নদীর পারে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো মেহদী। সূর্যের তেজ কমতে শুরু করছে পড়ন্ত বিকেলের নরম রৌদ গায়ে এসে পরছে ভালই লাগছে। নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কাশফুলগুলো বাতাসে দুলছে, ধপধপে সাদা শরীরে লম্বা হয়ে আকাশের বুকে যেন কোনো অদৃশ্য সুরের তালে দোল খাচ্ছে। নদীতে মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে দুই-একটা বালুবাহী নৌকা। একসময় এই নদীতে যাত্রীবাহী নৌকা চলত, লোকজন এপার থেকে ওপার যেত নৌকায় চড়ে। ব্রীজ হওয়ার পর থেকে এখন আর কেউ নদী পার হয় না, কেউ কেউ নৌকায় চড়ে বেড়াতে আসে। নৌকাগুলোও এখন বালু আর মাছ ধরার কাজেই ব্যবহৃত হয়। সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রা, বদলে যাচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য।
নদীর পাড়ে ভালো লাগছে বুকভরে শীতল বাতাস টেনে নিচ্ছে ফুসফুসে। এই অনুভূতিটা শহরের যান্ত্রিক জীবনে পাওয়া যায় না। মাঝে মধ্যে এভাবে প্রকৃতির মাঝে এসে হারিয়ে যাওয়া উচিত।, মানুষ বেঁচে জীবনের তাগিদে শহরমুখি হয় আসলে প্রকৃতিই মানুষের বেশি প্রয়োজন।
হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি আকাশে উড়ে গেল। তারা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কার আগে পৌঁছাতে পারে বাড়ি। মেহদী চেয়ে রইল মুগ্ধ নয়নে এই দৃশ্যটাই যেন তার মনটাকে আরও প্রশান্ত করে দিচ্ছে। শুভ্রার সাথে প্রায় নদীর ধারে বেড়াতে যেতো মেহদী আজ এই সময় শুভ্রাকে খুব মনে পরছে। শুভ্রার নদী খুব পছন্দের ছিল। নদীর ছোট ছোট ঢেও দেখতে তার খুব ভাল লাগলতো।
স্কুল জীবনের প্রথম ও একমাত্র প্রেম ছিল শুভ্রা। ৭ বছর ৮ মাস, ১৩ দিন, ১১ ঘণ্টা ধরে চলেছিল তাদের মিষ্টি প্রেম। সত্যি বলতে, সময়টা সঠিক নয় মেহদীর মনেই নেই ওদের প্রেম কতদিনের ছিল গবে ৭ বছরের বেশি ও ৮ বছরের কম ছিল এটা মনে আছে। এই সময়টা মুখস্থ করে রেখেছে শুধু মাত্র তার প্রেমটাকে গভীর করে দেখানোর জন্য।
শুভ্রাকে প্রথম দেখেছিল স্কুলের গেইটে গায়ে ছিল স্কুল ইউনিফর্ম দেখে মনে হয়েছিল, পরীরা যদি স্কুলে যেত, তাহলে ঠিক এমনটাই লাগত। মেহদীর মনে হচ্ছিলো চারিদিকে রোমান্টিক মিউজিক চলছে। সেই প্রথম দেখা, তারপর ধীরে ধীরে কথা, বন্ধুত্ব, প্রেম। শুভ্রা ছিল মেহদীর জীবনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু ও একমাত্র প্রেমিকা ।
মেহদি চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয়। নদীর পাড়ে একসময় শুভ্রার সাথে কত বিকেল কেটেছে, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে দুজনে কত সময় কাটিয়েছে। সুযোগ পেলেই নদীর পাড়ে এসে বসত।
শুভ্রা নদীর পড়ে ছোট ছোট ঢেউগুলো দেখতে দেখতে মেহদীকে জিজ্ঞাসা করতো—
-আচ্ছা, নদীর জল কি কখনো পুরনো হয়?
-হয় তো, নদী যখন সাগরে মিলিত হয় তখন সাগর নদীকে পানি পুরোনো পানি বদলে নতুন পানি দেয়।
-সত্যি?
-আমি মিথ্যে বলি?
-বল তো।
-তাই...
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো তাদের গল্প শেষ হতে চাইতো না। সন্ধ্যার পর কখনও তমাল মামার ফুসকার দোকানে, কখনও মফিজ মামার ছোলা মুড়ি আবার মাঝে মাঝে টঙের চা, পূর্ণিমার রাতে জোসনা দেখা এভাবে ভালই সময় কাটতো।
মোবাইলটা ভাইব্রেট করল স্ক্রিনে ভেসে উঠল শুভ্রার নাম মেহদীর গা শিরশির করে উঠল, কাঁপা হাতে সে ফোনটা কানে তুলল।
-হ্যালো?
ওপাশ থেকে পরিচিত সেই কন্ঠ—নদীর পাড়ে একা কি করছ?
মেহদীর গলা শুকিয়ে এলো, জিজ্ঞসা করলো
-শুভ্রা? তুমি...?"
-চিনতে পেরেছ?
-তুমি কিভাবে সম্ভব? কোথায় তুমি?
-দেখো, আমি তোমার পাশেই আছি।
মেহদী চারদিকে খুজতে লাগলো, না কোথাও কেউ নেই, নদীর পাড়ে সে একা। একটু ধমকে বললো
-শুভ্রা, এখানে কি রসিকতা?"
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আসে, কিন্তু সেটা অস্বাভাবিক হাসি, রাগি কণ্ঠে বললো
-তুমি ভুলে গেছো? আমি এই নদীর পাড়েই আমি থাকি...
মনে পরে—শুভ্রা নেই। গত বছর এক বর্ষার দিনে, শুভ্রা এই নদীতেই ডুবে গিয়েছিল। স্রোত তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরে। তাকে খুজে পাওয়া যায় নি। বেশ কয়েকদিন খুজেছে ডুবুরি কিন্তু কোন খোজ পাওয়া যায় নি। তারপর একসময় খোজাখুজি বন্ধ হয়ে গেল। শুভ্রাকে সবাই ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছিলো। মেহদী প্রায় শুভ্রার কথা ভেবে অশ্রু ফেলে।
ফোনটা এখনো কানে আছে, ওপাশ থেকে সেই কন্ঠটাই শোনা যাচ্ছে। মেহদির হাত-পা অবশ অবশ লাগছে। কান থেকে নামিয়ে ফোনের স্ক্রিনে আবার তাকায় এখন সেখানে এখন কোনো নাম দেখা যাচ্ছে না, শুধু লেখা— "নম্বরটি অস্তিত্বহীন।" চারদিকে শীতল বাতাস বইতে শুরু করে। মেহদির কাঁপুনি দিয়ে ওঠে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ফোনের ওপাশ থেকে শুভ্রার সেই কণ্ঠ তার খুবই চেনা, অথচ কেমন যেন অপরিচিত লাগছে। ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে—
"আমাকে ভুলতে পারবে না, মেহদী..."