রাজউকের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভায় তুমুল বাগিবতণ্ডা হয়েছে। গতকাল রোববার পূর্ত মন্ত্রণালয়, আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) যৌথ সভায় এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গঠিত পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপনার কথা ছিল। সভার একপর্যায়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান আবাসন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, যে জমি আপনার নয়, তা বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন কেন?
পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আলোচনায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ধৈর্যের সঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের কথা শোনেন। একপর্যায়ে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলমের সঙ্গে তাঁর বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। শাহ আলম প্রতিমন্ত্রীকে ধমকের সুরে বলেন, “আপনি বলেছেন, ‘ভূমিদস্যু অপবাদ নিয়ে আপনারা ঘুমান কী করে।’ এই দুঃসাহস দেখানো আপনার উচিত হয়নি।” মান্নান খান বলেন, ‘হ্যাঁ, বলেছি, লক্ষবার বলব; ওই কথার পর আপনি আমার বাসায় একাধিকবার গিয়েছেন। বলেছেন, “আপনি যা করছেন, উত্তম কাজ করছেন। আপনার কথার পর আমার হুঁশ হয়েছে।” আর এখন এখানে বলছেন উল্টো কথা। আমার মুখ খোলাবেন না। এখন বলছেন, ১৬ মাসে সরকার কিছুই করতে পারেনি।’ এ পর্যায়ে শাহ আলম বলেন, ‘সরকার বলিনি, বলেছি আপনি কিছুই করতে পারেননি।’
পূর্ত প্রতিমন্ত্রী শাহ আলমকে বলেন, ‘হাত নামিয়ে কথা বলুন। শ্রদ্ধাবোধ রেখে কথা বলুন। যে জমি আপনার নয়, সেই জমি বিক্রি করেন কেন? সেই জমি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেন কেন?’
শাহ আলম বলেন, কোথাকার কাকে দিয়ে রিভিউ কমিটি গঠন করেছেন। মান্নান খান বলেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এত সস্তা নন। তাঁকে কেনা যায় না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, দু-একজন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে চলেছেন। এটা করতে দেওয়া হবে না। নদী-নালা, খালবিল ভরাট করে মানুষকে বন্যায় প্লাবিত করার সুযোগ কোনো ব্যক্তিবিশেষকে দেওয়া হবে না।
রিহ্যাবের সভাপতি সরকারি দলের সাংসদ নসরুল হামিদ বলেন, বিএলডিএ ও রিহ্যাব জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অথচ এদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, কোন অঞ্চল পানিপ্রবাহ অঞ্চল হবে, কতটুকু জমি সেখানে থাকবে, তা বিবেচনার মতো যোগ্যতা বিএলডিএ বা রিহ্যাবের আছে। তিনি বলেন, ১৬ মাসে একটি বিধিমালা হয়নি। মানুষ নকশার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। রাজউক ও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে আমেরিকায় মিছিল হয়েছে, এখন আস্তে আস্তে সবার বিরুদ্ধে হবে।
নসরুল হামিদ অভিযোগ করেন, কেরানীগঞ্জের ৮০ ভাগ এলাকাকে বন্যাপ্রবণ দেখানো হয়েছে। জবাবে পর্যালোচনাকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুরো ঢাকা শহরের মাত্র ২১ ভাগ এলাকা বন্যাপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা আছে।
এ প্রসঙ্গে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘রাজউকের ঝিলমিল-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার পরামর্শ দিয়েছি আমরা। একই কারণে রিভারভিউ ও বসুন্ধরা-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না।’
বৈঠক শেষে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন অবিশ্বাস্য ও দুঃখজনক আচরণ দেখে অবাক হয়েছি। সভা থেকে বের হয়ে ভাবছি, এ দেশ কীভাবে চলবে। ঢাকা শহর ভূমিদস্যুদের হাত থেকে কীভাবে বাঁচবে। মন্ত্রণালয়ের ডাকা সভায় গিয়ে এ ধরনের অশোভন ও উত্তেজিত আচরণ, আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গি দেখে মাথা নিচু করে ছিলাম।’ তিনি বলেন, একজন ডেভেলপারের বক্তব্য ছিল, গত ১৬ মাসে দেশ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু ওই সভায় সরকারদলীয় একজন সাংসদ ছিলেন, তিনি রিহ্যাব সভাপতি, ডেভেলপার এবং নগর উন্নয়ন কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁর উপস্থিতিতে সরকারের ব্যর্থতার কথা ওই ডেভেলপার কীভাবে বলার সাহস পেলেন? জামিলুর রেজা চৌধুরী সাহেবকে প্রথমে একটু শ্রদ্ধা জানিয়ে যেভাবে ওই ডেভেলপার আক্রমণ করেছেন, তা কল্পনার বাইরে।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজউক সৎ ও সঠিক নেতৃত্বে আছে। প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। ভালো কাজে হাত দিয়েছেন তিনি। আমরা তাঁকে সহযোগিতা করে যাব।’
যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বলেন, ‘৭০-৮০ বছর ধরে যেসব জমি ভোগদখল করে আসছি, সেসব জমিকে পানিপ্রবাহ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। এ রকম করা হলে মামলা হবে। অন্যের জমিকে সরকার কীভাবে একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে?’ জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব ভূমির মালিক সরকার। সরকার প্রয়োজনে যেকোনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে।
পূর্ত প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন অনেকে অনেক কথা বলছেন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কেউ মুখ খোলেননি কেন? তখন কে কোথায় কীভাবে ছিলেন, তা সবাই জানে।
বৈঠকের একপর্যায়ে পর্যালোচনা কমিটির প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রতিবেদনটি সম্পর্কে কিছু বলতে চাইলে রিহ্যাব ও বিএলডিএর প্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা একযোগে কথা বলতে থাকেন। তাঁরা বলেন, সরকার অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে, এটা মানা যায় না।
হইচইয়ের মধ্যে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ১৯৯৭ সালে জাতীয় সংসদে ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করা হয়। সেখানে সব ধরনের জলাধার সংরক্ষণের কথা বলা আছে। সেই আলোকে পর্যালোচনা প্রতিবেদন করা হয়েছে।
এ পর্যায়ে রিহ্যাব ও বিএলডিএর কর্মকর্তারা বলেন, এই পরিকল্পনা রাজউকের অংশীদার হিসেবে করা হয়েছে। শাহ আলম বলেন, ঝিলমিল প্রকল্প পানিপ্রবাহ অঞ্চলের বাইরে রাখা হয়েছে, অথচ রিভারভিউ প্রকল্প পানিপ্রবাহ অঞ্চলের মধ্যে রাখা হয়েছে।
পূর্ত প্রতিমন্ত্রী এ পর্যায়ে বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আবার বসা হবে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। সবাই মিলেই ঢাকা মহানগরকে রক্ষা করতে হবে।’
আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, রাজউক নিজে জলাশয় ভরাট করে। কিন্তু অন্য কেউ করতে পারবে না। এটা তো ন্যায়বিচার নয়।
জবাবে বলা হয়, জলাশয় ভরাট করতে সরকারের অনুমোদন লাগে। রাজউকের সব প্রকল্প অনুমোদিত। কিন্তু বেসরকারি আবাসন কোম্পানিগুলোর এই অনুমোদন নেই। রিহ্যাব ও বিএলডিএর প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, রাজউক জমির ব্যবসায় থাকতে পারবে না। তার কাজ হবে রেগুলেটরি।
পর্যালোচনা কমিটির সদস্য স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, জলাধার সংরক্ষণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত নির্দেশনা ছিল। প্রতিবেদনে তা মানার চেষ্টা করা হয়েছে।
সভাশেষে ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো আলোচনা সভা এতটা শালীনতাবিবর্জিত হতে পারে, এটা কল্পনার বাইরে। ভবিষ্যতে সভা হলে জানতে চাইব সভার পরিবেশ কেমন থাকবে। যাঁরা মন্ত্রীর সঙ্গে ধৃষ্টতামূলক আচরণ করতে পারেন, তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী আচরণ করেন, তা সহজে অনুমেয়। সরকার যদি এঁদের কঠোর হাতে দমন করতে না পারে, তাহলে মানুষের দুর্দশা আরও বাড়বে।’
বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার শওকত হোসেন ও পর্যালোচনা (রিভিউ) কমিটির সদস্য ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বেলার সারওয়ার জাহান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মাগুরা গ্রুপ ও মধুমতি মেট্রো মেকার্সের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম আলোর প্রথম পাতার নিউজ।
জয় হোক ভূমিদস্যুদের!!!!!!!!!!!