somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-১১

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুঠোফোন বেজেই যাচ্ছে। আগের দিনের এ্যানালগ ফোনের ক্রিং ক্রিং সুরে। মনে হচ্ছে ওপাশ থেকে কেউ আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম্বার চাপছে। এমন প্রাগৈতিহাসিক রিং টোন দিয়ে রাখার অপরাধে আমি লতার হয়ে ফোনটা ধরলাম না। তাছাড়া, মনে হচ্ছে ফোনের ভেতর ঝামেলা আছে। আজকে এমনিতেই অনেক বিপদ-আপদ গেছে। এখন ফোন ধরে খাল কেটে আর কুমির না আনলেও চলবে। ভাল লাগছে না।

লতার জন্যে ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু দুশ্চিন্তাটা কমেছে আগের চেয়ে। সেখানে এসে হানা দিয়েছে প্রচন্ড খিদে আর ক্লান্তি। এরা এক সাথে সিন্দাবাদের ভুতের মত কাঁধে জেঁকে বসেছে। বাসায় গিয়ে একটা হট শাওয়ার নিয়ে একটা ডিম ভেজে আর এক গ্লাস দুধ গিলে ঘুমিয়ে থাকব। এছাড়া কিছু নেইও ঘরে। তাতে কিছু আসে যায় না। ডিম-দুধই খেয়ে নিবো হালুম করে। তারপর ফোস ফোস ঘুম। মাঝে মাঝে না ডাকা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে পাশের ঘর থেকে ভ্লাদিমির ঠক্ঠক্ করে পলকা দেয়ালে আপত্তির টোকা দেয়। আমি বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে পাশ ফিরে বালিশ কানে চেপে বিপুল বিক্রমে নাক ডাকা চালিয়ে যেতে থাকি। ভ্লাদিমির কোন ছাড়, স্বয়ং ভ্লাদিমির পুতিনও আমাকে জ্বালিয়ে সুবিধা করতে পারবে না। কোথায় রক্ত গরম রয়েল বেঙ্গল আর কোথায় রাশিয়ার হোৎকা সাইবেরিয়ান টাইগার! তুলনাই চলে না।

এই হাসপাতাল খুব পুরানো। কারুকাজ করা অনেক উঁচু ছাদ আর সাবেকি আমলের কাঠের মেঝে। রাজবাড়ি রাজবাড়ি গাম্ভীর্য আছে। সিড়ি ভেঙ্গে নামছি আর মচ্মচ্ করে শব্দ হচ্ছে। প্রায় সদর দরজার কাছে চলে এসেছি। ধাক্কা লাগল কারো সাথে। অন্যমনষ্ক ছিলাম হয় তো। ভালো করে চোখ তুলে তাকাতে দেখি এক তরুনী হাতের ফোনটায় ডুবে এলোমেলো হাঁটছে। আমি দুঃখিত বলতে যাবার আগেই পকেটে লতার ফোন আবার বেজে উঠল। সামনের মেয়েটাও দেখি ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোনটা কানে ধরল। ধাঁধায় পড়ে গেলাম। এই মেয়েটাই ফোন করছে না তো? লতার বন্ধু হয়তো। আবার এক হাতে ধরা সাদা এ্যাপ্রনটা বলে দিল যে সে এই হাসপাতালেরই ডাক্তার কিংবা নার্স। তফাৎটা ঠিক বুঝতে পারি না আমি। যাক, অতি চিন্তা করে লাভ নেই। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আগস্টে হীরের কুঁচি ছড়ানো রাতের আকাশে সুকান্তের চাঁদ উঠেছে। সেই আলোয় অতিপ্রাকৃত লাগছে চারপাশ। রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। বাস-ট্রামের আশা না করে হেঁটেই যাবো ভাবছি। মিনিট বিশ-পঁচিশেক লাগবে বড় জোর। ব্যাপার না।

বাঁধ সাধল লতার অস্থির ফোন। বেজেই চলছে আর বেজেই চলছে। ফোন হাতে নিয়ে ইতস্তত করছি। ধরতে যাব, অমনি রিং থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই ভেসে উঠল ক্ষুদে বার্তা, “লতা, কই তুমি? আমি ডিউটিতে। শিগগির কল দাও। প্লিজ, প্লিজ।-লিওনি“ তাহলে তখন দরজার কাছে ধাক্কা লাগল যে, সেই কি এই লিওনি? ডাক্তার কলিগ কিংবা বন্ধু? লতার দুর্ঘটনার খবর কি তার বন্ধু জানে? নাকি নতুন কোন অঘটনের খবর জানাতে লতাকে খুঁজছে মেয়েটা? হাঁটতে থাকা মানুষ যেমন কেউ নিঃশব্দে পিছু নিলে ঠিকই টের পেয়ে যায়, তেমন সতর্ক হয়ে গেলাম। তারপর লিওনি নামের ওপর আংগুল টিপে অপেক্ষায় থাকলাম। আর কখন যে উল্টা ঘুরে আবার হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম, বলতে পারব না। ।

লিওনি লতার বদলে আমার গলা শুনে ভড়কে গেল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভড়কে যাওয়াটা সন্দেহের তীর হয়ে দাঁড়ানোর আগেই আমি খুব দ্রুত আর খুব সংক্ষেপে বলে গেলাম লতার পড়ে গিয়ে আঘাত পাবার কাহিনী। কিছুটা অবাকই হলাম লিওনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই বাধ্য ছাত্রের মত কথাগুলো শুনে গেল। কিন্তু তারপর যখন অনুরোধ করল, আমি যদি খুব বেশি দূর চলে গিয়ে না থাকি, তাহলে এখনই তার সাথে হাসপাতালের সামনে দেখা করতে পারব কিনা-তখন আমার অবাক হবার পালা। এমন কি জরুরী কথা থাকতে পারে? এখন ঘড়িতে বাজে রাত একটার কাছাকাছি।

মিনিট দশেকের পরের দৃশ্য এরকমঃ লিওনি আর আমি হাসপাতালের ভেতরের বিশাল বাগানটায় পাশাপাশি একটা বেঞ্চে বসে আছি। লিওনি লতার প্রায় শূন্য সংখ্যক বন্ধুবান্ধবের একজন। সে একটু আগে যে খবরটা আমাকে জানালো সেটা লতাকে কি করে জানাবো, তাই ভাবছি দু’জন মিলে। কেমন অবশ আর বিমূঢ় লাগছে। আজকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লতার বাবা ফ্রেডরিখ স্নাইডার মারা গেছেন। মাত্রই অবসরে যাওয়া লতার বাবা প্রতিদিনের মত টেনিস কোর্ট থেকে সাইক্লিং করে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে বিশাল এক ট্রাক তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। কাহিনীর আরেকটা অদ্ভূত অংশ আছে। একটা কুকুর কোথা থেকে ছুটে এসে তার সাইকেলের সামনে পড়াতে ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ডের জন্যে সাইকেলের সরু রাস্তা ছেড়ে বাম পাশের গাড়ির রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। আর তাতেই...। লতা আর তার বাবার ঘটনার ভেতর এত মিল কেন? এর ব্যাখ্যা কি? তাছাড়া লতাকে কালকে কিভাবে খবরটা জানাবো? লিওনিকে অনুরোধ করে বললাম, এই কথা লতাকে তারই জানানো উচিত। কিন্তু আমি থাকব সেখানে। সকাল সাতটায় আমি চলে আসব। উঠে দাঁড়ালাম বাসার ফিরব বলে। লিওনির নাইট ডিউটি আছে। এত বড় দুঃসংবাদ চেপে কাজ করে যাওয়া তার জন্যেও কঠিন।

বিক্ষিপ্তভাবে পা চালাতে চালাতে ভাবছি, দেয়ার আর মেনি থিঙ্কস বিটুইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। দৃশ্যের চেয়ে অদৃশ্যের প্রভাবই বেশি। শেক্সপিয়ারের কথা। আজকের ঘটনা দুটো আমি মেলাতে পারছি না কিছুতেই। দুটো দূর্ঘটনা। দুই শহর। দুই সময়ে ঘটা। অথচ কি মারাত্মক অন্ত্যমিল। হাঁটছি আর ভাবছি। ভাবছি আর হাঁটছি। এক চাঁদের আলো ছাড়া রাস্তায় আর কেউ নেই। কেমন শিউড়ে উঠলাম।

(চলবে), ২৭.১১.১৮
--ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকারঃ মিউনিখ, জার্মানি


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হত্যাকাণ্ড বন্ধে কেন ম্যাজিক জানা জরুরি ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৪৪


জাতি হিসাবে আমরা বড়োই অভাগা। ইতিহাসের মঞ্চে রাজা বদল হয়, কিন্তু চিত্রনাট্য বদল হয় না। এক রাজা যায়, আরেক রাজা আসে; কিন্তু পর্দার পেছনের কলকাঠি নাড়া সেই একই হাত।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডোডোরা আমার পোষ্টে এসে আমাকে ভৎসনা করেন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৬



ব্লগ এখন নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে ১/২টা পোষ্ট আসে, মৃতের মতো পড়ে থাকে, সামনের পাতা থেকে পেছনে পাতায় যায় না। তবে, আমার পোষ্টগুলো সেইদিক থেকে কিছুটা সুখী,... ...বাকিটুকু পড়ুন

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০১

৪–৫ আগস্ট : রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়া রাত ও দিন

৪ আগস্ট রাত — আশ্বাসের আড়ালে ছদ্ম-অভ্যুত্থানের নীরব নকশা
৪ আগস্ট সন্ধ্যায় কোটা-আন্দোলনের বিশৃঙ্খলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যখন রাষ্ট্রজুড়ে উত্তেজনা,... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

=চলো দেখি সূর্য উদয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫০


শীত কুয়াশা ফুটো করে,
সূর্য যখন উঠে নীলে
দেয় ছড়িয়ে সোনা আলো,
দেখলে মনে শান্তি মিলে।

একটি সকাল ফের পেয়ে যাই
নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচি সুখে,
পাই প্রেরণা সূর্যের কাছে
আলোর শক্তি তুলি বুকে।

দেখবে নাকি আমার সাথে
রোজ বিহানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×