যুক্তরাজ্যভিত্তিক গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার এন্টি-করাপশন সেন্টার (জিআইএসিসি) বিশ্বজুড়ে অবকাঠামো খাতে কী করে দুর্নীতি হয় এবং কী করে সেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে কাজ করছে| সংস্থাটির ওয়েবসাইটে (http://www.giaccentre.org) এ সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে|
অবকাঠামো খাতে ৬টি পর্যায়ে দুর্নীতি ঘটে থাকে| এগুলো হলো:
•প্রকল্প নির্বাচনের সময়
•প্রকল্পের অর্থায়নের সময়
•পরিকল্পনা এবং ডিজাইন প্রস্তুতের সময়
•প্রাকযোগ্যতা এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ার সময়
•প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়
•পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষনের সময়|
এই ৬টি পর্যায়ের ক্ষেত্রেই দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার বিভিন্ন ধাপের বর্ণনা পাওয়া যায় ওয়েবসাইটটিতে| আর এই দুর্নীতি ঘটনাগুলো কি করে ধামাচাপা দেয়া হয়, সে সবেরও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ওয়েবসাইটটিতে|
এছাড়া অবকাঠামো খাতে সার্বিকভাবে ঘুষ, চাঁদাবাজি, প্রতারণাসহ বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির ৪৭টি উদাহরণ দেয়া হয়েছে|
যারা অবকাঠামো খাতের দুর্নীতিতে যুক্ত তারা দু’কারণে দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দেয়| প্রথমত: যেন ধরা না পড়ে এবং শাস্তি কি করে এড়ানো যায়| দ্বিতীয়ত: যে কারণে দুর্নীতি করা হয়েছে সেই অভিষ্ট লক্ষ্য যেন অর্জিত হয়| যেমন:
•কাজ পাওয়ার জন্য যে ঘুষ দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই গোপন রাখতে হবে, নয়তো কার্যাদেশ বাতিল হবে|
•দাম বাড়িয়ে কাজ বাগাতে যে ঘুষ দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই গোপন রাখতে হবে, নইলে চুক্তি বাতিল হবে|
•পরিকল্পনার অনুমোদন নিতে যে ঘুষ দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই গোপন রাখতে হবে নইলে অনুমোদনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হবে|
সাধারণত, বেশ কয়েকটি কৌশল ব্যবহার করে দুর্নীতির ঘটনা লুকানো হয়| অবকাঠামো খাতের ঘুষের লেনদেন হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যেন ঘুষের ঘটনা অনুদঘাটিত থাকে| এই পন্থায় কাজগুলো করা হয় এভাবে:
যে কোম্পানী ঘুষের বিনিময়ে কাজ পেতে চায় সে একজন এজেন্ট নিয়োগ করে এবং সেই এজেন্ট প্রকল্পের মূল মালিকের সাথে যোগাযোগ করে| কাজটি সরকারি পর্যায়ে হলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করে| মূল কোম্পানী উক্ত এজেন্টের সাথে বৈধ সার্ভিস গ্রহণে এক চুক্তি করে| তবে এই বৈধ সার্ভিস বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভূয়া বা অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে এবং এই ধরণের কাজে যে পরিমাণে বাজারমূল্য থাকে, তারচেয়ে উচ্চহারে অর্থ দেয়া হয়| কোম্পানীটি কাজ পাবে এই শর্তে এজেন্টকে অর্থ প্রদান করে| এই টাকার পুরোটা বা আংশিক অর্থ তখন প্রকল্প মালিকের প্রতিনিধি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যিনি কাজ পাইয়ে দেবেন বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন তার হাতে তুলে দেয়া হয়| সাধারণত: অফ-শোর ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় এ ধরণের লেনদেন হয়|
এছাড়া জয়েন্ট ভেঞ্চার, সাবসিডিয়ারী, সাব-কন্ট্রাকটিংয়ের মাধ্যমেও ঘুষের লেনদেন হয় সকল পক্ষের পূর্ণসম্মতিতে| তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষের অগোচরেও ঘুষের লেনদেন হতে পারে| এছাড়া ঘুষ বা প্রতারণার ক্ষেত্রে জাল দলিলের এবং মিথ্যা বিবৃতির ব্যবহার খুবই সাধারণ ঘটনা|
অবকাঠামো প্রকল্পের দুর্নীতি ঠেকাতে প্রজেক্ট এন্টি করাপশন সিস্টেম (PACS) নামে একটি টুলকিট রয়েছে যেখানে ১২টি করণীয় এবং ১০টি টেমপ্লেট পাওয়া যাবে| এছাড়া অবকাঠামো খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের করণীয় ১৫টি কাজের তালিকা রয়েছে| এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
১.দুর্নীতির সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দেয়া
২.মানহানির ব্যাপারে সতর্ক থাকা
৩.কাউকে বিপদগ্রস্ত না করা
৪.প্রমাণাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা
৫.বিষয়টি প্রচার করা
৬.প্রকল্পের স্বতন্ত্র মনিটরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের তথ্য জানানো
৭.থানা এবং স্থানীয়/জাতীয় কর্তৃপক্ষকে (দুদক) জানানো
৮.বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে জানানো
৯.দুর্নীতিবিরোধী এনজিওকে জানানো এবং
১০.নির্মাণ কাজ বন্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া|
পদ্মাসেতুকে ঘিরে যে অনাকাঙ্খিত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে তা থেকে আমাদের সবারই কিছু না কিছু শেখার আছে| তার সূত্র ধরেই এই লেখার প্রয়াস|