somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আল্পবাখের বাঁকে-২

০৮ ই মার্চ, ২০২০ ভোর ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


৪.
কংগ্রেস সেন্টার আল্পবাখের সামনে গিজগিজে ভিড়। প্রফেসর, পোস্টডক, পিএইচডি ছাত্ররা মিলে মোরব্বা অবস্থা। ভারি জ্যাকেট-টুপি-মাফলার, যে যা পেরেছে জড়িয়ে পেঁচিয়ে এস্কিমো সেজে এসেছে। সেই এস্কিমোদের ভিড়ে আলাদা করে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সে চেষ্টা না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তোড়জোড় দেখছি। প্রায় মশাল সাইজের কতগুলো মোমবাতি হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে কয়েকজন। একটু পরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে এগুলোই পথের দিশা। একটা মোমবাতি সাধলে বিনয়ের সাথে মাথা নেড়ে পাশে দাঁড়ানো প্রফেসর ক্লাউসের হাতে গুঁজে দিলাম। বুড়ো প্রফেসর শিশুর মত খুশি হয়ে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নইলে আমার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি মানেই বেখায়ালে নিজের জ্যাকেট জ্বালিয়ে দিয়ে সেই আগুন আরো দু’চারজনের গায়ে ছড়িয়ে বিতিকিচ্ছিরি একটা কান্ড বাঁধিয়ে দেয়া। হাজারো ভীতি আর ফোবিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার এই আরেক আগুনভীতি।

রওনা দেবো দেবো, এমন সময় ঘড়ির কাটার উপমহাদেশীয় কেতা মেনে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে হাজির দীপ্তি আর মনিকা। ভুরু না কুঁচকে বরং মুচকি হাসলাম হাত নেড়ে। সাথে কোত্থেকে একটা চাইনিজ মেয়েও জুটে গেল। তার নাম পিং মিং। এই চৈনিক নাম মুখে মুখে ঘুরে পাঁচ মিনিটের মাথায় গিয়ে পিং পং, দশ মিনিটের মাথায় পিং পিং আর পনেরোর মাথায় আশ্চর্যরকমভাবে শুধরে সেই পিং মিং-এই ফিরে এল।

বিরক্তি ধরিয়ে দেয়া রকমের ধীর গতিতে চলছে আমাদের চারজনের দলটা। কাছেই মোমের মশাল নিয়ে পাঁচ নম্বর একজন পাশে হাঁটছিল। শামুক গতির সাথে আর না পেরে মশালটা পিং মিংয়ের হাতে ধরিয়ে বেচারা দুড়দাড় পা চালিয়ে উধাও হয়ে গেল। পথটা এখনো ঘোর অন্ধকার হয়ে সারে নি। দুই পাশে বাড়িগুলোর উঠানে ঝোঁপে জড়ানো মরিচ বাতি টিমটিমে আলো দিয়ে যাচ্ছে। তুষারের ভারে নুয়ে পড়া ক্রিসমাস ট্রিগুলোর পাশে স্নো ম্যানও বানানো হয়েছে কোনো বা বাড়ির সদরে। বোতাম চোখ, গাজর নাক আর উল্টো বালতি মাথায় স্নো ম্যান ঠাঁয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার। বেচারা স্নো ম্যানের শান্তি নষ্ট করে নয়া দিল্লির নয়া জমানার মেয়ে দীপ্তি পটাপট কিছু সেলফি তুলে নিল।

৫.
বাড়িগুলো যেন হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেল। আশে পাশের ছোট দলগুলোও কোন দূরে সরে গেছে। রাস্তাটাও দেখি বেমক্কা খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ধীমে তালের ওয়াকিং এখন বাধ্য হয়ে হাইকিংয়ের চেহারা নিয়েছে। আর আরেকটু পর দেখা গেলো, রাস্তাই ফুরিয়ে গেছে। বাঁকানো বাঁকটা দেখতে না পেয়ে খাদ বরাবর এগিয়ে গিয়েছিলাম একটু হলেই। ভুল করে ভীষন খাড়া ঢালে পা দিয়ে ফেললে আর দেখতে হত না। চীন, ভারত আর বাংলাদেশের বেভুল মেয়েগুলো হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে এই শুনশান রাতে ত্রি-দেশীয় অ্যাভালেঞ্চ বইয়ে দিতাম। যাহোক, নেভিগেশন ব্যাপারটা যে মেয়েদের ঠিক আসে না, সেটা স্বীকার করে নিয়ে ঠিক পথে নেমে এলাম। ফিরতি পথে কোনো এক ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দলে টেনে নেবো, এই ফিঁচেল ফন্দিও আঁটা হল এক জোট হয়ে।

ধাক্কাটা সামলে নিঃশব্দে সাবধানে হাঁটছি। একটু আগের ছেড়ে আসা হোটেল, দোকানপাট সব পাহাড়ের পায়ের কাছে মিট্মিটিয়ে জ্বলছে জোনাক পোকার মতন। বেয়ে বেয়ে কতখানি উঠে গেলে প্রমান আকারের ঘরবাড়ি বিন্দু হয়ে যায়!

বেঙ্গালুরুর মেয়ে মনিকা আর পারছে না। স্যুপ দিয়ে রুটি খাবার জন্যে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের ডগায় হাইকিং করে যাওয়াটা তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। বেচারা পিএইচডি করতে এসেছে সবে তিন মাস। ইউরোপীয় মৌজ-মাস্তির ধারা বুঝতে তার আরো সময় লাগবে। বরফের দেশের মানুষগুলোর আসল আনন্দই হচ্ছে শীতের ভেতর ঘেমে নেয়ে পাহাড় বাওয়া আর তুষারের ভেতর গড়াগড়ি খাওয়া।

দলে থাকবার একটা সুবিধা আছে। এ ওকে ঠেলে নিয়ে বিরতিহীন এগোতেই থাকে। তাই হাঁপিয়ে হেদিয়ে জিভ বেরিয়ে গেলেও ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

৬.
রেস্তোরার সামনে কাঠ জ্বালানো হয়েছে। সবাই গোল হয়ে ওম নিতে ব্যস্ত। হাতে হাতে গ্লুভাইন। রেড ওয়াইনের সাথে আর কি সব মিশিয়ে ক্রিসমাসের আগে-পরের সময়টায় খুব চলে এই পানীয়। আমাদের যেমন শীতে খেজুরের রস একটা বিলাসের জিনিস, এদেরও তেমনি আয়েশের বস্তু এই গ্লুভাইনের শরাব। গ্লুভাইনের নন-অ্যালকোহলিক ছোট এক ভাই আছে, নাম যার ‘পুঞ্চ’ বা ইংরেজি উচ্চারনে ‘পাঞ্চ’। আজকের আয়োজনে সেই ছোট ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তার মানে ডিনারেও একপেশে মেন্যু রাখা হয়েছে। তিন পদের মাংস থাকবে, কিন্তু মাছ-সবজির বালাই নেই। হতাশ হয়ে এক মুঠ বরফ মুখে পুরে কচ কচ চিবোতে থাকলাম। মনে মনে বেশুমার গজ গজও চলছে।

‘এ্যাই মেয়ে, কম আলোতে খামচে খামচে বরফ গিলছো কেন?’। অপ্রস্তুত মুখ তুলে দেখি প্রশ্নটা করে ফিক ফিক করে হাসছে আরবি চেহারার এক তরুন। ছেলেটা নিজের থেকেই বলল, ‘আমি আদির। অমুক ল্যাবে তমুক টপিক নিয়ে কাজ করছি।‘ ডান গালে টোপলা মেরে থাকা বরফের গোলাটা জিভে ঠেলে গলা দিয়ে নামিয়ে জবাব দিলাম, ‘হাই হাদী। কেমন আছো?’ ছেলেটা কেমন খঁচে গিয়ে বলল, ‘হাদী না, আমার নাম আদির। কানে তো দেখছি শোনো টোনো কম‘। একদম অচেনা এই উজবুক আমাকে প্রায় ধমক মেরে কথা বলছে দেখে হকচকিয়ে গেলাম। ‘স্যরি, এত লোকের ভিড়ে ঠিক শুনতে পাই নি।‘ অহেতুক গ্যাঞ্জাম এড়াতে হার মেনে নেয়া ভাল।

মূর্তিমান যন্ত্রনাকে এড়াতে মনিকাদের ভিড়ে ভিড়লাম। কিন্তু যন্ত্রনাটাও লাফিয়ে পিছু নিল। ‘আমি কোত্থেকে এসেছি বল তো?’ কি রে বাবা, কাউকে তো এমন গায়ে পড়ে কথা বলতে দেখি নি। দায় সেরে উত্তর দিলাম, ‘সিরিয়া?’। আদির নামের বদ ছেলেটা পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে জ্বালিয়ে মুখের ওপর ভক করে ধোঁয়া ফেলে কড়া মেজাজে জবাব দিল,’কি ভয়ংকর স্টেরিওটাইপ নিয়ে ঘুরে বেড়াও তুমি! চেহারায় আরব আরব ভাব দেখেই ফশ্ করে বলে দিলে সিরিয়ান লোক?’ ঘাড় ঝাঁকিয়ে হাত উল্টে ‘কি জানি বাপু’ মুখ করে পালিয়ে যেতে নিলাম। ‘এই যে তুমি ইন্ডিয়ান মেয়ে, তোমাকে কেউ শ্রীলঙ্কান বললে কেমন লাগবে?’। এখন আমার ক্ষ্যাপার পালা। ‘কে বললো যে আমি ইন্ডিয়ান, অ্যাঁ?’ নিজের দেশের নাম শুনে দীপ্তি আর মনিকা দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পিং মিংও আছে সাথে। আদির একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বলল, ‘তাহলে তুমি কোন দেশের? দেখলে কেমন ভুলে ভুলে কাটাকাটি হয়ে গেল? হা হা হা...।‘ এত জোড়ে প্রান খুলে হাসতে পারা লোকের উপর আর ক্ষেপে থাকা গেলো না। শীতের রাতে গল্প জমে গেল অল্পতেই। তবে আমাদের আপত্তির মুখে তাকে বিড়ি নিভিয়ে ফেলতে হল। সেটা গুঁজে দেয়া হল কার যেন বানিয়ে রাখা একটা স্নো ম্যানের মুখে।

বিচ্ছিরি রকমের বিস্বাদ খানাখাদ্য খেয়ে ঘন্টাখানেক পর সেই চারজনের দলটাই আবার ফিরতি পথ ধরলাম। আদিরকে দলে টানার হালকা ইচ্ছে ছিল। তার টিঁকির দেখাও মিলল না দেখে নিজেরাই রাস্তা মাপলাম। মাধ্যাকর্ষণের টানে ফুটবলের মত গড়িয়ে নামতে সময় লাগলো না।

আজকের হাইকিং পরীক্ষায় উৎরে গেলেও কালকে হবে আসল খেল। কনফারেন্সের সকালের সেশন শেষ হলেই দুপুরে নিয়ে যাবে আরেক পাহাড়ে। পেশাদার গাইড সহ স্নো-শ্যু হাইকিং। স্নো-শ্যু ব্যাপারটা ধোঁয়াশার মত লাগছে। আজকে একে ওকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর মেলে নি। যাহোক, আজকে ভাল করে ঘুমিয়ে টুমিয়ে সকালে একেবারে জলজ্যান্ত হয়ে উঠতে হবে। (চলবে)



মিউনিখ, জার্মানি
২৪.০২.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২০ ভোর ৬:৩৫
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×