somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তেপান্তরের মেয়ে-১

২৯ শে মে, ২০২১ ভোর ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে বাস ধরলাম। বাড়িয়ে দেয়া হাতটা এক ঝটকায় ভেতরে টেনে নিলো। নইলে বাসের দরজায় চাপা খাওয়া কেউ ঠেকাতে পারতো না। দরজায় আবার সেন্সর কাজ করে না। নালিশ করতে গেলে ড্রাইভার খ্যাক্ করে ওঠে। সাথে দু’তিনটা চোস্ত জার্মান গালি ফ্রি। তাই এভাবেই চলছে।

টাল সামলে নিয়ে ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে চারপাশে কাউকে খুঁজলাম। বাসের ভিড়ে সে কখন মিশে গেছে। ধন্যবাদটা গিলে নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সোমবারের সাড়ে আটটার ল্যাব মিটিংটা বড্ড ভোগায়। সময় মত পৌঁছোতে পারলে হয়। না চাইতেও বার বার হাত চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে।

‘কব্জিতে তো ঘড়ি নেই। তাহলে দেখছো কি, বল তো?’। অপ্রস্তুত হেসে আড়ষ্ট মাথা নাড়লাম। ঘড়ি নষ্ট আজ দুই সপ্তাহ। কিন্তু খালি কব্জি হাতড়ে সময় দেখা থেমে নেই। ‘তোমার কোথাও লাগে নি তো?’।

আরে, ঝটকা হাত নয় তো? ভাবনাটা শেষ হবার আগেই হাতটা আরেকবার এগিয়ে এল, ‘বেশি জোরে টানি নি তো আবার? হাই, আমি জিসেল‘। ভাল করে তাকিয়ে দেখি একেবারে খাঁটি বাঙ্গালী চেহারার একটা মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের সাথে কালো চুলের লম্বা বেনীর যুগলবন্দী ভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়ের নাম ফারজানা কি ফারহানা। ভিনদেশী জিসেল নামটা একেবারেই যায় না।

ক’জন নামছে পরের স্টপে। এই ফাঁকে জিসেল চট করে হাত টেনে খালি আসনে বসিয়ে দিল। এই মেয়ের দেখি হাত টানের স্বভাব আছে। অস্বস্তিটা আড়াল করে ভদ্রতার শুকনো হাসি দিয়ে আলাপ পরিচয়ে ইতি টানতে চাইলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে সবে শুরু। ‘তোমাকে ইন্সটিটিউটের সেমিনারে দেখেছি। তুমি কি অমুক ল্যাবে কাজ করো?’। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দায় সারতে চাইলাম। মিউনিখ শহরের শেষ প্রান্তে সুবিশাল হেল্মহোল্টজ ক্যাম্পাস। অগুনতি বিভাগ আর শ’খানেক ল্যাব। তার ভেতরে সে যখন আমার ঠিকানা বলতে পেরেছে। তার মানে চেহারায় সে খুব চেনে আমাকে। চিনুক গে, আমার কি।

বাস এসে থেমেছে গন্তব্যে। খালি কব্জিতে স্বভাবসুলভ সময় দেখে আঁতকে উঠে হুড়মুড়িয়ে নামলাম। ব্যাগটা দু’কাঁধে নিয়ে ঝেড়ে দৌড়াতে পারলে দশ মিনিটের হাঁটা পথ পাঁচ মিনিটে উড়িয়ে দিতে পারবো। পেছন থেকে জিসেল বলে উঠলো, ‘আরেহ্, নাম বলে গেলে না যে?’। পড়িমরি ছুটতে ছুটতে দাড়ি-কমা ছাড়া জবাব ছুড়ে দিলাম, ‘সাবরিনা-মিটিং-স্যরি-পরে কথা হব্ব...’। বাতাসে মিলিয়ে গেল বাকিটা।


পরের সপ্তাহ।
‘সে দিন যে বাঁই বাঁই করে দৌড়টা দিলে! তুমি কোন দেশের বল তো? ইথিওপিয়া-সোমালিয়া নয় তো? ওরা কিন্তু অলিম্পিকে সেরকম দৌড়ায়।‘ জিসেলের এক কান ওকান হাসি সমেত কথাগুলো শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। সে বকেই চলছে, ‘তোমাকে কিন্তু দেখায়ও ইথিওপিয়ানদের মত, মাইরি’। নির্বিকার গলায় বললাম, ‘ইথিওপিয়ার মেয়েদের চেহারা আমার মত হলে সে দেশের ছেলেদের কপাল খারাপ‘। হো হো করে হেসে উঠলো মেয়েটা, ‘উফ্, সাবরিনা, তুমি দেখি দারুন পাজি। তোমার দেশের ছেলেরাও কি তোমার মত দুষ্টু?‘।

একই রকম নির্লিপ্ত সুরে জবাব দিলাম, ‘দুষ্ট মানে দুষ্ট। একবার বাংলাদেশের ছেলের হাতে পড়ে দেখো। জীবন তামা তামা করে ছেড়ে দেবে‘। জিসেল ঘাবড়ে না গিয়ে উল্টো বললো, ‘হন্ডুরাসের মেয়ে আমি, কোনো দেশের ছেলেকে ডরাই না। এমন ঘাড় মটকানি দেবো না...’। চকিতেই চোখে ভেসে উঠলো, দেশী ভাইয়েরা কোন দূরের দ্বীপদেশ হন্ডুরাসের গাট্টাগোট্টা মেয়েদের হাতে কেনু-গুঁতো খাচ্ছে আর বাবা গো, গেছি রে বলে কোঁকাচ্ছে। কি চমৎকার ছবি। আহা রে।

হাসি-ঠাট্টায় পরিচয়টা জমে উঠতে সময় লাগলো না। জিসেলের ভেতর অদ্ভূত কিছু একটা আছে। কথায় আর হাসিতে তার চারপাশে আলো ঠিকরে পড়ে। জার্মানি আসা অবধি এই ক’মাসে বন্ধু তেমন জোটে নি। স্বভাবটাও ঠিক হল্লা করে বেড়ানো টাইপ না। কারো সাথে দু’টো কথা বললে যে কত হালকা লাগে, সে আনন্দ প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আজ অনেক দিন বাদে মনের বদ্ধ জানালা খুলে দমকা হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো যেন।

ঠিক হল সামনে কোনো এক দিন লাঞ্চ করবো ক্যাফেটেরিয়ায়। চুটিয়ে আড্ডা হবে তখন। যাবার সময়ে জিসেল থিয়েটারী কায়দায় তিন বার হাত ঘুরিয়ে একটা বাউ করে ফেললো, ‘আসি। আবার দেখা হবে। ততদিনে তোমার দেশী একটা ছেলে দেখে রেখো। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, হাহাহা...’। উত্তরে পুরোদস্তুর আদম ব্যবসায়ীর মত চোখ টিপে কপট আশ্বাস দিলাম, ‘হয়ে যাবে। এক হাতের খেল’।


ল্যাবে একের পর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। জিসেলের সাথে লাঞ্চে যাবার ফুরসৎ আর মেলে না। আসতে যেতে দেখা হলে দু’দশ কথা হয়, এই যা। সেদিনও সময়টা টায় টায়। বাস স্টপ থেকে নামলেই বিরাট মাঠ। তেপান্তরের সাইজও বোধহয় এর চেয়ে ছোট হবে। খুব দ্রুত হাঁটছি। হঠাৎ দেখি পাশে জিসেল। সমান তালে পা চালাতে চালাতে বলছে, ‘এই মাইনাস পাঁচে চপ্পল পড়ে ঘর ছেড়েছো কি মনে করে?’। চট করে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। পাতলা মোজার সাথে ফিতেওয়ালা স্যান্ডেল গলিয়ে চলে এসেছি। গতকালের আঠারো ডিগ্রীর কুসুম কুসুম ওম আজকে এক ধাক্কায় শূন্যের ক’হাত নিচে নেমে গেছে। কচি ঘাসেরা সব গা ঢাকা দিয়েছে তুষারের আড়ালে। ময়না, চড়ুই তাড়িয়ে দিয়ে দাঁড় কাকেরা আবার রো ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শীতের শেষ কামড়ে বসন্ত পালিয়ে ফুড়ুৎ। কে জানতো এপ্রিলের জার্মান আবহাওয়া এমন ক্ষ্যাপাটে।

শুধু আবহাওয়া নয়, জিসেল মেয়েটাও পাগলাটে গোছের। সে একটু থেমে বুট ঠুকে প্রস্তাব দিলো, ‘বাজি লাগবে?’। দেখি কে আগে মাঠের ওধারের ল্যাম্পপোস্টে পৌঁছায়। পলকা চপ্পল বনাম উইন্টার বুট। এক, দুই, তিন...’। কিছু বুঝে ওঠার আগে জিসেল ছুট লাগালো। হিমেল বাতাসে লাল শাল উড়ছে দুর্বার। আমিও কানটুপি টেনে নিয়ে বাজিতে নেমে পড়লাম। নরম পেঁজা তুলোর পথ ফুঁড়ে ছুটছি ভিন দেশের দুই রাজকন্যা। যেন যে জিতবে সে হবে এই তুষার রাজ্যের নতুন রানী। পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে আশ্চর্য হয়ে জিসেলকে দেখছি। মেয়েটার একটা মারাত্মক রোগ আছে। যার নাম ছেলেমানুষী। বাধ না মানা খিলখিল হাসিটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে শ্বেতশুভ্র তেপান্তরের ইথারে ইথারে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২১ ভোর ৪:১৪
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×