somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা শিক্ষা, আশা শিক্ষা ১

২৪ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
টাকা-পয়সা বেশি নেই হাতে। সস্তায় কি বিনে পয়সায় রিফিউজিদের জার্মান শেখায়, এমন একটা ইশকুলে ভর্তি হয়েছি। এতগুলো পাশ দেবার পর আবার ছাত্র সাজতে মন চায় না। কিন্তু উপায় নেই। জার্মান জানা না থাকলে এদেশে ডিগ্রি-ফিগ্রির বাজারি দাম খুব কম। যম্মিন দেশে যদাচার পালন করতে ভাষাটা তাই এবেলা শিখতেই হচ্ছে। তাছাড়া, বদমেজাজী কেরানীর অকারণ চোখ রাঙ্গানির সামনে এক তাড়া ফর্ম পূরন করে কাঠখড় কম পোড়াই নি। এখন পিছিয়ে গেলে পুরোটাই পন্ডশ্রম। অগত্যা, দু’হাত পকেটে পুরে ধীর পায়ে এগোলাম দমবন্ধ ক্লাসরুম বরাবর।

পাশের জনের সাথে পেন-ফাইট খেলতে থাকা পাংকু চেহারার ছেলেটার পাশের জায়গাটাই শুধু খালি। ছোকরার টি-শার্টের হাতা পাড়ার মাস্তানের কায়দায় গোটানো। আর কালো লেদার জ্যাকেট জুড়ে চোখা চোখা ধাতব বোতামের ছড়াছড়ি। পাশে বসে এক গুঁতো না খেলেই হয়।

‘কি সিস্টার, খবর ভাল?’। পাংকু বয় চান্স নেবার ভঙ্গিতে চোখ টিপি দিলো। পিত্তি জ্বলে গেল একেবারে। জবাবের ধার না ধেরে সে পটাং এক শক্তিশালী টোকায় বলপেনটা ছুড়ে দিল প্রতিপক্ষের দিকে। কি কপাল! কলম গিয়ে ল্যান্ড করল এই মাত্র ক্লাসে আসা ভদ্রমহিলার চার ইঞ্চি হিলের জুতার কাছে। পেন্সিল স্কার্ট পড়া বছর চল্লিশের ভীষন স্টাইলিস্ট ভদ্রমহিলা খপ্ করে সেটাকে তুলে নিখুঁত নিশানায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে পাঠিয়ে দিল। তারপর মিষ্টি হেসে টেবিলে ডাস্টার ঠুকে জানালো, ‘গুটেন মর্গেন, গুড মর্নিং। আমি এরিকা। এই কোর্সটা আমিই নেবো’।

সরু চোখে তাকালাম। ‘ছাগল পিটিয়ে মানুষ’ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। সেই তো আবার পড়াশোনা। কেন যে ইংরেজি বলা কোনো দেশে না গিয়ে এই জার্মান মুলুকে পড়তে এসেছিলাম। এখন ল্যাও ঠ্যালা। খাও চক-ডাস্টারের বাড়ি।

সাবলীল হাসিটা ধরে রেখে এরিকা বলে চললো, ‘পড়তে বা পড়াতে কোনোটাই আমার ভাল লাগে না। আর জার্মান ভাষাটাও কঠিন। তার চেয়ে আসো গান-টান শুনি। বাই দ্যা ওয়ে, নিজেদের ভেতর ‘তুমি’ করে বললে সমস্যা নেই তো?’।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ক্লাসের সবাই নড়েচড়ে বসলাম। এরিকার ছেলেমানুষি কথাবার্তা মজা লাগতে শুরু করেছে। খুঁজেপেতে সে কোত্থেকে কতগুলো সিডি এনে তারই একটা পুরান-ধুরান দেখতে স্টেরিওটাতে চাপিয়ে দিল। গান নয়, বেহালা আর পিয়ানোতে ঝংকার তুলে চমৎকার ক্লাসিকাল সুর ভেসে আসছে। বিখ্যাত কারো কম্পোজিশন।

‘কেউ কি বলতে পারবে কার মিউজিক?’।

এক বিটোফেন আর দুই মোজার্ট ছাড়া তৃতীয় কারো নাম জানি না। তাই বলে ঝড়ে বক মারার সুযোগ ছাড়ি কি করে। হাত উঁচিয়ে সগর্বে বিটোফেন চালিয়ে দেবো ভাবছি। আচমকাই পাশ থেকে পাংকু ছোঁড়া চুইংগাম চিবোতে চিবোতে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বাখ, বাখ!’।

ক্লাসের সবাই একযোগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। নির্ভুল শটে বক মেরে ছেলেটা একান-ওকান হাসছে। যদিও তার ‘হেভি মেটাল’ লেদার জ্যাকেটের সাথে ‘লাইট ওয়েট’ বাখ-বিটোফেন একেবারেই যায় না। এরিকা সুযোগটা কাজে লাগালো, ‘বিখ্যাত জার্মান কম্পোজার বাখের সুর ধরতে পারা লোক যেন তেন কেউ নয়। ইয়ং ম্যান, আমরা কি তোমার সম্পর্কে জানতে পারি? দু-চার লাইন বললেই চলবে’।

‘চুইংগাম গালেই নিয়েই বলবো, নাকি ফেলে দেবো?’। প্রশ্নের ধরন শুনে এরিকা দমে না গিয়ে হেসে ফেললো। এরকম লাফাঙ্গা ছেলে সে গন্ডাখানেক দেখেছে। তাই সহজ সমাধান বাতলে দিল, ‘গালে রেখেই বলো না‘।

ক্লাসের সবার অজান্তে শুরু হয়ে গেল পরিচয় পর্ব।

২.
জামাল ছেলেটা ছয়মাস আগে সিরিয়া থেকে রিফিউজি হিসেবে এসেছে। আপাতত ম্যাকফিট নামের একটা ফিটনেস স্টুডিওতে কাজ নিয়েছে। আকার ইঙ্গিতে আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মানে কাজ চালিয়ে আসছিল। তবে অল্পে কাজ হবার দিন শেষ। ম্যানেজার হুমকি দিয়েছে, তিন মাসের ভেতর কাস্টমারের সাথে চোস্ত জার্মানে কথাবার্তা চালাতে হবে। নইলে রাস্তা মাপো। রাস্তা মাপামাপি এড়াতে জামাল এই কোর্সে ঢুকেছে। ‘চাকরিটা চলে গেলে বিপদে পড়বো। দেশে সামান্য ক’টা টাকা পাঠানো শুরু করেছি। তাও বন্ধ হয়ে যাবে’, চিন্তিত গলায় শেষ করল জামাল।

শুনে টুনে সামান্য চুপ এরিকা থেকে বললো, ‘হের জামাল, তুমি জায়গামত এসে পড়েছো। আর চিন্তা নেই। তিন মাসের ভেতর তুমি এমন মারদাঙ্গা জার্মান বলতে শুরু করবে যে ম্যানেজার ব্যাটা ভড়কে যেতে বাধ্য। কথাটা কাগজে লিখে রাখো। সই করে দিচ্ছি’।

এরিকার ডাকাবুকো ভঙ্গি ভাল লেগে গেল। চুইংগাম চিবানো পাংকু জামালকেও অত খারাপ লাগছে না। দেশে টাকা পাঠানো লোক খুব খারাপ হতে পারে না।

পরিচয় পর্বের কম্পাস ঘুরে জামালের পেন-ফাইট বন্ধুর কাছে থামলো। বয়স বোধহয় জামালের মতই পঁচিশ কি ছাব্বিশ। নাম মোস্তফা। তবে ‘মো’ বলে ডাকলেও নাকি চলবে জানালো। নাম ছেটে ফুল হাতা থেকে হাফ হাতার করার কেতা সে কই শিখেছে কে জানে। ছেলেটা ইরাক থেকে এসেছে। কুর্দিস্তানে তাদের বাড়িতে উড়ে আসা বোমায় যখন অর্ধেকটা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দাঁড়িয়ে থাকলো না, তখন সে সব ছেড়ে জার্মানি চলে এল। কিন্তু কিভাবে এল, একা না সপরিবারে-তার কিছুই জানা গেল না। এরিকাও আগ্রহ দেখালো না খুঁচিয়ে জানার।

তবে মো-এর পাশের মেয়েটাকে নিয়ে সবার ভেতর চাপা আগ্রহ কাজ করছে। রীতিমত চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছি সবাই। পোর্সেলিনের মত মসৃণ ত্বক আর এক পিঠ ঝলমলে সোনালি চুল নিয়ে মেয়েটা ঘর আলো করে বসে আছে। এতগুলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে সে সামান্য ইতস্তত করে জানালো, তার নাম মিনার্ভা। মনে মনে বললাম, ‘মেয়ে, তোমার নাম আফ্রোদিতি হলেও মানিয়ে যেত’। তা জানা গেলো, সে জাতে বলকান। বাড়ি বসনিয়া-হার্জোগোভিনায়। সেই পঁচানব্বইয়ে বসনিয়ার যুদ্ধ শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেছে। চাকরি-বাকরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই দেখে সে দেশ ছেড়ে এসেছে জার্মানির ঠিকানায়।

নানা দেশে থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের কথা শুনতে শুনতে মন অস্থির মন লাগছে কিছুটা। খবরের কাগজের পাতায় ‘রিফিউজি’ শব্দটায় যত সহজে চোখ বুলিয়ে গেছি, এখন দেখছি এর বাস্তবতা বেজায় কঠিন।

তবে যুদ্ধ-বিগ্রহই আমার ক্লাসমেটদের একমাত্র সমস্যা না। মোটাসোটা সুখী চেহারার পঁয়তাল্লিশ বছরের আমিনার সমস্যা অন্য লেভেলের জটিল। ভাঙ্গাভাঙ্গা জার্মানে সে জানালো তার পাঁচ সন্তান। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, সব খানেই এক-আধটা ছেলেমেয়ে পড়ছে। অছর বিশেক আগে তুর্কি থেকে আসা অবধি এ পর্যন্ত ভালই চলছিল সব। মাস খানেক আগে ছেলেপিলের বাবা দুম্ করে আরেক ঘরে বিয়ে করে তাদের নমস্কার বলে দিয়েছে। এখন সে ঝপাং জলে পড়ে গেছে। এখন ভাষাটা ভাল মত রপ্ত করে যদি কোনো কিন্ডারগার্টেনে ছোটখাট চাকরি জোটানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও সাঁতরে তীরে ওঠা যাবে।

বেলারুশের মেয়ে সারার কাহিনীও কাছাকাছি। এতদিন জার্মান শেখার অবসর মেলে নি। ঘরকন্না করে কেটে গেছে দিন। ক’দিন আগে বেধড়ক মারধোর খেয়ে চোখে কালশিটে নিয়ে শিশু সন্তানকে হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে সে। এখন নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে আর উপায় নেই। টেবিলে খাতা-কলম সাজাতে সাজাতে অন্যমনস্ক ভাবে কথাগুলো বললো সারা।

পর্তুগাল থেকে ভাগ্যের খোঁজে আসা বেকার পেদ্রো আর শহরের শেষ প্রান্তে রিফিউজি ক্যাম্পের টিনের কনটেইনারে গাদাগাদি করে থাকা আফগান মেয়ে লিলির গল্প দিয়ে শেষ হল বিচিত্র এক পরিচয় পর্ব।

মন দিয়ে সবার কথে শুনছিলাম। সত্যি বলতে কি, এক সাথে এতগুলো ভাঙ্গাচোরা মানুষকে আগে কখনো দেখে নি। ক্লাসরুমের পিনপতন নীরবতা বড্ড কানে বাজতে লাগলো। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:১৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×