somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেধাবী মানে কী???

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল
চিনি পাতা দৈ ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল
ডিমভরা কৈ ।
পথে হেঁটে চলি মনে মনে বলি
পাছে হয় ভুল ;
ভুল যদি হয় মা তবে নিশ্চয়
ছিঁড়ে দেবে চুল ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল
চিনি পাতা দৈ ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল
ডিমভরা কৈ ।
বাহবা বাহবা ভোলা-ভূতো-হাবা
খেলিছে তো বেশ !
দেখিব খেলাতে কে হারে কে জেতে
কেনা হলে শেষ ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল
চিনি পাতা দৈ ,
ডিমভরা বেল, দু’টা পাকা তেল
সরিষার কৈ ।
ওই তো অখানে ঘুড়ি ধরে টানে
ঘোষেদের ননী ;
আমি যদি পাই তাহলে উড়াই
আকাশে এখনি !
দাদখানি তেল ডিমভরা বেল
দু’টা পাকা দৈ
সরিষার চাল চিনিপাতা ডাল
মুসুরির কৈ ।
এসেছি দোকানে কিনি এইখানে
যদি কিছু পাই,
মা যাহা বলেছে সব মনে আছে
তাতে ভুলি নাই !
দাদখানি বেল মুসুরির তেল
সরিষার কৈ ,
চিনিপাতা চাল দু’টা পাকা ডাল
ডিমভরা দৈ ।”

কবিতাটা যতবারই পড়ি, আমার হাসি পাওয়ার বদলে মনে কেন যেন একটা অদ্ভুত দুঃখবোধ কাজ করে ।যোগেন্দ্রনাথ সরকার কি এখনো জীবিত কিনা আমি জানিনা, তবুও তাকে আমার সহস্র প্রনাম ।কি অদ্ভুত ভাবেই না তিনি একটা ছোট্ট কবিতায় আমাদের মরচে ধরা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন !

আজ প্রাথমিক শিক্ষাও এই দাদখানি চাল-মুসুরির ডালের মাঝেই সীমাবদ্ধ । রূপালি সুতার লাটাইয়ের মাঝে ঘুরিয়ে একটু একটু করে ছাড়ার সময় যখন হল , ঠিক সেই সময় পিএসসি নামের জুজুবুড়ির আবির্ভাব ।আক্ষেপ ! আজকালের বাচ্চারা কি আদৌ জুজুবুড়ির কথা জানে ? রাতের বেলা মায়ের বুকে মাথা চেপে থরথর করে কাঁপে ? কাঁপে না । সুপারমমরাও স্নেহের সন্তাঙ্কে রুপকথার গল্প শোনায়না । শোনাবে কি করে ? “টাইম” এন্ড “স্পেস” কোনোটাই কি তাদের কাছে আছে ? সারাদিন কষ্টের প্রাইভেটের পর বাসায় এসে বাচ্চার মাও তার মুখ থেকে আবার সেই একি বুলি শুনতে চায় ।তোতাপাখির মত গরগর করে বলা ছাড়া বেচারার আর কিই বা করার থাকে !
একটা ঘটনা বলি ।
আমি তখন ক্লাস টুতে পড়ি ।জিলা স্কুলে তখন ছেলেদের ভরতি পরীক্ষা নেওয়া হয় । আমার সব ক্লাসমেট ভরতি কোচিং এ গিয়েছে ।অনেক মেয়েরাও আগেভাগেই ভরতি কোচিং শুরু করে দিয়েছে ।শহরের স্বনামধন্য কিন্ডার গারটেনের “মিস” আমাকে কি তাচ্ছিল্যটাই না করলেন । কোচিং এ না পড়লে নাকি মেধাবি হওয়া যায়না !!! খুব মন খারাপ করে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা মা,মেধাবী মানে কি? আমি কি মেধাবী না?
-কেন মা কি হয়েছে?
-আজকে স্কুলের ম্যাডামরা বলেছে, কোচিং এ না পড়লে নাকি মেধাবী হওয়া যায় না । আমার বন্ধুরা সব মেধাবী হয়ে গেল, আমি কবে হব???
আমার মা এই ঘটনাএখনো খুব আগ্রহ করে সবাইকে বলে বেড়ায় ।কারন সেই বছর এমনকি তার পরের বছরও আম্র মেধাবি হওয়া হয়ে উঠেনি ।আহা! সেই বলদযুগে কতই না ভাল ছিলাম !!!

নিচতালার পিএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটা যখন তার বাংলা পরীক্ষার আগের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল আপ মেধাবী মানে কি ? তখন আর বিস্ময়য়ের সীমা থাকল না । অন্তত ক্লাস টু তে থাকতে আমার মেধাবি নিয়ে একটা নড়বড়ে হাইপোথিসিস ছিল ।আর এখনকার বাচ্চারা গোটা কয়েক শব্দের মতই সব কিছু মুখস্ত করে ফেলতে চায় ।মেধাবি অর্থের দৌড় ওই সংসদ বাঙ্গালা অভিধান পর্যন্তই ।
***মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন ...... “মেধাবী মানে কি”?????????

এক বুয়েটিয়ানের মায়ের ঘটনা বলি । তিনি সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন গণিত প্রশ্নের খোঁজে ।তার ভাইয়ের মেয়েদের দেবেন বলে । বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ , নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের মেধা যাচাইয়ের প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ার মায়ের যদি এই অবস্থা হয় ,তবে অন্যদের অবস্থা কেমন ?
জুজুকে বড় মিস করি । শৈশবের সুখটুকু যখন বাচ্চাদের হল না, শৈশবের ভয়টুকু অন্তত থাকত । দশ মাসের একটা শিক্ষা সেশনে একটা বাচ্চার দাদখানি-চাল-মুসুরির-ডাল বুলি আউড়ানো ছাড়া আর কি কোনো কাজ নেই ? আর সে যখন জানেই যে পরীক্ষার আগের রাতে সে ঠিক ঠিক প্রশ্ন পেয়ে যাবে , তবে এই বুলি কপচানোর কি দরকার ? এত প্রাইভেট কোচিং এর অর্থই বা কি ? এত ছোট অবস্থায় একটা স্বপ্নহীন ভবিষ্যৎ হীন জীবনের অর্থ কি?
আসলেই এই শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে আমরা নিজেরাই একটা প্যারাডক্স তৈরি করে রেখেছি ।আমরা নিজেরাই চাইনা যে এই দেশটা আবার মাথা তুলে দাঁড়াক । আমরাই চাই যে দেশটা “কচুগাছে” ফাঁস দিইয়ে লটকে মরুক । পিএসসির মত একটা ভিত্তিহীন পরিক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী কে ? বিজি প্রেস ? ফেসবুক ? কোচিং সেন্টার ?
নাহ ।
আমরা নিজেরা !
গোন্ডেন এ প্লাসের মোহে আমরাই আমাদের সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁসের পেটে ছুড়ি বসাই । একটা সময়(এবং এখনো) ভারসিটির প্রশ্ন বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হত , যার মূলে ছিল টাকার প্রতি মোহ । ফেসবুকের মত একটা নন প্রোফিটাবল অরগানাইজেশনের সাইটে(প্রোফিট বলতে এখানে আমদের দেশের ক্ষতি করে ফেবুর লাভ বুঝিয়েছি) পিএসসির প্রশ্ন পাওয়া যায় । এতে জুকারবারগের যেমন কোনো লাভ নেই ,সেই প্রশ্ন আপ্লোড দাতারও কানা কড়ি ও লাভ করেনা । তবে এর পেছনে উদ্দেশ্য কি ?
ধরলাম যে পাসের হার শো অফ করার জন্য সরকার থেকেই এই ব্যবস্থা । এখন প্রশ্ন হল , তাহলে আমরা কেন এসবের অনুমোদন করছি??? ফরমালিন নিয়ে যে এত হামকি তামকি হল ,এরপর মাছ কিনতে যাওয়ার সময় কি আমরা একটা বারো এটা নিয়ে ভাবি না??? তাহলে এখন প্রশ্ন ফাঁসকে গা এড়িয়ে যাই কেন ???আমাদের সচেতনতা কি গাদা গাদা পোস্টের মাঝেই সীমাবদ্ধ ???(ইনক্লুডিং মাই পোস্ট)

দেখেন ভাই ,দেশটা আওয়ামী লীগেরও না ,বিএনপিরও না, টাক্লু শিক্ষামন্ত্রীরও না ।দেশটা আমাদের ! যে দেশের পথে ঘাটে আইনস্টাইনের প্রতিভা জন্মায় , যে দেশের মাটির গন্ধে এখনো মুক্তিযুদ্ধের সূর্য্যিয় ঘ্রাণ পাওয়া যায় , সেই দেশের একটা ছোট্ট বাচ্চার পরীক্ষার আগের রাত ফাঁস হওয়া প্রশ্নের দিকে না তাকাইলেও চলবে ।খুব বেশি ক্ষতি তার হবেনা। যে মুজিবকে বাবা বাবা ডেকে আমরা মুখে (আর বইয়ের পাতায়) ফেনা তুলি , তার সুযোগ্য সন্তান বলে পরিচয় দেওয়ার সৌভাগ্য টুকু অন্তত সেই শিশুটির হোক ! এই প্রজন্ম থেকে যদি সেই শিশুটিই শিক্ষামন্ত্রী হয়ে আসে , তাহলে সে বুকে থাবা দিয়ে বলতে পারবে ,
“আমি আমার পিতার জারজ সন্তান ছিলাম না”

আর বাবা মায়েদের একটা কথা ,
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে রত্নগর্ভা বলেপরিচয় দিতে যারা মিথ্যাকেই ভিত্তি হিসেবে দিয়েছেন,তাদেরকে বলছি......
***আপনার সন্তান হয়ত দেশের মহামানব হিসেবে জন্মেছে,হয়ত আপনি তা জানেন না। তার হাতে মিথ্যার তরবারি তুলে দেওয়ার আগে ,সক্রেটিসের কথা একবার স্মরন করুন ,এর বদলে তার হাতে হেমলক তুলে দিন ,অন্তত ভবিষ্যতে হাত ভর্তি কালো টাক নিয়ে মরার চেয়ে এখন সে একজন শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে মরতে পারবে ।

যোগেন্দ্রনাথের কবিতার "কাজের ছেলে" কে আমাদের দরকার নেই , "ভোলা_ভূতো_হাবা" কেই দেশটার বড় দরকার ।
অন্তত তখন বাহবা বাহবা দাঁতে দাঁত চেপে বলতে হবে না ।


৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×