শওকত ওসমান বাংলাদেশেরই কথাশিল্পী। আবার তাকে পশ্চিমবঙ্গের লেখকও বলা যায়। শওকত ওসমানের দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস নেই। সবসময় তিনি চেষ্টা করে এসেছেন মুসলমানের আজান ধ্বনি ও হিন্দুদের উলুধ্বনির মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সেটা মুছে ফেলতে। এটাই তার জীবনের আদর্শ। যদিও তার সাহিত্যে, উপন্যাস ও ছোটগল্প গুলোতে এই আদর্শ সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। তার জননী উপন্যাস ও পিঁজরাপোলের গল্পগুলো যারা পড়েছেন তারাই জানেন তিনি ক্ষমতাশালী গদ্য লেখক বটে কিন্তু কবি নন। যদিও কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা তিনি কম করেননি। কবিতা যার কৈশোর ও যৌবনে হয় না অর্থাৎ সতেরো বছরে যার হয় না সত্তর বছরেও তার হয় না। শতকত ওসমানেরও হয়নি। এখন তার বয়েস সত্তরের ওপর কিন্তু কবিতা লেখার সেই বালসুলভ অভ্যেস তার যায়নি। এখনও তিনি ব্যর্থ কবিদের মত ব্যঙ্গ কবিতার চর্চা করে চলেছেন। তার ব্যক্ত কবিতার টার্গেট হলো ইসলামী শরিয়াহকে ব্যঙ্গ করা। মুসলিম কালচারকে আক্রমণ। যা কিছু বাংলাদেশের মুসলমানদের সাংস্কৃতিকভাবে উৎফুল্ল করে এর ওপরই কাদা ছুড়ে দেয়া।
শওকত ওসমান সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে জন্মেছিলেন। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন। সাহিত্যিক জীবনে কলকাতায় তার বন্ধু ছিলেন গোলাম কুদ্দুস, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসানের মতো কবিরা। আহসান হাবীবও সম্ভবত এ দলে পড়েন। গোলাম কুদ্দুস সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। শওকত ওসমান ধুরন্ধর লোক। তিনি প্রগতিবাদের প্রবক্তা হলেও কমিউনিস্ট পার্টির ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
ফররুখ আহমদরা দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হয়ে গেলে তারা কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব এদের সকলেই জন্মগ্রাম ছিল যশোর, মাগুরায় কিংবা বরিশালে। কিন্তু শওকত ওসমান পশ্চিমমঙ্গেরই মানুষ। হুগলির লোক। তিনি দেশভাগের পক্ষে ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। এহেন শওকত ওসমান তার নিজের জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চিরশোষিত মুসলিম চাষীদের দেশ তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসে হাজির হলেন। অথচ এই কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যার দাপট ও প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি সেই গোলাম কুদ্দুস কেবল আদর্শের টানে কলকাতায় তেকে গেলেন। এতবড় প্রতিভাবান কবি হওয়া সত্ত্বেও গোলাম কুদ্দুসের নামগন্ধটুকুও মুছে গেল। আর যাদের প্রতিভার চিহ্ন একেবারে ধুয়ে মুছে যায়নি যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী, তারা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ভাঁড়ে পরিণত হলেন। বাকী জীবন ভাঁড়ামী করেই কাটাবেন ভেবে শান্তিনিকেতনে এক মর্যাদাহীন অবস্থায় বার্ধক্য যাপন করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞায়ও স্থির থাকতে পারেননি। বাংলাদেশে এসে কবরের মাটিও পেয়েছেন।
কিন্তু শওকত ওসমান খুবই চালাক। তিনি জানতেন পশ্চিমবঙ্গে তার মত শওকত ওসমানের এক পয়সারও সাহিত্যিক মর্যাদা থাকবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানে তার মত ধুরন্ধররা লুটেপুটে খেতে পারবে। চাই কি প্রগতিবাদী সেজে সব এলাকা থেকেই কল্কে টেনে নেয়া যাবে।
বৈষয়িক সার্থকতা যাকে বলে শওকত ওসমান তা পুরোপুরিই উপভোগ করেছেন। অথচ গোলাম কুদ্দুসের নামও পশ্চিমবঙ্গের কবিদের তালিকায় রাখা হয়নি। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের এবং কলকাতা মহানগীরতে কোনো মুসলমান কবি জন্মাতে দেয়া হয়নি। শওকত ওসমান এ দেশে যে পেশায় নিযুক্ত থেকে ঘরবাড়ীসহ কিছু বৈষয়িক স্থায়িত্ব অর্জন করেছেন, কলকাতায় ঐ পেশায় কোনো মুসলমান খুঁজে পাওয়া যাবে কি? পাওয়া গেলেও দেখা যাবে তার সংসাদের অর্ধাংশ হিন্দুত্বে পর্যবসিত হয়েছে। অর্থাৎ তার সহধর্মিনী হিন্দু। বউ হিন্দু বলেই লোকটা এখানে সেখানে কিছু পাত্তা পায়। তবে এর বিনিময়ে ইসলামকে নেংটা হয়ে গালমন্দ করতে হয় যেখানে সেখানে। এখন যেমন ঢাকায় শওকত ওসমান করেছেন।
শওকত ওসমান পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির প্রবক্তা ছিলেন। এর জন্য কম ফায়দা লুটেননি। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তখন দালাল ও কমিউনিস্ট লেখকদের পাকিস্তানী পুঁজিপতি দাউদ-ইস্পাহানীদের টাকায় রাইটার্স গিল্ড বলে যে চক্রটি গড়ে উঠেছিল শওকত ওসমানকে আমরা কি সেখানে ঘন ঘন যাতায়াত করতে দেখিনি? উলুধ্বনি ও আজান যে একই জিনিস নয় একথা শওকত ওসমানের জানা।
শওকত ওসমান এককালে মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। মাদ্রাসায় শিক্ষকতাও করেছেন। কিন্তু মানুষের ঈমান পড়ে গেলে কি দশা হয় শওকত ওসমানই এর উদাহরণ। শওকত ওসমান ইসলাম মানেন না। ইসলামও কি তাকে গুতাচ্ছে? কেন তিনি যত্রতত্র ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ছড়াবেন? ইচ্ছা করলে তো তিনি এখনও তার সাধের কলকাতায় জাস্টিস মাসুদের বারান্দা বা করিডোরে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন। যানা না কেন?
একবার অবশ্য গিয়েছিলেন। দেশের একটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি বলা নেই কওয়া নেই কলকাতায় পালিয়ে গেলেন। কেউ জানল না কেউ বুঝল না বাংলাদেশের স্বনামধন্য কথাশিল্পী এভাবে বর্ডার ক্রস করে জাস্টিস মাসুদের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। এ সময় আনন্দবাজারের কাগজপত্রে তার কিছু লেখা দেখেছি। সবি অখাদ্য লেখা। মুসলমানদের এবং বাংলাদেশের নিন্দামন্দে ভরা। সে সময় শওকত ওসমানের কলকাতার জীবন নিশ্চয়ই খুব দুঃসহ হয়ে পড়েছিল। তিনিও দেশে ফিরে আসার জন্য একে ওকে ধরাধরি করছিলেন। ওদিকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কাগজেও তার অখাদ্য লেখা ছাপা নিয়ে কলকাতার লেখদের মধ্যে দারুণ গুঞ্জন।
এ সময় কলকাতার বইমেলায় এই নিবন্ধকারের উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সিপিআই এর পত্রিকা 'পরিচয়' এর সম্পাদক অমিতাভ দাশ গুপ্ত আমাকে বলেছিলেন, তোমরা এই শওকত ওসমানকে কেন ফেলে রেখেছো? তার এখনকার লেখাপত্র তো কিছু হয় না। আমি খুবই অপমানিত বোধ করলাম।
জিয়াউর রহমানকে বলে একে এখান থেকে নিয়ে যাও। অযথা কেন এখানে ফেলে রেখেছো। তার বেশী কথা বলার বাতিক। পত্রিকা অভিসগুলোতে ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরে বেড়ায় আর বাজে মন্তব্য করে। ওর কথা শুনলে আমাদেরই লজ্জা বোধ হয়।
আমি আমার কাজের ফাঁকে শওকত ওসমানকে খুব খুঁজছিলাম। পাইনি।
খুঁজুছিলাম একথা বলতে যে, আমার সাথে ঢাকায় চলুন। কেউ আপনাকে কিছু বলবে না।
শওকত ভাই কি মাঝেমধ্যে পাগল হয়ে যান? কেন তার মুসলমানদের ধর্মকর্মে খুৎ ধরার এই বদ অভ্যেস? আজান ও উলুধ্বনি যে এক জিনিস নয়, দু'টি বিপরীতমুখী বিশ্বাসেরই প্রকাশ একথা বোঝার মত জ্ঞানবুদ্ধি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, এটা কি করে মানা যায়? তিনি বলেছেন, তার এই তথাকথিত ব্যাখ্যা অর্থাৎ আজান ও উলুধ্বনি এ দুয়ের গন্তব্য নয়কো আলাদা। তার ব্যাখ্যা না মানলে আমরা সকলেই নাকি মূর্খমূর্খী।
শওকত ওসমান একজন জ্ঞানপাপী মানুষ। তিনি প্রথম জীবনে মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত ছিলেন। হুগলি জেলার মানুষ হওয়ার দু'টি ধর্মের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস সম্বন্ধে আরও ধিক জানার কথা। তবুও তিনি মুসলমানওদের সারা জীবন ব্যঙ্গ করে চলেছেন। আমরা তার এসব কাজকর্মের নিন্দা করি এবং এসব অপকর্ম থেকে নিবৃত হতে বলি। প্রশ্ন হতে পারে, শওকত ওসমানের ফাজলেমি নিয়ে কেন আমরা মাথা ঘামাচ্ছি? মাথা ঘামাচ্ছি তার মত একজন উচ্ছাংগের কথাশিল্পীর পাগলামী আমরা দেখতে চাই না। তিনি কি জানেন না এতকিছু করেও তার বন্ধু গোলাম কুদ্দুসের কি পরিণাম হয়েছে?
শওকত ভাই যদি দেশ ভাগের সাথে সাথে এ দেশে না আসতেন তাহলে তার পরিণতি গোলাম কুদ্দুসের চেয়েও মর্মান্তিক হত।
আমাদের খারাপ লাগে আমাদের একজন প্রধান কথাশিল্পী যিনি জননী, কৃতদাসের হাসি ও পিঁজরাপুলে গল্পগুলো লিখেছেন। লিখেছেন জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প, তিনি নতুন প্রজন্মের চোখে ভাঁড় হিসেবে বিবেচিত হোন এটা আমরা চাই না। শওকত ওসমান ইসলামের প্রতি বিশ্বাসী না হতে পারেন। কিন্তু তার রচনায় ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায়ানুগ জীবনের অনেক খন্ডচিত্র আমরা দেখতে পাই। এমন একজন লেখক যদি ভাঁড়ামির পথ পরিহার করে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে লড়াই করে এতদূর এগিয়ে আসার কাহিনী বর্ণনা করে একটি বই লিখতেন, এ বয়েসে তাহলে কতই না ভালো হতো!
২৯/১১/৯৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






