ্ছিল। বড় কথা শোনার পর যে, আমরা কিছু চাই না, ঐ লোকটিকে দিতে হবে যার সঙ্গে এ ধরনের অপরাধ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নয় হাজার টাকায় ব্যাপারটির নিষ্পত্তি ঘটে। থানাদার আমাকে পাঁচ শত টাকা ভাড়া হিসেবে দেয়। আমি বেশি চাইলে আমাকে গালি দেয় যে, মিথ্যা রিপোর্ট লিখাচ্ছ। লজ্জা হয় না? আমি থানা থেকে বেরিয়ে বাসে বসলাম। দিল্লী গিয়ে কটকের টিকিট কাটলাম এবং ট্রেন ধরে পৌঁছলাম। আমার মা মারা গিয়েছিলেন। লোকে আমাকে বলল যে, সেই যে মাওলানা সাহেব যিনি কালীম সাহেবের মুরীদ ছিলেন তিনি আমার মা'র খুব খেদমত করেছেন। চিকিৎসাও করিয়েছেন এবং তিনি মুসলমান হয়ে মারা গেছেন এবং মুসলমানদের কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়েছে। আমি এমন এক হতভাগ্য ফকীরের ন্যায় যার স্বপ্নে বাদশাহী মিলে গিয়েছিল এরপর হঠাৎ চোখ খুলে দেখতে পাই সে যেই ফকীর সেই ফকীরই রয়ে গেছে। ফুলাত থেকে ফিরলাম। এক অজানা ভয় ও আতংক আমি ভেতর ভেতরই অনুভব করছিলাম যে, এমনতরো অনুগ্রহকারী ও পরোপকারীর সাথে এ ধরনের বোকামীর শাস্তি আমাকে আমার এই জীবনে অবশ্যই ভুগতে হবে। এতদিন ইসলামের কথা জেনেশুনে অবশেষে হিন্দু হয়ে জীবন ধারণে মন আদৌ মানতে চাচ্ছিল না। কিন্তু আমার মুখও ছিল না কোন মুসলমানের কাছে যাব। এক-দুই মাস আমি কটকে কাটালাম। কোন কোন সময় কিছু ভাবতাম, আবার অন্য সময় অন্য কিছু ভাবতাম। একদিন এক পণ্ডিতজীর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বানারসের এক বড় আশ্রমের যিম্মাদার ছিলেন। আমি লোকটিকে ধার্মিক ভেবে তাকে আমার পেরেশানীর কথা বললাম। তিনি আমাকে তার সাথে বানারস যেতে বললেন। আমি তার সাথে বানারস আশ্রমে চলে গেলাম। এক বছর সেখানে থাকলাম। কিন্তু হিন্দু ধর্মের কোন কিছুই আমার ভালো লাগত না।
ওই দিনগুলোতে বানারসের কয়েকটি আশ্রমে বোমা পাওয়া যায়। আমাদের আশ্রমেও বোমা পাওয়া যায়। পুলিশ কঠোর এ্যাকশন গ্রহণ করে। স্বয়ং মন্দিরে অবস্থানকারী ও পূজারীদেরকে চেক করা হয়। নতুন লোকদের ওপর পুলিশের সন্দেহ হয়। আমাদের গোটা আশ্রমে কেবল আমাকেই পুলিশ গাড়িতে বসিয়ে থানায় নিয়ে যায়। থানা ইনচার্জ আমাকে চেকিং শুরু করেন। আর আমার ওপর আরও সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তিনি বলতে থাকেন, এ লোকটি লস্করে তৈয়্যবার। এর প্যান্ট খুলে দেখ এ মুসলমান। আমার প্যান্ট খোলা হলো। আমার খতনাকৃত দেখে তাদের বিশ্বাস আরও মজবুত হলো যে, এই লোকই সন্ত্রাসী ও আতংকবাদী। আমি তাদেরকে বলি যে, আমার খতনা যবরদস্তিপূর্বক করানো হয়েছে এবং খাতুলী থানায় রিপোর্টও লেখা হয়েছে। থানা ইনচার্জ খাতূলী থানায় যোগাযোগ করলে খাতূলীওয়ালারা বলল যে, আমাদের এখানে এ ধরনের কোন রিপোর্ট গত দু'বছরের মধ্যে লেখা হয়নি। এরপর আর কি? আমার ওপর কঠোরতা আরোপ শুরু হলো। আমার খোঁজ-খবর নেয়ার পর এবং অপরাধ স্বীকোরোক্তির জন্য যে ধরনের পাশবিকতা প্রদর্শন করা সম্ভব তা করা হয়। কঠিনভাবে প্রহার করা হয়। আমার আঙ্গুলের নখ টেনে তুলে ফেলা হয়। পশুত্বের এমন কোন জুলুম ছিল না যা আমি সইনি। মনে হতো যে, এবার আমি মারা যাব। তারা আমার কাছে সন্ত্রাসীদের ঠিকানা চাইত। কিন্তু আমি বলতাম, এটা আমার অপরাধ নয়, যার শাস্তি তোমরা আমাকে দিচ্ছ। আমার অপরাধ তো এই যে, আমি আমার অনুগ্রহকারীকে ধোকা দিয়েছি। কিন্তু ঐসব জালিম এসবের কি বুঝবে? আমার ছবি পত্রিকায় এই মর্মে ছাপা হয়েছে যে, এ লস্করে তৈয়বার পুরনো সন্ত্রাসী। পূজারী বেশে এক বছর যাবত বিকাশ আশ্রয়ে অবস্থান করছে। গোটা প্রশাসন সক্রিয় ছিল। সব কিছুরই করার পর যখন তারা আমার থেকে কোন কিছুই পেল না তখন আমাকে ডিআইজি'র কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এজন্য আমাকে স্ট্রেচারে করে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ডিআইজি বেরেলি থেকে প্রমোশন পেয়ে ডিআইজি হয়েছিলেন। তিনি সমস্ত পুলিশের লোকদের আলাদা করে ভালোবেসে আমার সাথে কথা বলেন এবং আমাকে সত্য কথা বলতে বলেন। আমি কেঁদে কেঁদে আমার সবকিছু তাকে বলি এবং আরও বলি, এসব শাস্তি আমার সেই সঠিক অপরাধের কারণে পাচ্ছি যে, আমি এমন একজন সদয় অনুগ্রহকারীকে দাগা দিয়েছি। তিনি মাওলানা কলীম সাহেবকে জানতেন। দিল্লীতে তিনি মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তাঁর কিতাব “আপ কী আমানত আপ কী সেবা মেঁ” পড়েছিলেন। তিনি আমাকে চেয়ে এনে তা দেখান। ডি.আই.জি সাহেব আমার কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন। তিনি আমাকে বলেন, আমি নিজে ছ'মাস আগে মাওলানা সাহেবের হাতে কালেমা পড়েছি। কিন্তু এখনও আমি ঘোষণা দিই নি। আসলেই তুমি খুব খারাপ কাজ করেছ। তিনি আমাকে বলেন, এখনও যদি তুমি সুখী জীবন চাও তো মাওলানা সাহেবের কাছে ফুলাত চলে যাও। আমি তোমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছি। তবে শর্ত হলো, তুমি ইসলামের ওপর মজবুতভাবে জমে থাকবে। তিনি আমাকে পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে বানারসের একটি মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। মাদরাসার লোকেরা আমাকে রাখতে পরিষ্কার অস্বীকার করে। কেননা যার ওপর ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে আমরা তাকে রাখতে পারি না। লোকে মাদরাসাগুলোকে আরও বদনাম করবে। আমাকে একটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। আমার দু'পায়ের ওপর প্লাস্টার ছিল। দু'মাস পর আমার ভাঙা হাড় জোড়া লেগে যায় এবং ক্রাচে ভর দিয়ে আমি চলতে পারি। কিন্তু আমার শরীর-স্বাস্থ্য একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কঠিন আঘাতের দরুন আমার কিডনী খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বানারসের একজন হাজী সাহেব ডিআইজি সাহেবের বলায় আমার চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ করেন। কিন্তু আমার স্বাস্থ্য ঠিক হয়নি। তখন আমাকে দিল্লী যাবার পরামর্শ দেওয়া হয়। অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইনিস্টিটিউটের জন্য আমাকে ডাক্তার সাহেব ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। কিছু টাকা হাজী সাহেবের কাছে থেকে নিয়ে দিল্লী আসি। দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইন্সিটিটিউটে এক সপ্তাহ যাবত ঘুরতে থাকি। কিন্তু ভর্তি হতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আমিন সফদর জং হাসপাতালে ভর্তি হই। আমি চিকিৎসা সম্পর্কে একদম হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার খেয়াল হত, হায়! মারা যাবার আগে যদি মাওলানা সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে তাঁর পায়ের ওপর পড়ে মাফ চেয়ে নিতে পারতাম, তাহলে বোধ হয় মৃত্যুপরবর্তী জীবনের রহমতের মাধ্যম হত। আমার বারবার ডি.আই.জি. সাহেবের সেই কথা মনে আসছিল যে, এখনও যদি সুখী জীবন লাভ করতে চাও তাহলে মাওলানা সাহেবের পায়ের তলায় ফুলাত চলে যাও। আমার এও খেয়াল আসছিল যে, এই সদয় অনুগ্রহকারীর কথা আর কী বলব যে, এ ধরনের গাদ্দারের এতটুকু বিপদেই মুক্তি পেয়ে যাই তাহলে তা হবে ডিআইজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও আত্মীয়তার কারণে। নইলে না জানি আমি জেলখানায় পচেগলে কিভাবে মারা যেতাম। মাওলানা সাহেবের কথা আমার খুব স্মরণ হল। আর প্রতিদিন যেমন চিকিৎসা সম্পর্কে আমার হতাশা বাড়ছিল তেমনি তাঁর কথা মনেও পড়ছিল যে, হায়! শেষবারের মত যদি একবার দেখার সূরত হত।
৯ই মার্চ যেন আকস্মিকভাবে আমার জন্য ঈদের বার্তা বয়ে আনল। ১২টা বাজার কাছাকাছি মাওলানা সাহেব তাঁর কোন বন্ধু ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য সফদর জঙ্গ পৌঁছেন। সেই ডাক্তার সাহেব আমাদের ওয়ার্ডেই ছিলেন। আমি মাওলানা সাহেবকে দরজা দিয়ে আমাদের ওয়ার্ডে ঢুকতে দেখেই আমি দরজা দিয়ে না জানি কোন শক্তিতে লাফ দিয়ে মাওলানা সাহেবের পায়ের ওপর পড়ে গেলাম ও জড়িয়ে ধরলাম। মাওলানা সাহেব তো প্রথমে ভয়ই পেয়ে ঘিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন বললাম, আমি আপনার কমিনা, অকৃতজ্ঞ, নেমকখোর আব্দুল্লাহ কটকওয়ালা, তখন মাওলানা আমাকে হাত ধরে তুললেন, বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং জানতে চাইলেন, তোমার একী অবস্থা হয়েছে? আমি কেঁদে কেঁদে তাঁকে গোটা কাহিনী শোনালাম। মাওলানা জানতে চাইলেন, আমি কি এখনও ইসলামের ওপর আছি কি না। আমি বললাম, আল্লাহ তা'আলা প্রকৃত মুসলমান তো এখন বানিয়েছেন। ব্যাস, আপনার পায়ের তলায় জীবন দেবার শেষ আরযূ কেবল আমার আছে। মাওলানা সাহেব আমার বর্তমান দুর্দশাদৃষ্টে খুব দুঃখিত হলেন, আবার খুশীও হলেন যে, দেখা হল, তোমাকে পেলাম। মাওলানা সাহেব আমার লজ্জা-শরম আরও বাড়িয়ে দিলেন এধরনের কাপুরুষতা সত্ত্বেও তিনি আমার জন্য চিন্তিত ছিলেন যে, না জানি আমি হিন্দু হয়ে মারা যাই কিনা, এবং চিরদিনের জন্য জাহান্নামের লাকড়ীতে পরিণত হই কিনা। তিনি বলেন, হজ্জ-ওমরার সফরে প্রতিটি সুযোগ তিনি আমার জন্য দো‘আ করেছেন যে, আমার আল্লাহ! আমার আব্দুল্লাহকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও এবং তাকে ইসলামের ওপর মৃত্যু নসীব কর। মাওলানা সাহেব আমাকে বলেন, আমি তোমার ইসলামের ওপর চলার জন্য রোযা মান্নত মেনেছি, নফল নামায ও সদাকা মান্নত করেছি। মান্নতের পরিমাণ বাড়িয়েছি। আজ পর্যন্ত চল্লিশটি রোযা, একশ' রাকাআত নফল এবং দশ হাজার টাকা সদাকা মান্নত মেনেছি। তোমার ইসলামের ওপর ফিরে আসার জন্য। আমি এ কথা শুনে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম যে, এ ধরনের অকৃতজ্ঞের সঙ্গে এরূপ সহানুভূতি প্রদর্শন! ইয়া আল্লাহ! এই গোটা সৃষ্টিজগত এ ধরণের লোকদের জন্যই টিকে আছে। আমি মাওলানা সাহেবের পা বারবার জড়িয়ে ধরছিলাম যে, আল্লাহর ওয়াস্তে এই আহমকটাকে মাফ করে দিন। আমার কারণে ভাই সাহেবকে নয় হাজার টাকা থানায় দিতে হয়েছে। মাওলানা সাহেব বারবার আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরছিলেন আর বলছিলেন, আমাদের ইসলামের ওপর পুনর্মিলনের পর আমার আর কোন বিষয়ের অনুভূতি নেই। আর ন' হাজার টাকা তো আল্লাহ পাক আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি বললাম, তা কিভাবে? আহমদ ভাই! দেখুন আল্লাহর কাছে সত্যিকার মানবতার বন্ধু ও সহানুভূতিশীল লোকদের কিভাবে কদরদানি হয়। মাওলানা সাহেব বলেন যে, আমি বাইরের সফর থেকে ফিরে এলে লোকে আমাকে পুরো কাহিনী শোনায়। আমি সাথীদের বললাম, আপনাদের বোঝাবার দরকার ছিল। নয় হাজার টাকাতো এমন কিছু না। অবশ্য সে যদি মুরতাদ হয়ে যেত তাহলে একজন মানুষের ঈমান থেকে চলে যাওয়া সমগ্র দুনিয়া লুট হয়ে যাবার থেকে বেশি ক্ষতি হত। মাওলানা সাহেব বলেন, আমার এও খেয়াল হয়েছিল যে, যদি থানায় ঘুষের ধারা একবার চালু হয়ে যায় তাহলে এই রক্ত পুলিশওয়ালাদের মুখে লাগবে। সৌভাগ্যক্রমে কিছুকাল আগে মাওলানা সাহেব হযরত মাওলানা রাবে সাহেবের “পয়ামে ইনসানিয়াত”-এর একটি সফর এলাকায় করিয়েছিলেন। এ উপলক্ষ্যে মীরাট, খাতুলী, বিজনৌর, মুজাফফরনগর প্রভৃতি শহরে পয়ামে ইনসানিয়াতের বিরাট বিরাট জলসা হয়েছিল। মুজাফফরনগর জলসায় সিটি এসপি মি. এ. কে. জৈন শরীক হয়েছিলেন, যিনি “পয়ামে ইনসানিয়াত আন্দোলন' সম্পর্কে লাখনৌ পোস্টিংয়ের যামানা থেকেই অবহিত ছিলেন। তিনি মুজাফফরনগরে আমার বক্তৃতা শুনেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মাওলানা সাহেব! আমি আপনার এই ফোরামের আজীবন সেবক। আপনি আমাকে এর আজীবন সদস্য গ্রাহক ফি নিয়ে নিন এবং দিনেরাতে দেশের যেই প্রান্তে হোক যেই সেবা প্রদানের জন্য আপনি আমাকে ডাকবেন আমি সাড়া দিতে হাজির থাকব। থানার চার্জ সিটি এসপির হাতে। মাওলানা সাহেব শোনান। আমি জানতে চেষ্টা করলাম, জৈন সাহেব এখন মুজাফফরনগর আছে কিনা। আল্লাহর কি মর্জি! তিনি তখনও সিটি এসপি। আমি তাঁকে ফোন করলাম যে, আমার একটি জরুরী কাজ আছে, জৈন সাহেব অত্যন্ত অপারগতা পেশ করে বললেন, আমারই আপনার সেবায় হাজির হবার দরকার ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে আর তাহল এখন কাওড় চলছে। আগস্ট মাসে হরিদ্বার থেকে মানুষ কাঁধে করে কাওড়ে পানি নিয়ে স্ব স্ব মন্দিরে চড়ায়। বিশ লক্ষাধিক লোক এতে শরীক হয়। গোটা এলাকার রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দেয়া হয় এবং পুলিশের ওপর এর যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য বিরাট চাপ পড়ে। আই.জি'র মিটিং আছে। এজন্য আপনি একটু কষ্ট করে মুজাফফর নগর চলে আসুন।
মুজাফফরনগর পৌঁছি। আনন্দের সঙ্গে মিলিত হই। আমি সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক বলি যে, জনৈক ব্যক্তি রুজী-রোযগারের কোন ব্যবস্থা করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে উদ্যত একজন গ্রাজুয়েটকে আমার এক বন্ধু আমার কাছে পাঠিয়েছিল। সে হিন্দী জানত না। সে জন্য আমি তাকে উড়িয়া ভাষা জানে; আমার এমন এক বন্ধুর কাছে রেখে বাইরে গিয়েছিলাম। পরে এক লোকের সঙ্গে তার ঝগড়া হয় এবং সে থানায় মিথ্যা রিপোর্ট লেখায়। থানাদার সুযোগ বুঝে আমার ভাই সাহেবের কাছ থেকে ন' হাজার টাকা নেয়। আপনি যদি আমাদেরকে দেশে বসবাসের অধিকার আছে মনে করেন তবে বলুন। অন্যথায় আমাদেরকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলুন। জৈন সাহেব এ কথা শুনে খুব আফসোস করেন এবং বলেন, আমরা থাকতে যদি আপনার সাথে জুলুম হয় তাহলে আমাদের জীবন থেকে লাভ কি? কিন্তু আপনাকে কাল আধা ঘণ্টা সময় আমাকে আরও দিতে হবে। কাল বেলা দশটায় আপনি আমার বাসায় আসবেন। ব্যাস, এক কাপ চা পান করবেন। আপনার দিল ঠাণ্ডা করে পাঠাব। আর চা আপনাকে এক নম্বর পান করাব।
মাওলানা সাহেব বলেন, পরদিন আমি জৈন সাহেবের বাংলোয় পৌঁছি। জৈন সাহেব খাতূলীর থানাদারকে আগেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খাতূলীর কোতওয়ালও উপস্থিত ছিল। থানাদারকে খুব গালি দিলেন যে, তোমরা দেবতা চেন না। এঁর কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে গলবে, পচবে, মরবে। সারা দেশকে জ্বালাচ্ছে। আর এই সব নির্বাপিতকারী দেবতা। তাদের সাহায্য করতে না পারলে তাদের সাথে জুলুম অন্তত কর না। জৈন সাহেব বললেন, ব্যাস শেষ কথা হল, কাল পর্যন্ত তোমার ইউনিফর্ম মাওলানা সাহেবের হাতে। যদি সকাল সকাল মাওলানা সাহেবের পায়ের ওপর না' হাজার টাকা রেখে ক্ষমা চাও আর মাওলানা সাহেব যদি ক্ষমা করেন তাহলে তোমার ইউনিফর্ম থাকবে। অন্যথায় নেমপ্লেট নামিয়ে এখানে জমা দিয়ে যাবে।
মাওলানা সাহেব বলেন, আমার আল্লাহর শোকর যে, ওই থানাদার সকালেই ফূলাত আসে, নয় হাজার টাকা আমার পায়ের ওপর রেখে অনেকক্ষণ মাফ চাইতে থাকে। আমি তাকে উঠাই, গলায় জড়িয়ে ধরি ও বলি, আপনি আমার মেহমান, তিনি জৈন সাহেবের সঙ্গে মোবাইল সংযোগ ঘটিয়ে দিয়ে বলেন, আপনি বলুন, আপনি আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। আমি জৈন সাহেবকে তাকে মাফ করে দিতে বলি এবং আল্লাহর শোকর আদায় করি। আমি আজ পর্যন্ত ভাবি যে, সম্ভবত হিন্দুস্তানের ইতিহাসে এটা প্রথম ঘটনা যে, দারোগা ঘুষ নিয়ে পায়ের ওপর রেখে যায় ,আবার ক্ষমা চায়। এর চেয়ে বেশি আমার প্রভু প্রতিপালক রবের ‘হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট' দাঈ ও মুবাল্লিগের সঙ্গে কৃত প্রতিশ্র“তি পালনের আর কী উদাহরণ হতে পারে?
প্রশ্ন. এরপর কী হল?
উত্তর. মাওলানা সাহেব আমাকে সাথে নিয়ে সফদরজঙ্গ থেকে রিলিজ করান এবং নিজের জানাশোনা অল ইন্ডিয়া মেডিকেলের একজন ডা. সাহেবকে ফোন করেন। তিনি তক্ষুণি সফদর জঙ্গে চলে আসেন এবং আমাকে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যালে নিয়ে যান ও ভর্তি করান এবং চিকিৎসা করান। আল-হামদুলিল্লাহ! এক মাসের চিকিৎসায় জীবনের লক্ষণ ফিরে আসতে থাকে। খোদ মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা হবার পর আমি বড় চিকিৎসা ফিরে পাই। আলহামদুল্লিাহ! এক মাস পূর্বেই আমি হাসপাতাল থেকে এসে গেছি। যদিও চিকিৎসা এখনও চলছে। পুরনো দিল্লীর এক মাদরাসায় মাওলানা সাহেব আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখানে আমি ছাত্রদের ইংরেজি পড়াই এবং প্রতি মুহূর্তে আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি যে, এই রকম অকৃতজ্ঞকে ইসলামের দিকে কিভাবে জোর করে ফিরিয়ে দিলেন। আসলে এতো ছিল মাওলানা সাহেবের দরদ ও দোআর অবদান।
প্রশ্ন. এখন কেমন অনুভব করছেন?
উত্তর. আমি বর্ণনা করতে পারব না যে, আমি নিজেকে দুনিয়ার কী পরিমাণ ভাগ্যবান মানুষ মনে করি যে, এতটা নীচতা সত্ত্বেও আমার আল্লাহ আমাকে ঘিরে ধরে ইসলামে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রতিটি পশম কেঁপে ওঠে যে, যদি ফুলাত থেকে ফেরার পর আমার সমস্যার পাহাড় না নেমে আসত আর আমি যদি বানারসের বিকাশ আশ্রমে কুফর অবস্থায় মারা যেতাম, মরার পর চিরস্থায়ী শাস্তি আমি কীভাবে সইতাম। আসল সত্য হল, দুনিয়াতে ইসলাম ও ঈমানের জন্য আমিই ছিলাম সর্বাধিক অযোগ্য মানুষ।
প্রশ্ন. আরমুগান পাঠকদের জন্য আপনি কোন পয়গাম দিতে চাইবেন কি?
উত্তর. আমার ধারণা হয় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ইসলামের মুসলমানদের কাছে কোন কদর হয় না, তেমনি খান্দানী সূত্রে পাওয়া সেই সম্পদেও তার সেই অনুভূতি হয় না যে, ইসলাম থেকে মাহরূম মানুষ কতটা বিপদের মাঝে রয়েছে। এবং তারা কতটা অনুকম্পা পাবার অবস্থায় আছে। আল্লাহর কসম! আপনারা তাদের প্রতি সংবেদনশীল হন এবং তাদেরকে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক আগুন থেকে বের করবার কথা ভাবুন। পারতপক্ষে সেই কষ্ট ও ব্যথাই অনুভব করুন।
প্রশ্ন. বহুত বহুত শুকরিয়া। আবদুল্লাহ ভাই! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। ফী আমানিল্লাহ।
উত্তর. আপনাকেও বহুত বহুত শুকরিয়া। আপনি আমার কাছে এসেছিলেন, আসলেই আমার কাহিনী বহু লোকের জন্য বিরাট শিক্ষণীয়। ভালই হল, মাওলানা সাহেব আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওয়া আল্লাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে
আহমদ আওয়াহ নদভী
মাসিক আরমুগান, জুন, ২০০৬ ইং
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১২ রাত ১০:৩৮
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×