somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সরোজিনী ড্রয়িং: এ নিউ হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান

০২ রা মার্চ, ২০২০ ভোর ৫:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সরোজিনীর জীবনকে কতভাবে যে তুলে ধরা হয়েছে 'সরোজিনীর ড্রয়িং' উপন্যাসে, তা না পড়লে কেউ জানতে পারবেন না। সহজ-সরল ছোট ছোট বাক্যে ধ্রুব এষ যেভাবে গল্প বলেন, সেই গল্পের ভেতরে একবার প্রবেশ করলেই যে কোনো পাঠকের ঘোর লাগবে। ঘোর লাগার প্রধান কারণ ফিকশন। ঘটনার পর ঘটনা। একটার চেয়ে আরেকটা আরো আকর্ষণীয়। এক ঘটনার রেশ না ফুরাতেই লেখক নিয়ে যান অন্য ঘটনায়।

পাঠককে আটকে রাখার যত ধরনের কৌশল রয়েছে, সবগুলো জোড়া দিয়ে ধ্রব এষ এই উপন্যাসে এমন একটি আলাদা ক্রাফট তৈরি করেন যে, একবার আপনি পড়া শুরু করলে, আপনি আর শেষ না করে উঠতে পারবেন না। সরোজিনী ব্রোকেন পরিবারে বড় হওয়া একটি মেয়ে। যে কিনা নিজের মাকে একদম সহ্য করতে পারে না। বাবাকে কিছুটা বিশ্বাস করে। যদিও বাবার জীবনটা আবার নতুন নতুন ফিকশনে ভরপুর।

কিন্তু বাবা-মা'র জীবনের বাইরে সরোজিনী'র নিজের জীবনটায় কত যে বৈচিত্র্য, তা টের পাওয়া যায় গল্পের বাঁকে বাঁকে। ব্রোকেন পরিবারের একটি মেয়েকে জীবনে যে কত ঝড় ঝাপটা পাড়ি দিতে হয়, একটি ঝড় শেষ না হতেই আবার অন্য ঝড়ে আক্রান্ত হবার যে সম্ভাবনা, কিংবা একটি ঝড় থেকে নতুন আরেকটি ঝড়ের মধ্যে সরোজিনী নিজেই যেন অভ্যাসমত আটকে যায়। সরোজিনী'র জীবনটাই যেন একটা মরু ঝড়। সেই ঝড়ে একে একে সরোজিনীর জীবনে আসে অনেক পুরুষ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে দুই দুইবার সংসার গড়েও সরোজিনী সুখী হতে পারে না। জীবনে তার ঝড়ই মুখ্য হয়ে থাকে।

সরোজিনী স্যাজিটেরিয়াস। যৌবনের শুরুতে হুরু আংকেলের কাছে মিরকেট হবার পর তার জীবনের যে বাঁকবদলের শুরু, সেই জীবনে একে একে আসে আনন্দ, কপিল, অধ্যাপক রিশাদ হাসান এবং সবশেষে নিখিলেশ। এরমধ্যে আনন্দকে হুট করে বিয়ে করার পর একটি ছেলের মা হয় সরোজিনী। ছেলের নাম সৌর। আবার নিখিলেশকে বিয়ে করার পর একবার মিসকারেজ হয়েছে।

আর্টিস্ট স্বামী আনন্দের বন্ধুদের মধ্যে কপিল, পান্থ, দারা, নাজমুল ভাই এবং সরোজিনী'র নিজের বন্ধুদের মধ্যে মনিকা, পৃথা, শাহরিন আর পরিবারের বাবা-মা, কাজের মানুষ ও অন্যদের সাথে সরোজিনী'র জীবনে ঘটে যাওয়া নানান রসায়ণ এই উপন্যাসে যেভাবে উঠে এসেছে, তা এককথায় এক জটিল ফিকশন। কিন্তু এই জটিল ফিকশন ধ্রুব এষ এমন সহজভাবে বয়ান করেন যে, পাঠক বুদ হয়ে যেতে বাধ্য।

সরোজিনী নিজের বন্ধুদের সাথে যৌবনে আনড্রেস পার্টি করতো। আর আনন্দকে বিয়ে করার পর সরোজিনী'র জীবনে একে একে ঘটতে থাকে নানান ঘটনা পরম্পরা। অনেক ঘটনার পর স্বামী আর্টিস্ট আনন্দ সন্ধ্যা ছয়টায় তিতিরকে বিয়ে করেছে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বাসায় ফিরেছে এবং নির্বিকারভাবে শুয়েছে সরোজিনী'র সঙ্গে। সেই রাতেই সরোজিনী আনন্দের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা পেয়েছে। অথচ সকালবেলায় সকল সম্পর্ক ব্রেকআপ করে তিতিরের সাথে আলাদা বাসা নিয়ে চলে যায় আনন্দ। পরবর্তীকালে আনন্দ আর তিতির কানাডা চলে গেলেও তাদের মধ্যে যদিও ব্রেকআপ হয়। কিন্তু একমাত্র ছেলের মা হিসেবে সরোজিনী'র সাথে একটা সম্পর্ক শেষপর্যন্ত থেকেই যায়!

লোডশেডিং আর ইলেকট্রিসিটি আসার মত সরোজিনী'র জীবনে বারবার পুরুষ এসেছে। কিন্তু সুখ আসেনি। সুখ এসে আবার সেখানে লোডশেডিং হয়ে গেছে। সরোজিনী'র জীবনের সেসব কাহিনীর যে ক্যানভাস ধ্রুব এষ এঁকেছেন, সেখানে দৈনন্দিন জীবনের কোলাহলের ভেতরে সরোজিনী'র সেক্সুয়াল ডিজায়ারের জন্য হাপিত্যেস, পুরুষসঙ্গীর জন্য আকুলতা, ব্রোকেন ফ্যামিলির দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার পাশাপাশি এক নাতিদীর্ঘ জীবনের খোলস উন্মুক্ত হয়। শেষপর্যন্ত নিখিলেশের সাথে পালিয়ে সরোজিনী'র জীবনে স্থিতি আসার লক্ষণ স্পষ্ট হয়। কিন্তু পুরুষের চরিত্রের ভেতরে যে আদিম লালসা, সেই লালসা পরীক্ষা করতে বা দেখতে গিয়ে সরোজিনী নিজেই যেন বারবার ফাঁদে পা দেয়। কখনো নিজের ইচ্ছায় কখনো বা প্রয়োজনে।

মোদ্দাকথা, সরোজিনী যেন সমকালীন প্রগতিশীল মাইন্ডের এক ঝলক রোদ্দুর। যে নিজেই রোদ্দুর হতে গিয়ে বারবার জীবনকে নানাভাবে পুড়িয়ে নিজের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করে। খড় না হওয়া পর্যন্ত সরোজিনী'র সেই এক্সপারিমেন্ট যেন থামতেই চায় না। আলো, লোডশেডিং, সেক্স, সবমিলিয়ে সরোজিনী'র হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান, যেন সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় সরোজিনী এই সমাজের উঁচু ঘরের মেয়ে হয়েও সেক্সচুয়াল ফ্রাসট্রেশনে ভুগতে থাকা একটি চরিত্র। নিজের জীবনকে সে নানা কায়দায় এক্সপারিমেন্ট করে।

বাবা ও মায়ের চরিত্রে যে বাস্তবতা, সেই একই বাস্তবতায় সরোজিনী যেন নিজেই এক্সপারিমেন্ট করে জীবনকে। পুরুষের মন, পুরুষের সেক্সচুয়াল ক্ষমতা, সেক্সচুয়াল ডিজায়ার, ব্রেকআপ, মোর দ্যান ব্রেকআপ, আবার পুরুষকে নিয়ে খেলা, সবই সরোজিনী করে নিজের খেয়াল খুশি মত। যেন সরোজিনী নিজেই একটা নিউ হিস্ট্রি অব সিভিলাইজেশান।

ব্রোকেন ফ্যামিলির বাবা ও মায়ের লম্পট চরিত্রের মত সরোজিনীও একসময় নিজেকে নিয়ে সেই চিরায়ত খেলায় মেতে ওঠে। জীবনের নন্দনতত্ত্বের খেলায় সরোজিনী হারতে চায় না। বারবার বিজয়ী হতে গিয়েই সরোজিনী যেন ফাঁদে পা দেয়। শেষপর্যন্ত সকল তামাশা শেষে কুম্ভকর্ণের মত এক ছাপোষা মৎস্য অফিসার নিখিলেশের সাথেই পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায় সরোজিনী।
--------------------------------------
উপন্যাস পাঠের পর প্রথম প্রতিক্রিয়া
সরোজিনীর ড্রয়িং।। ধ্রুব এষ।। উপন্যাস।। প্রচ্ছদ: শিল্পী সব্যসাচী হাজরা।। প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ।। মূল্য: ১৫০ টাকা
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২০ ভোর ৫:৩৬
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×