somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিগ্রি কা লাড্ডু-১

১৫ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
আঙ্গুল গুনে বলতে গেলে বেশ ক’বছর আগের কথা।

ডানে-বামে বসা মেয়ে দু’টো ফ্যাঁচফোঁচ করে কাঁদছে। ইনুনি বিনুনি দিয়ে মরা কান্না জুড়ে দেয়ার কি হল, বুঝলাম না। পরীক্ষা তো আমারও খারাপ হয়েছে। বিরক্তিটা চেপে খাতা-কলম গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম গ্রোসহাডের্ন হাসপাতালের লেকচার হল থেকে। মেয়েগুলোও বেরিয়েছে। রুমালে নাক মোছার ফোঁওওৎ শব্দে করিডোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। জোরসে পা চালিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি।

টোস্টার বিল্ডিং ছেড়ে স্টেশনের কাছের বেঞ্চিটায় এসে বসেছি। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রোসহাডের্ন হাসপাতালটা এখান থেকে আসলেই পাউরুটির টোস্টারের মত দেখায়। যেন এই বুঝি প্রিং করে মচমচে পাউরুটি লাফিয়ে উঠবে। কার মাথায় যে এমন বলিহারি নকশার বুদ্ধি এসেছিল। এখানে রোগী আসবে আর এপিঠ ওপিঠ ভাজা ভাজা হতে থাকবে। হাসপাতালটাকে লোকে চেনেও টোস্টার বিল্ডিং নামে। বানিয়ে বলছি না এক রত্তি।

রোগী না হয়েও এই মুহূর্তে কান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ফেল মানে নির্ঘাৎ ফেল। প্রায় সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছি। পিএইচডি করতে এসে যে ছ’মাস অন্তর অন্তর পরীক্ষায় বসতে হবে, এমনটা জানা থাকলে এত হুজ্জত করে এই জার্মান দেশে আসতামই না। তাও আবার ওপেন বুক কায়দায় পরীক্ষা। নামকরা মেডিসিন জার্নালে ছাপা হওয়া একটা সাইন্টেফিক পেপার সবার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন সব সেখান থেকেই করা। তারপরও লাড্ডু মেরে এলাম।

“এই পেপারে যে এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তোমার মতামত কি? পরীক্ষাগুলো আর কি ভাবে করলে আরো ভাল হত বলে মনে করো? কি কি ফাঁক রয়ে গেছে সংক্ষেপে বলো তো…” ইত্যাদি। সারা জীবন বইয়ের পাতা চিবিয়ে মানুষ হয়েছি। পেটভর্তি পুঁথিগত বিদ্যা। নিজস্ব মতামতটা যে কি বস্তু, সেটা কি তিন কোনা নাকি চারকোনা, লাল না নীল-এর কিছুই ঠাহর করতে না পেরে আবোল তাবোল আর হযবরল কি সব লিখে দিয়ে এসেছি।



তিরিক্ষে মেজাজে মুখ ভচকে আছি। এর ভেতর মেয়েগুলো আবার এসে জুটেছে। আনা আর আন্দ্রেয়া। কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে বোলতার কামড়া খাওয়া চেহারা হয়েছে তাদের। “আমাদেরকে এত স্ট্রেস দেয়ার জন্যে পুরো গ্র্যাডুয়েশন স্কুলকে স্যু করা উচিত না, বলো?”। জবাব না দিয়ে কি করে পাশ কাটানো যায়, ভাবছি। বহু কষ্টে এই অবধি আসা। শ’খানেক প্রফেসর আর ডজন ডজন রিসার্চ স্কুল বরারবর দরখাস্তের পর বহু আরাধ্য স্কলারশীপ একখানা জোটানো গেছে। এখন স্যু ট্যু করে পিএইচডি করার সুযোগটা এক্কেবারে ঘেঁটে দিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরলে আর মুখ দেখানো যাবে না। ছি ছিৎকার পড়ে যাবে।

“আমি আর এখানে পড়বোই না, ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যাব একদম”। আনা’র কথাটা শুনে দুঃখের ভেতরেও হাসি পেলো। বললাম, “তোমার বাড়ি তো জার্মানিতেই, তুমি আর যাবে কই? যাবার তো কথা আমার। ওয়ান-ওয়ে টিকেট কেটে ভোঁ বাংলাদেশ।“

আনা ক্ষান্ত না দিয়ে বলেই চললো, “গবেষণা টবেষনা আমাকে দিয়ে হবে না। গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবা-মার সাথে ভেড়ার খামারি করবো। ব্ল্যাক ফরেস্টের এক অজ গাঁয়ে খামারবাড়ি আছে। প্রচুর ভেড়া আমাদের।“ চুপ করে গাঁজাখুরি কথাবার্তা শুনে যাচ্ছি। দেশে গিয়ে কবুতর কিংবা ব্রয়লার মুরগীর ফার্ম দেয়ার বুদ্ধিটা হালকা ঝিলিক মেরে গেল। তবে তার আগে তো রিকশাওয়ালার সাথে বিয়েটা ঠেকাতে হবে।

আমাদের অতি শোকের বিশেষ কারণ আছে। গুজব শোনা যাচ্ছে, এটা প্রকারান্তরে একটা স্ক্রিনিং টেস্ট। এই পরীক্ষায় যারা ডাব্বা মারবে তাদের মানে মানে বিদায় করে দেয়া হবে। মুশকিলে পড়লাম। স্কলারশীপ তো দেখছি স্বাধীনতার মত নাজুক। স্বাধীনতা নাকি অর্জনের চাইতে রক্ষা করা কঠিন। বৃত্তি একটা কোনোমতে বাগিয়ে হাজার মাইল ঠেঙ্গিয়ে পড়তে আসার পর এখন যদি এরা পরীক্ষা নামক মিহি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলে দিতে চায়, তাহলে গলায় মাদুলি ঝুলিয়ে সন্ন্যাসী বনে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

কিন্তু যা হবার, তা হয়ে গেছে বোধহয়। নিরুপায় যে যার মত বেঁকেচুরে কেৎরে বসে আছি। কারো কাঁধ ঝুলে গেছে, কারো বা মাথায় হাত মাতমের ভঙ্গিতে। পলকবিহীন শূন্য দৃষ্টিতে মাছের মত কোন দিকে যেন তাকিয়ে আছি। সময় জ্ঞান আর নেই। দূরের গির্জায় ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং। এমন সময়ে আচমকাই ভুঁই ফুঁড়ে এক চিড়িয়ার উদয়। আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা আর গলায় ঝোলানো বিশাল ক্রুশটা দেখে পরিচয় বুঝতে অসুবিধা হল না। সন্ন্যাসের নাম নেয়া মাত্র সন্ন্যাস হাজির।

আন্দ্রেয়ার ফর্সা হাতে গাছের শিকড়ের মত আঁকাবাঁকা নীলচে সবুজ রগগুলো তাক করে থিয়েটারী কায়দায় সংলাপ ছুড়লো সন্ন্যাস বাবা। “এই যে হতাশা, এই যে গ্লানি- এ কিন্তু আমাদের পাপের ফল, জানো? শিরায় শিরায় নীল পাপ বইছে, দেখতে পাচ্ছো?“। সম্ভাব্য সুদীর্ঘ লেকচারটা থামিয়ে দিতে পাশ থেকে আন্দ্রেয়া বেফাঁস বলে ফেললো, “আরে ধ্যাঁৎ, শিরায় শিরায় তো কার্বন-ডাইঅক্সাইড। পাপ আসলো কোত্থেকে?“।

বুড়ো একটুও দমে না গিয়ে এক গাল হেসে লিফলেট বাড়িয়ে ধরলো এক তাড়া। “যীশুর দেখানো পথে একবার এসেই দেখো না। সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।“ এবার সেক্যুলার জার্মানির ঘোর নাস্তিক আনা আর আন্দ্রেয়া বুড়োটাকে হ্যাট্ না ভ্যাট্ কি যেন বলে ধমকে উঠলো। চক্ষুলজ্জায় পড়ে কাগজগুলো আমিই হাতে নিলাম। বুড়ো প্রায় কথা আদায় করে নিলো যেন সামনের রবিবার বান্ধবী দু’জনকে নিয়ে যেন গির্জায় যাই। শিরার নীল পাপ মোচন বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে।

লিফলেট ভাঁজ করে গোটা চারেক উড়োজাহাজ বানিয়ে এদিক সেদিক উড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ফেল্টুস দলের তিন সদস্য। কিছু একটা খেতে হবে। বেশি দুঃখে পড়ে বেহিসেবী ধরনের খিদে পেয়ে গেছে। স্টেশনের সাথে লাগানো চাইনিজ টঙ্গ আছে একটা। সেখানে গিয়ে হামলে পড়লাম। মচমচে ভাজা চাওমিন যদি মনে একটু বল যোগায়, এই আশায়। উপর্যুপরি কয়েক প্লেট নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম ম ম ঘ্রানটা সাথে নিয়ে। মন খারাপের দাওয়াই হিসেবে কতগুলো আইসক্রিমও হাপিশ করে দেয়া হল। একে একে, বেকারির কেক-পেস্ট্রি, চিনি ঠাসা কফি, কিছুই বাদ গেল না। ‘খেয়ে মরে যাবো’ জাতীয় আত্মঘাতী চিন্তা পেয়ে বসেছে আজকে।

চিন্তাটাকে আর বাড়তে না দিয়ে সেদিনের মত বিদায় নিলাম ওদের কাছ থেকে। কালকেই দেখা হচ্ছে। সামনের সেমিস্টারের ক্লাস বিরতি ছাড়াই আবার শুরু হবে। সারাদিন ল্যাবের খাটুনির পর ঘন্টাখানেক বাস-ট্রেন ঠেঙ্গিয়ে শহরের আরেক প্রান্তের ক্যাম্পাসে বিকাল থেকে রাত অবধি ক্লাস। নয়েহেরবার্গ আর গ্রোসারডের্ন ক্যাম্পাস দু’টোর মাঝে ঢাকা-টু-কুমিল্লার দূরত্ব। এই আপ-ডাউন অত্যাচারের বুঝি শুরু-শেষ বলে কিছু নেই। ফোঁওওওশ্ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

সুযোগ বুঝে ফকফকে আকাশ ঘুটঘুটে কালো মেঘ ডেকে এনে বৃষ্টি নামিয়ে দিলো। ভিজ চুপসে ফিরতি ট্রেন ধরলাম কোনোমতে। ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাঁধানো যাবে না কিছুতেই। কারণ, ল্যাবে কালকে পঁয়ত্রিশটা ইঁদুর অপেক্ষায় থাকবে আমার হাতে খুন হবার জন্যে। প্রথমে সিরিঞ্জে চোঁ করে টেনে তাদের রক্ত শুষে নেবো। তারপর ছোট ছোট ফুসফুসগুলো খুলে ফর্মালিনে চুবিয়ে দেবো টুপ্। বাহ্, পরীক্ষায় ফেল করার হতাশাকে হঠাৎ পাশবিক আনন্দে পাল্টে ফেলে বেশ নির্ভার লাগছে। ক্রুর হাসি ছেয়ে গেল একান ওকান। (চলবে)

মিউনিখ, জার্মানি


সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:০২
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×