১.
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাস ধরলাম। সোনালি মোচওয়ালা ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে। ‘এই বাদামী ছেলে-মেয়েগুলোর কোন সময়জ্ঞান নেই, ধুর!’ তার মনের ভাব কপালের ভাঁজে অতি স্পষ্ট। অথচ সকাল আটটা বাজতে আরো মিনিট পাঁচেক বাকি। ঘড়িবিহীন কব্জিটা কায়দা করে তাই যেন বোঝাতে চাইলাম। অনিচ্ছায় হার মেনে ভদ্রলোক মোচে একটা তিনশো ষাট ডিগ্রি মোচড় মেরে আমার ছোট লাল স্যুটকেসটা বাসের পেটে ঢুকিয়ে দিল। বিরক্তিটা আরো চাগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমি কি এক ছুটে গিয়ে অফিস থেকে জরুরী একটা জিনিস নিয়ে আসতে পারি? কয়েকগজ দূরের প্যাথলজি ভবনটা দেখে সে এক সেকেন্ড কি ভেবে সায় দিয়ে দিল। আমিও পড়িমরি করে ছুট।
কপাল ভাল, হাঁচড়ে পাচড়ে সিড়ি ভাঙ্গতে হল না। কলিগ পেত্রাকে জানালায় দেখে আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতেই সে অফিসে রাখা পেন ড্রাইভটা এনে ছুড়ে দিল। আনাড়ি হাতে লুফে নিতে ব্যর্থ হয়ে কুড়িয়ে তুলে ভোঁ দৌড়ে বাসের কাছে ফিরে এলাম। আটটা তখনো বেজে সারে নি। যদিও বাস ড্রাইভার সত্যিকারের এক লেট লতিফের অপেক্ষায় দাঁত কিড়মিড়াচ্ছে।
মিউনিখ থেকে অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার আল্পবাখ বলে এক পাহাড়ী গন্তব্যে যাচ্ছি সবাই। সবাই বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার রিসার্চ কন্সোর্টিয়ামের লোকজন। আল্পবাখে আমাদের বার্ষিক সম্মেলন। সেখানে যে যার গবেষনার খতিয়ান দেবে আর কি। এই খতিয়ান তৈরিতে টানা দুই সপ্তাহ দারুন খাটা-খাটুনি গেছে। শেষ মুহূর্তে আরো কিছু যোগ করতে হতে পারে ভেবে পেন ড্রাইভটা নেয়া। তবে সামনের ক’টা দিন কনফারেন্সের ফাঁকে প্রচুর খেয়ে দেয়ে এই খাটুনি সুদে-আসলে পুষিয়ে নেবো। আপাতত এটাই ফন্দি।
জার্মান নিয়মানুবর্তিতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আটটার বাস সোয়া আটটায় আস্তে ধীরে ছাড়া হল। কোনো লতিফ আদৌ বাদ গেছে কিনা কে জানে। তোয়াক্কা না করে জোড়া আসন দখলে নিয়ে আরাম আয়েশে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
২.
জানুয়ারির শেষ প্রায়। মিউনিখ এখনো তুষারশূন্য। অবশ্য শহর ছাড়িয়ে আধা ঘন্টার মাথায় জানালার বাইরেটা তুষারশুভ্র হয়ে গেল। তার মানে আল্পবাখ হতাশ করবে না। ইচ্ছেমত বরফে হুটোপুটি করা যাবে। অনু কাব্যের আদলে বেশ কয়েকটা অনু ঘুম ঘুমিয়ে সময়টা ফুশ্ করে উড়ে গেল। খালি রাস্তা পেয়ে দুই ঘন্টার পথ অনায়াসে দেড় ঘন্টায় পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম তুষাররাজ্য আল্পবাখ।
বাস থেকে নেমেই বরফে হোঁচট খেয়ে বুঝলাম, কেন ডরোথি সাথে করে ভাল জাতের হাইকিং শ্যু আনতে বলেছিল। ডরোথি আমাদের রিসার্চ কন্সোর্টিয়ামের কো-অর্ডিনেটর। জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ-সব কাজে সে এক নম্বর। এই সম্মেলনের সমস্ত বন্দোবস্ত সে করেছে। তার প্ল্যান মোতাবেক একদিন আমাদের হাইকিংয়ে নেয়া হবে। আর আরেকদিন নিয়ে যাওয়া হবে স্নো-শ্যু হাইকিংয়ে। এমন চৌদ্দ পদের হাইকিং দিয়ে কি হবে, সেটা আমার মাথায় ঠিক খেলছে না। কলিগদের কাছে বুদ্ধি-শুদ্ধি নিয়ে বনেদী জার্মান ব্র্যান্ড জ্যাক উলফ্স্কিনের দামী এক জোড়া হাইকিং শ্যু কিনে এনেছি। এখন জুতা তার কোম্পানির মান রাখে কিনা দেখার বিষয়।
সময়ের আগে আল্পবাখ চলে এসেছি। কনফারেন্স হলের বাইরে সবাই যে যার মত উশখুশ বেকার ঘুরছে। পর্দার আড়ালে চা-কফি সাজানো ছিল চা-বিরতির জন্যে। এতগুলো লোকের হট্টগোল সামাল দিতে সেগুলোকে আগেই সামনে আনা হল। আমরাও হামলে পড়ে চো চো করে কফি টানতে থাকলাম। পরিপাটি বেশভুষার ওয়েটার মুচকে হাসছে। বুঝে গিয়েছে যে মিউনিখ থেকে এক দঙ্গল হাভাতে বিজ্ঞানী এসেছে। এরা যা পাবে, তাই খেয়ে ফেলবে।
৩.
কথা জমাতে না পারা মুখচোরা স্বভাবের আমি কফি হাতে এক টেবিলের চারপাশে উগ্রহের মত ঘুরপাক খাচ্ছি। জনাদুয়েককে চিনি। একজনের সাথে একটা প্রজেক্টও চলছে। কিন্তু অস্বস্তির খোলসটা খুলে এগিয়ে গিয়ে একটা ‘হ্যালো’ বলতে পর্যন্ত পারলাম না। এই অসুখের দাওয়াই কি জানা নেই। এই স্বভাব নিয়ে কবি-সাহিত্যিক হওয়া চলে, কিন্তু গবেষক-বিজ্ঞানী একেবারেই না। ঘরের চিপায় চুপকে বসে তাড়া তাড়া কাগজ লিখে ভরিয়ে ফেলার একটা বিনে বেতনের চাকরি করলে এভাবে টেবিলের চারকূলে ঘুরে গনসংযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করতে হত না।
কথাটা মনে হতেই মাথায় ষাট ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো। হাতের সময়টা কাজে লাগাতে নিরিবিলি এক কোন খুঁজে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে শেষ করতে হবে।
টুকটাক ইতং বিতং লেখালিখির অভ্যাস আছে। এই কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে গেলাম। ফিরে এসে সপ্তাহান্তের অবসরে তাতেই রং চড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখে ফেললাম কাঁচা হাতের ভ্রমন কাহিনী। যেটা আদতে ভ্রমন কাহিনীর ‘ভ’ও হয় না। ক’দিন আগে কি ভূত চেপেছিল, এক শুভাকাঙ্খীর জবরদস্তিতে পড়ে তেমনি কতগুলো লেখার সাথে আরো কিছু নড়বড়ে গল্প জুড়ে একটা পান্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম এক প্রকাশক বরাবর। ঝড়ে যে টুপ করে বক মরে যাবে, ভাবি নি। মাতৃভাষা প্রকাশ থেকে প্রকাশক অতি তুরন্ত বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে পাঠাতে বলেছেন। বইমেলায় বই আসবে। বইয়ের একটা যুতসই নামও পাঠাতে বলছেন। শতভাগ হতবাক আমি কথাটা বন্ধু কি পরিবার, কাউকেই বলতে পারছি না। সবাই পেট চেপে হ্যা হ্যা করে হাসবে। গাঁটের পয়সা খরচ নেই, কিচ্ছু নেই, এত সহজে নবীশ লোকের বই ছাপা হয়- এমন তো ইদানীংকালে শুনি নি।
যাহোক, ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে হাতে থাকা বিশ মিনিটের ভেতর ফ্ল্যাপ লেখার কাজ কিছুটা এগিয়ে আবার গা ঝাড়া দিয়ে ভোল পাল্টে বসলাম। লেখক স্বত্তাটাকে এক রকম খ্যাক্ খ্যাক্ করে খেদিয়ে প্লাস পয়েন্ট টু ফাইভ পাওয়ারের রিডিং গ্লাসটা নাকে চাপিয়ে আবার বিজ্ঞানীর ভেক ধরলাম। এই শ’খানেক তাবড় তাবড় বাঘের পালের ভেতর আমি যে একটা বাঘডাসা সেটা লুকাতে এই ভেকটুকুর দরকার হয় বই কি।
গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে। অনেকগুলো প্রেজেন্টেশন। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষের মনোযোগের মাত্রা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতন। সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হওয়া জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বেলা দেড়টায় এসে মাথায় আর না ঢুকে শিস্ কেটে কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। ক্যান্সারের উপর দীর্ঘ আলাপ শুনে নিজেরও কেমন অসুখ অসুখ লাগছে।
পাশে বসা পিএইচডি সুডেন্ট মেয়েটা নিরুপায় বড় বড় হাই তুলছে। আর আমার পেয়েছে খিদে। সম্মেলন শুরুর আগে হামলে পড়ে চা-কফি মেরে দিয়েছিলাম বলে চা-পর্বের পাট চুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দু’টোর দিকে নাকি একবারে লাইট লাঞ্চ হয়ে যাবে।
দু’টোর দিকে টেবিল লাগানো হল। আমরা তড়াক করে লাফিয়ে চলে এলাম ধোঁয়া ওঠা খাবারগুলোর কাছে। প্লেট কে প্লেট লাইট লাঞ্চ গলা দিয়ে নামিয়ে হেভি হয়ে যেতে সময় লাগলো না।
খানিকবাদে তৃপ্তি নিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ফিরে যাচ্ছি। কে যেন পিছু ডাকলো, ঘুরে তাকালাম। ‘হাই, আমি দীপ্তি, দীপ্তি আগড়ওয়াল।‘ তার পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলো, ‘আর আমি মনিকা’। তাদের আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসা দেখে ইতস্তত করলাম। অনেক জোর করে জড়তা কাটিয়ে ফিরতি জবাব দিলাম ,’হ্যালো, আমি সাবরিনা। পোস্টডক। ডক্টর কাতিয়া ষ্টাইগারের ল্যাবে আছি’।
তাদের সাথে বাৎচিত যা হল, তার বিষয়বস্তু আজকে রাতের হাইকিং। পাহাড় চূড়ায় রেস্তোরা আছে। সেখানে আজকের ডিনারের আয়োজন। মেয়ে দু’টো একটু ধন্দে আছে, এক হাঁটু তুষার ঠেঙ্গিয়ে ঘোর অন্ধকার পথে ঘন্টা খানেক হেঁটে যাওয়া তাদের ভারতীয় জানে কুলাবে কিনা। তাই এই বঙ্গসন্তানকে পেয়ে তারা দল ভারী করতে চায়। জার্মান আর বাকি ইউরোপীয়গুলো তো বরফ ডিঙ্গিয়ে খরগোশের মত লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাবে। পিছিয়ে পড়া দুয়েকটা কচ্ছপের দিকে যে ফিরেও তাকাবে না-এতো চোখ বুজে বলে দেয়া যায়।
নাম মনে না থাকার রোগ আছে। দীপ্তি আর মনিকা-নাম দু’টো তাই ইষ্ট নামের মত জপতে জপতে লেকচার হলে বসলাম। একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ম্যারাথন কয়েকটা সেশন শেষ হবার পর দুইজনকে খুঁজে নিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘হাই দীপা, হাই মারিয়া’। দুজনই মুখ চাওয়া করছে দেখে চলে গেল ওদের গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডে। চট করে নাম শুধরে নিয়ে বললাম, ‘কি দীপ্তি, প্ল্যান ঠিক আছে তো? হোটেলে চেক-ইন করে ঠিক আটটায় দেখা হচ্ছে তাহলে, মনিকা’। আধা ঘন্টার একটা সংক্ষিপ্ত বিদায় নিয়ে কাতিয়ার গাড়িতে চেপে বসলাম। তাকে আর আমাকে একই হোটেল দেয়া হয়েছে।
কাঠের দোতলা মচমচিয়ে ভাঙতে গিয়ে নাকে চন্দনের চমৎকার ঘ্রান ভেসে আসলো। এই শীতের রাজ্যে চন্দন এলো কোত্থেকে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো, তার উপায় নেই। এক অতি বয়স্কা বৃদ্ধা একলা থাকেন নিচ তলায়। তাকে ঘাটানো বারণ। দোতলার বাড়তি ঘর দু’টো ভাড়া দেয়া হয় আল্পবাখে স্কি করতে আসা পর্যটকের কাছে। তাদের দেখভালের জন্যে দিনে একবার কেয়ার টেকার আসে। আশেপাশের হোটেলগুলোও নাকি এমনি। লোকজন নিজের ঘর ভাড়া দিয়ে রেখেছে। স্থানীয়দের অনেকেরই নাকি এই ব্যবসা। ব্যাপারটা খারাপ লাগলো না। ঘরোয়া ভাব আছে। চন্দনের উদাসী ঘ্রানটা টেনে নিয়ে ঘরের চাবি ঘোরালাম।
হাতে সময় কম। তবুও ছোট্ট বারান্দাটা কি সম্মোহনে ডেকে নিয়ে গেল। হালকা ঝিরি ঝিরি তুষারে কাঠের মেঝে ঢেকে গিয়েছে। তাতে খালি পায়ের ছাপ এঁকে চারপাশটা অবাক চোখে দেখছি। মেঘে ঢাকা আকাশে সন্ধ্যাতারা নামে নি। তার বদলে পেঁজা তুলোর মত ঝরছে অযুত তুষার কনা। আকাশ থেকে তারাদের দল আলতো হয়ে খসে পড়ে পড়লে বোধহয় এমনি দেখাতো। আঁধারের বদলে নীলাভ আলোয় ছেয়ে গেছে সন্ধ্যাটা।
বিমূঢ় দাঁড়িয়ে কতক্ষন কেটে যেত বলা মুশকিল। মুঠোফোনটা একবার বেজে উঠে ঘোর কাটিয়ে দিল। দীপ্তি, মনিকারা বেরোচ্ছে। সাধের হাইকিং শ্যু পায়ে গলিয়ে আমিও কাতিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। কাতিয়া চুপচাপ স্বভাবের। আর আমি চুপচাপের বাপ। সুতরাং, নিঃশব্দে চলছি দু’জন। পথের পাশে স্কিয়িং-এর সরঞ্জামের দোকান। রাইফেলের দোকানও দেখছি সারি সারি। স্কি করতে এসে এত বন্দুকবাজির কি দরকার বুঝলাম না।
পাহাড়ি উঁচু ঢালু পথঘাট যেন ভুলভুলাইয়া। একই রকম তুষারস্নাত চেহারা সব অলিগলির। সাহস করে একাও বেরোনো যেত। নতুন শহরে নিজের সাথে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চ অন্যরকম। একটা ‘চলে মুসাফির’ ভাব আছে। তবে এই গুড়ি গুড়ি তুষারের আবছায়া সাঁঝে পথ হারিয়ে হাঙ্গামা হুজ্জত বাঁধানোর কি দরকার। আর আজকে হারালেও কেউ খুঁজতে আসবে না। পাহাড় চূড়ার রেস্তোরাটায় পেটপূজোর পর গেলাস গেলাস পাগলা পানি গিলে টাল হয়ে থাকা কেউ খেয়ালই করবে না তাদেরই একজন আল্পবাখের কোনো বাঁকে হারিয়ে গিয়ে খাবি খাচ্ছে। (চলবে)
২৪.০২.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২০ রাত ৩:৩২