ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চিফ এক্সিকিউটিভ জেমস সাদারল্যান্ড বলেছেন, ''সোমবারের মধ্যে আমরা হয়তো স্পষ্ট করে বলতে পারব, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না।'' এর আগে গতকাল নিরাপত্তা ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর সাময়িক ভাবে স্থগিত করা হয়।'
আজ ব্রিসবেন ন্যাশনাল ক্রিকেট সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চিফ এক্সিকিউটিভ জেমস সাদারল্যান্ড বলেন, ''আমাদের হেড অব সিকিউরিটি সীন ক্যারোল অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাবেন। তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমাদের অবহিত করার পর, তা সন্তোষজনক হলে অস্ট্রেলিয়া দল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।''
তিনি বলেন, ''পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের বাংলাদেশ সফর করার ইচ্ছা এখনো আছে। আমাদের খেলোয়াড়রাও সবাই প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড় ও স্টাফদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রয়েছে। হঠাৎ করে শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) নিরাপত্তা ই্স্যুতে সেখানে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ঝুঁকির বিষয়টি জানানোর পর, আমরা তড়িৎ খেলোয়াড়দের যাত্রা স্থগিত করতে বাধ্য হই। আমরা জানি, এ সপ্তাহে বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎসবের জন্য সবাই ছুটি কাটাচ্ছে। পবিত্র ঈদুল-আযহা পালনের জন্য গত সপ্তাহের শেষ দিন থেকে বাংলাদেশের সরকারি অফিস আদালত বন্ধ রয়েছে। আমরা এও জানি, লাখ লাখ মানুষ ঈদ উৎসব পালনের জন্য এখন রাস্তায় রয়েছে। আর সেখানে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাও এখনো ঘটেনি।''
এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ''অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ ভিত্তিহীন। অতি সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দল বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা নিরাপত্তা সহযোগেই খেলেছে। কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার একটি সংস্থার নিরাপত্তা শঙ্কা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তাদের আশঙ্কার বিষয়টি নিয়ে আমি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ধরনের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশ কখনোই পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের মতো হবে না। আমি আপনাদের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলকে আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।''
গত শুক্রবারে অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) বিভিন্ন দেশে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকেরা বাংলাদেশে ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। বাংলাদেশের ভ্রমণ করাটি জরুরি কি না সেটিও ভেবে দেখতে বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি সহিংসতার কারণে 'ঢাকায় চলাচল অনিরাপদ' এমন দাবিও করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষ্যে অষ্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার এই দাবিকে মোটেও হালকা ভাবে নেবার কোনো উপায় নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সমান মর্যাদা দেওয়া হয় সেদেশের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেনকে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা সবাই অস্ট্রেলিয় নাগরিকদের কাছে মর্যাদাসম্পন্ন। আমরা যেমন নিরাপত্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম, অস্ট্রেলিয়াও একই রকম আশংকা করতেই পারে। কারণ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিষয়টি গোটা বিশ্ব দেখেছে।
বাংলাদেশে কোনো ধরনের জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা নেই, সরকারি তরফ থেকে সব সময় এমন দাবি করা হলেও, বিভিন্ন সময়ে জঙ্গীদের নানান আস্তানা ও গ্রেফতারের খবর বিদেশের পত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়েই প্রচার হয়। চলতি বছর কয়েকজন ব্লগারকে যেভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে, যার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের সম্পর্কের বিষয়টি খোদ রাষ্ট্রই নানা ভাবে নানান সময় স্বীকার করেছে। যে কারণে দেশে একেবারে জঙ্গী তৎপরতা নেই, এই কথাটি কেবল কথার কথা। বরং জঙ্গীদের ধরার জন্য সরকারি তৎপরতা নতুন কোনো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত অনেকটা শীতলই থাকে বলা যায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক ও লেখকদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হলেও সেই সব হত্যাকাণ্ড গুলোর আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখনো প্রশাসন কোনো হদিস করতে পারেনি। গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে যে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, সেই খবর সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা ইস্যুকে কোনো ভাবেই ভিত্তিহীন বলার সুযোগ আমাদের নাই। বরং যথাযথ গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার এই আশংকাকে খতিয়ে দেখাই বাংলাদেশের দায়িত্ব।
অস্ট্রেলিয়ার যে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এখন ঢাকায় আছেন, তারা যদি বাংলাদেশের কাছ থেকে সন্তোষজনক নিরাপত্তা গ্যারান্টি না পায়, তাহলে তারা অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য অনুমোদন করবে না। এটাই স্বাভাবিক। যা ভবিষ্যতে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে নতুন মাত্রা যোগ করবে। যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য মোটেও সুখকর কোনো সংবাদ নয়।
আমরা যারা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সম্পর্কে ধারণা না রেখেই বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ায় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছি, তাদেরও এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের এক নম্বর ক্রিকেট শক্তি। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়ার জন্য সেখানে অনেকের ক্রিকেট খেলার বয়সই শেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে অ্যাসেস সিরিজ হারার পর অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলের ক্যাপ্টেন মাইকেল ক্লার্ক অবসর নিলেও, নতুন ক্যাপ্টেন স্টিভেন স্মিথের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া দলকে যারা বাংলাদেশ দলের চেয়ে দুর্বল মনে করছেন, তারা ভুলের স্বর্গে বা ফ্যান্টাসিতে বাস করছেন। অস্ট্রেলিয়ার ভাইস ক্যাপ্টেন অ্যাডাম ভোগেসের মাত্র ছয় মাস আগে ৩৫ বছর বয়সে টেস্টে ডেব্যু হলেও তিনি বাংলাদেশে খেলার জন্য মুখিয়ে আছেন।
আজ সাবেক ক্যাপ্টেন মাইকেল ক্লার্ক বলেছেন, আমাদের ছেলেরা বাংলাদেশ সফরের জন্য শতভাগ প্রস্তুত। বিভিন্ন দেশের নানান ভেন্যুতে টেস্ট না খেললে একজন খেলোয়াড়ের খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা পূর্ণ হয় না। পাকিস্তানে কোনো টেস্ট খেলতে না পারার আফসোস থেকে ক্লার্ক বলেন, পূর্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হবার পূর্ব শর্তই হলো বিশ্বের বিভিন্ন ভেন্যুতে খেলার অভিজ্ঞতা। যা পাবার জন্য আমাদের ছেলেরা প্রস্তুত। আর তারা বাংলাদেশে খেলার জন্য মুখিয়ে আছে।
অস্ট্রেলিয়া একটি ক্রিকেট খেলুড়ে জাতি। প্রফেশনালি তারা ক্রিকেট খেলেন। পরাজয় জেনেও কখনো মাঠে খেলা ছেড়ে দেবার তাদের কোনো রেকর্ড নেই। খেলার শেষ বল পর্যন্ত তারা লড়াই করেন। অতএব স্যোসাল মিডিয়ায় যারা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সম্পর্কে ধারণা নেই, তারাই বড় বড় ঘেউ মারছে এখন। অথচ একবারও কেউ ভাবছেন না, যদি শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফরে না আসে, তা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কতটা অমঙ্গল ডেকে আনবে। ক্রিকেটের স্বার্থেই বাংলাদেশকে এখন অস্ট্রেলিয়ার জন্য পূর্ণ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে। আর সেজন্য আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখে নয় কাজেই সেই গ্যারান্টি প্রমাণ করতে হবে।
আমরা ক্রিকেটপ্রেমীরাও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ জমজমাট ক্রিকেট লড়াই দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফর কালে দুটি টেস্ট ও একটি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলার কথা ছিল। এখন হয়তো অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফরে আসলেও প্রস্তুতিমূলক ম্যাচটি আর হবে না। কারণ নইলে নতুন করে আইসিসিকে আবার ম্যাচ সিডিউল রিসাফল করতে হবে। প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ না খেলতে পারলেও টেস্ট খেলার জন্য অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরে আসবে বলেই আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গতকালকের আশাবাদের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। বাকিটা সময়ই বলে দেবে। জয়তু ক্রিকেট। জয়তু টিম টাইগার্স।
................................
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ঢাকা