আমি এমন একজনকে চিনি যার ছোটবেলা থেকেই বাবা ছিল না, মা ছিলেন কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। এলাকার লোকে উনার মাকে পাগলী বলে ডাকতো। কথিত আছে, ছোটবেলায় একদিন উনার মা নাকি উনাকে কোল থেকে ছুড়ে মেরেছিলেন। লোকেরা বলে মাথা নাকি দু'খণ্ড হয়ে গিয়েছিল। মাথা দুখণ্ড হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কতটুকু সত্য এ ব্যাপারে আমি সন্দিহান, কিন্তু ছুড়ে যে মেরেছিল এবং কিছু একটা যে হয়েছিল এটা নিশ্চিত। কিছু না ঘটলে কিছু রটে না। পরবর্তিতে উনার মা উনাকে উনার মামাদের কাছে রেখে ঢাকা চলে যান। ঢাকায় গিয়ে মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করতো। উনি অনেক কষ্টে মামার বাড়িতে থেকে জীবনধারণ করেছেন। পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রচন্ড আগ্রহ, নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছেন। শোনা যায়, কেরোসিন কেনার টাকা ছিল না বলে মাটির চুলোয় ভাত রান্না করার সময় সেই আগুনের আলোতে যেমন পড়েছেন, তেমনি অনেক সময় চাঁদের আলোতেও পড়েছেন। কতটা কষ্টকর অবস্থা হলে এভাবে পড়তে হয় ভাবা যায়? মজার বিষয় হলো আমি এবং আমার বোন (চাচাতো বোন) দুজনেই উনার কাছে বেশ কিছুদিন পড়েছিলাম প্রাইমারি স্কুলে থাকতে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে আমি কতটা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি সেই মানুষটাকে। সত্যিই সেই মানুষটার জীবনে অনেক কষ্ট ছিল, অনেক বাধা ছিল। কিন্তু মানুষটা চরম ইচ্ছা শক্তির বলে সকল বাধাকেই অতিক্রম করেছেন। এগিয়ে গেছেন অনেকদূর। এখন সেই মানুষটা রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রফেসর।
আমি আরেকজনের গল্প জানি যে বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া সত্ত্বেও তার ছিল না কোনো কম্পিউটার। কেনার সামর্থ ছিল না যে, কিভাবে কিনবে? কিন্তু সে থেমে থাকেনি। সে আশেপাশের একটা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে সেই ক্যাফের কম্পিউটারগুলো যখন খালি পড়ে থাকবে তখন ব্যবহার করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে রাজী করিয়েছিলেন। তারপর সে অপেক্ষায় থাকতো কখন খালি হয় এবং খালি হলেই গিয়ে প্র্যাকটিস করতো। আজ সে খুব বড় মাপের একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিয়ার রহমানের কাহিনী কারো অজানা নয়। যদিও উনি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক সমালোচিত, কিন্তু রাখাল বালক থেকে একটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়াটা কম কিছু নয়। এরকম উদাহরণ আমাদের আশাপাশেই অনেক আছে। একটু চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পারি। আর ইতিহাসে দেখলেতো এরকম উদাহরণের অভাব নেই। বর্তমান বিশ্বের বড় বড় অবস্থানে থাকা, হোক ক্ষমতার দিক দিয়ে কিংবা অর্থের দিক দিয়ে, তারা সবাই একসময় খুব কঠিন কষ্টের জীবন যাপন করেছেন। বেশিরভাগেরই মৌলিক চাহিদাটুকুও পূরণ হতো না ঠিকমত। তারপরেও তো তারা আজ এতদূর, যতদূরটা এখনো আমাদের কাছে কল্পনাই কেবল। তাদের কাছে সেসব সম্ভব হয়েছিল কেবল ইচ্ছাশক্তির জোরে। এই ইচ্ছাশক্তি সেই ইচ্ছাশক্তি, যে ইচ্ছাশক্তি তাদের মনে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছিল, ধৈর্য ধারণ করিয়েছিল, দিয়েছিল এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা, বাধাকে বাধা মনে করতে দেয়নি। তবে আপনি কেন নানা অজুহাতে থেমে আছেন? আপনার এটা করার জন্য ওটা নেই, ওটা করার জন্য এটা নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি কেবলই অজুহাত। যতদিন এই অজুহাতের গন্ডি থেকে বেরুতে না পারবেন, ততদিন সফলতার মুখও দেখবেন না। অজুহাত অপারগতার আরেক নাম। আর সফলতা কিংবা সুখ কখনো দুঃখ ছাড়া অর্জন করা যায় না। সফলতা আর সুখের দেখা পেতে হলে আপনাকে দুঃখ করতেই হবে। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের দুটি লাইন খুব মনে পড়ছে-
"কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?"
লেখাটি শেষ করার আগে আরো কয়েকটি লাইন যোগ করছি। কোনো বাধাই বাধা না, যদি না আপনি তাকে বাধা ভাবেন। প্রতিটা বাধাকে একেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেই তখন আর সেটিকে বাধা মনে হবে না।
সব সময় মনে রাখবেন, "বাধা ততক্ষণ পর্যন্তই বাধা, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি তা ভাবেন।"
লিখায়: রিহানুর ইসলাম প্রতীক
ফেসবুক আইডি : Rihanoor Protik
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




