somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই আলোচনাঃ জাদুকরী ভ্রম

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উপন্যাসঃ জাদুকরী ভ্রম
লেখকঃ হামিম কামাল
প্রকাশকঃ চন্দ্রবিন্দু


আমি ব্যক্তিগতভাবে হামিম কামালের লেখার ভক্ত। হামিম কামাল যখন লিখেন তখন সেটাকে কোনোভাবেই সাধারণ লেখার কাতারে আমি ফেলতে পারি না। তার লেখায় সবচেয়ে সুন্দর যে বিষয়টি সেটা হলো, একটা বাক্যজুড়ে থাকে একটা ক্যানভাস। সেই ক্যানভাস শেষ হলে আবার একটা ক্যানভাস। এরকম করে ক্যানভাস জুড়ে বিচরণের সময়টা মাথায় থেকে যায়।

এই জাদুমন্ত্র হামিম কামাল কীভাবে শিখেছেন আমার জানা নেই। তবে এই জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলাম ২০১৮ সালে প্রকাশিত "কারখানার বাঁশি" উপন্যাস পড়ে। এবং দুই বছর পরে বর্তমান বইমেলায় প্রকাশিত "জাদুকরী ভ্রম" নামের নতুন উপন্যাসটিতে হামিম কামাল আবারও সেই লেখার জাদু দেখালেন। যেন নিজের লেখার স্বার্থক একটা নাম, স্বার্থক একটা উপন্যাস "জাদুকরী ভ্রম!"

হামিমের লেখার আরও যে চমৎকার বিষয় সেটি হলো মেদহীন উপমা। বাড়তি কোন উপমা কিংবা ব্যাখ্যা ছাড়াই হামিম কামাল পুরো একটি চিত্রকল্প বুঝিয়ে দিতে পারেন। যেমন ধরুন ভালোবাসার মানুষটি যখন ময়ূখের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো তখন হামিম কামাল সেই ঘটনা বলেছেন এভাবে, -

"হঠাৎ নিজেকে ভীষণ রকম ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে ফেললো। আমি কেবল তার চোখ দেখতে পেতাম।"

ব্যথিত ময়ূখ প্রশ্ন রাখে অনুশাসনগুলো কি বুদ্ধিদীপ্ত কীনা। উত্তর আসে না, আমরা যেমন রোজকার এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, ময়ূখের ভালোবাসার মানুষটিও এড়িয়ে যায়।

আর উপমা ব্যবহারে হামিম কামাল প্রতিনিয়তই স্বকীয়তার সাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। আমরা ছোট বাচ্চাদের দেখলে সবসময়ই প্রগলভিত হই, আদর করতে চাই। তাদের অর্থহীন খেলাধূলা আমাদের আনন্দে উদ্বেলিত করে। এই ঘটনাগুলোকে হামিম কামাল লিখেছেন, -

"আনন্দের একটা ফুলকি আমার চোখে পড়ল। ছোট্ট একটি মেয়ে...সে কী দৌড়ঝাঁপ তার।"

মানুষের বিচার প্রক্রিয়া আর বন্যদের বিচারিক ক্ষমতাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে হামিম কামাল জানিয়েছেন, -

"বন্যরা মানুষের আদালত ব্যবহার করে না, করে প্রকৃতির আদালত।"

মানুষ সবসময়ই নিজের প্রয়োজনে বন এবং বন্যদের উপর আগ্রাসন চালিয়েছে। তার বিনিময়ে প্রকৃতিও কখনও ছেড়ে কথা বলেনি, উপরন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ পরায়ণতা কতো দীর্ঘ এবং স্থায়ী হতে পারে তার ক্যানভাস এঁকেছেন হামিম চমৎকার এক উপসংহারে, -

"পিতা দণ্ডিত না হয়ে সন্তান দণ্ডিত হয়।"

উপমার দারুণ আর এক ব্যবহার মনে পড়ছে, "মেঘেদের গর্জন যেন দুইদল ফেরেশতার যুদ্ধ!"

তারার সাথে মানুষের যোগসূত্রিতার নতুন এক ভাবনা পাই হামিমের লেখায়, "আকাশের তারারও শেষ আছে, মানুষের দাবির কোন শেষ নেই।" জেনেছি গানের কথায় পাওয়া যেতে পারে পাকা ধানের ঘ্রাণ!

হামিম কামালের স্বকীয়তার আরও একটি জায়গা সেটি হলো ডিটেইলিং। জাদুকরী ভ্রমে যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। যেন সুনিপুন কোনো চিত্রশিল্পী, একটি দৃশ্যেরও কোন আঁচড় মিস যাবে না হামিম কামালের লেখায়। যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে সাগরতীরের নির্জর বিকেলের শহর। কিংবা ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ছোটো ছোটো দৃশ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম কীভাবে ময়ূখ একটা চাদরকে কখনও বালিশ বানাচ্ছে, কখনও বিছানা আবার কখনও দড়ি কিংবা মাথার পট্টি!

হামিম কামাল প্রাঞ্জল ভাষায় এঁকে যাচ্ছেন একটা গ্রাম, গ্রামের মাঝে বাতাসে দোল খাওয়া ধানক্ষেত, ধানক্ষেতের মাঝে জাদুর মতো এক কুঁড়েঘর, কুঁড়েঘরে জ্বলছে সোনালি আগুন! যেন সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে সকল চিত্রকল্প!

কখনও রক্তজমাটের মতো ঠাণ্ডার বর্ণনা কাঁপিয়ে দিচ্ছে আপনার চোয়াল কিংবা অশরীরি কতগুলো ছায়া ঘিরে ধরেছে আপনাকে, আপনি ময়ূখের মতোই নিশ্চল হয়ে আছেন, পারছেন না ছুটে পালাতে!

এই ডিটেইলিংয়ের মুগ্ধতা পেয়েছিলাম কারখানার বাঁশি উপন্যাসেও। সেই ধারাবাহিকতা আছে জাদুকরী ভ্রমেও!

একটি গল্প সাথে আরও অনেক উপগল্প নিয়ে বুনন করা হয়েছে জাদুকরী ভ্রমের দারুণ এক ভ্রমণ। নলদমন্তীর গ্রামে ঘুরতে গিয়ে ময়ূখ এবং অরবিন্দের বরাত দিয়ে এক বৃদ্ধের গল্পে জেগে উঠবে দেবযানী কীভাবে আসমানী হলো, আসমানীর ছেলে হলো কাহের। তুচ্ছ থেকে কাহের হয়ে উঠলো প্রতুৎপন্নমতি, তারপর জমিদার! বৃদ্ধের কাছে যে গল্পের সুচনা হয়েছিলো রফিকের কাছে এসে প্রতিরাতে সেই গল্প ডালপালা ছড়িয়ে যেন জীবন্ত মহীরুহ হয়ে উঠছিলো গল্পের প্রতিটি চরিত্র। এতো আসলে হামিম কামালেরই জাদু!

শব্দ চয়ন এবং চরিত্র কিংবা প্রাকৃতিক কোন দৃশ্যের নামকরণে মনে হচ্ছে এই যুগে হামিম কামাল অদ্বিতীয় হতে চলেছেন। নাহলে নদীর নাম দেবীজঙ্ঘা কেইবা দিতে পারে! কেইবা ভাবতে পারে গাঁয়ের নাম হতে পারে নলদমন্তী কিংবা পিয়াই!

পাঠককে আমন্ত্রণ রইলো নলদমন্তী গ্রামের জাদুকরী ভ্রমে ময়ূখ এবং অরবিন্দুর সাথে ক্যারিশম্যাটিক পথ চলায়, কিংবা গল্প নদীর মতো স্রোতে ভেসে পিয়াই গ্রামে মিনা, মজনুনের সাথে পরিচিত হওয়ার। মজনুনের আদর্শিক শিক্ষক মহেনের কাছে জানা যায় সেই কাহেরের অত্যাচারি হয়ে ওঠার গল্প! উপন্যাস যতো এগিয়েছে পাঁজলের মতো করে একটা একটা অংশ মিলে জাদুকরী ভ্রম হয়ে উঠেছে ক্ষমতাবান বনাম নিপীড়িতের লড়াই। জমে উঠেছে মজনুন বনাম কাহের সৌদ!

পরিশেষে বলতে চাই, মিনি হুমায়ুন আহমেদ লেখকদের নিয়ে হাইপের যুগে হামিম কামালের মতন উপন্যাসিক বাংলা সাহিত্যে আশার আলো হয়েই এসেছেন। কারখানার বাঁশির সুরের জাদুকরী ভ্রম হামিমের কলম ধরে বাংলা সাহিত্যে আরও বেশি আসুক। হামিম কামালের জন্য ভালোবাসা এবং শুভ কামনা রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:২৮
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×