এই মেয়েটি আগে আমদের বাড়িতে ফুল কুড়োতে আসত। কতবার আমি বারণ করেছিলাম, ফুল না ছিঁড়তে ফুল গাছেই সুন্দর। কিন্তু সে শুনত না। তার নাকি ফুল ভাল লাগে। দিনের প্রায় অর্ধেক সময়ই সে আমাদের বাড়িতে থাকত। আমার মা মাঝে মাঝে তাকে বলত, আর কত এমন ফুল কুড়োবি রে জবা? বড় তো হলি।
সে কিছু বলে না। হাসে। এত সুন্দর হাসি আমি কখনও দেখিনি।
আমার জানালার পাশেই একটি জবা ফুল গাছ। টকটকে লাল সেই গাছের ফুল গুলো। দেখতে খুব ভাল লাগে। কোথা থেকে এসে সে হঠাৎ ফুল ছিড়তে শুরু করল। আমি নিষেধ করলাম, ওগুলো ছিড়িস না।
জবা ছিড়তে ছিড়তেই বলল, কেনো?
-আমি জবা ফুল পছন্দ করি।
-সত্যি?
-হ্যা।
-আমার ও খুব পছন্দের।
হঠাৎ সে আমার জানালার কাছে এসে আমায় ডাকল, দাদা?
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সে আমার দিকে একটি জবা ফুল ধরে আছে।
আমি নিলাম। সে বলল, এটা সারাজীবন রাখবে?
আমি হাসলাম। বললাম, ফুল সারাজীবন রাখার কি দরকার? নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দেব।
-সত্যি রাখবেনা?
আমি কিছু বললাম না। সে আবার বলল, আমি দিয়েছি তাই রাখবে।
আমি দুষ্টুমি করে বললাম, তুই এমন কে যে আমায় ফুল দিলে সেটা রাখতে হবে?
আমি মাথা নিচু করে একটা কিছু করছিলাম। মাথা তুলে আবার কিছু বলতে যাব, কিন্তু হায় একি দেখলাম! জবা কাঁদছে। আমি কিছু বলার আগেই সে এক দৌড়ে চলে যেতে চাইল। পেছন থেকে অনেক বার ডাকার পর সে এসে বলল, আমি আর কোনোদিন তোমাদের বাড়িতে আসব না।
আমি হাসলাম, সত্যিই আসবি না?
-উহু।
আমি ভাবলাম জবা এমনিতেই এসব বলছে। কিন্তু কষ্ট পেতে থাকলাম তখন থেকে যখন জবা সত্যিই আর আমাদের বাড়িতে আসেনি ফুল কুড়োতে। নিজেকেই অপরাধী মনে হতে লাগল। মা ও মাঝে মাঝে জবার কথা বলে, কেনো মেয়েটা আজকাল আসে না কে জানে!
আমার আর দিন কাটতে চায় না। এর মাঝেই আমার ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা চলে আসল। জবার চিন্তা মাথায় রেখেই সব পরিক্ষা দিয়ে গেলাম। এক এক সময় ইচ্ছে হয় জবাদের বাড়িতে চলে যাই, কিন্তু যাওয়া হয় না।
একসময় আমি জবার কথা ভুলে, নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিভাবে মধ্যবিত্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসা যায় তার স্বপ্ন দেখতাম। ঠিক যে ভুলতে পেরেছি তা না। সবসময় ভোলার চেষ্টায় থাকতাম।
আজ অনেকদিন পরে জবাকে দেখে আবার সব কথা মনে পড়ে গেল। কত বড় হয়ে গেছে। মা দেখে বলল, ফুল কুড়োতে আসা জবা এখন আর সেই জবা নেই অনেক বড় হয়ে গেছে, তাই না রে জাবেদ?
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে।
জবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা কেমন আছ?
আমি বললাম, ভাল।
এখন আর তুই করে বলা যাবে না। বললাম, তুমি কেমন আছ?
-ভাল।
এরপর জবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মা বলল, স্বামীর আদর সোহাগ পেয়ে আমাদের একদম ভুলেই গেলি।
জবা লজ্জায় আরেকদিকে তাকিয়ে খুব নিচু স্বরে বলল, উহু একদম ভুলি নি।
-তাহলে এতদিন এলি না কেনো?
জবার যে বিয়ে হয়ে গেছে আমি জানতাম না। শুনে আর সেখানে দাড়াতে না পেরে নিজের ঘরে চলে এলাম, খুব কান্না পেল।
কিছুক্ষণ পরে জবা এসে বলল, ফুলের গাছটা কই?
আমি একটু হেসে বললাম, কেটে ফেলেছি।
অনেকক্ষণ কেউ কিছু বললাম না। সম্পর্ক গুলো কত সহজে বদলে যায়। যার সাথে একসময় তুই করে খুব খোলামেলা কথা বলতে পারতাম সেই তার সাথেই এখন কথা বলতে কত জড়তা এসে যাচ্ছে। একসময় জবা বলল, ফুলটা আছে?
জবা যে ফুলটার কথা মনে রাখবে এবং তা জিজ্ঞেসও করবে আমার তা মনেই ছিল না। আমি না জানার ভাণ করে বললাম, কোনটা?
-আমি যেটা দিয়েছিলাম।
আমি আমার ড্রয়ার খুলে কিছু বই খাতা ঘেটে ফুলটা বের করে আনলাম, আছে তো দেখছি।
-তুমি না বলেছিলে রাখবেনা?
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, রাখিনি। কিভাবে রয়ে গেল কে জানে!
সারাদিন জবা আমাদের বাড়িতে থাকল। আগের সেই চঞ্চলতা এখন আর তার মাঝে নেই। থাকলে হয়ত ভাল দেখাত না। শান্ত থাকাই মেয়েদের মানায়। বিকেলে যখন জবা চলে যাবে আমার কাছে এসে বলল, দাদা আমি চলে যাচ্ছি।
আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম। কি বলব আর কিভাবেই বা বলব ভেবে পাচ্ছি না। জবা আর একটু কাছে এসে বলল, যাই দাদা, ভাল থেকো।
আমি বললাম, আচ্ছা। ভাল থেকো।
এরপরও জবা গেল না। চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। একসময় কাছে এসে জবা আমার হাতটা ধরে ফেলল। আমি হাত সরালাম না। সে হাত ধরে রেখেই কেঁদে উঠে বলল, দাদা, খুব কষ্টে হচ্ছে।
আমি নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম। জবা উঠে চোখ মুছে বলল, যাই।
জবা চলে যাওয়ার পরেই আমার বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। চলে যাচ্ছে সে কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। এ আমার কেমন ভালবাসা, কখনও বলা হয়নি। না এটা ভালবাসা নয়, হতে পারে না।
এসব ভেবে আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম। মনে হল জীবনের সব কান্না এক সাথে বেরিয়ে আসল। সবার জীবনেই বোধহয় জবার মত কেউ একজন থাকে, যেই জবা জাবেদের ভালবাসার কথা কখনই জানতে পারেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৯:১১