মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ডেসটিনি গ্রুপ ২০২১ সালের মধ্যে সারা দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রায় ১ কোটি বিদেশী প্রজাতির পাউলোনিয়া গাছ রোপণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ডেসটিনির এ ‘মনোপ্ল্যানটেশনের’ কাজ শুরু হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো অনুমোদন নেই। ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ পাউলোনিয়া রোপণের ‘অনুমোদন’ রয়েছে দাবি করলেও গতকাল রোববার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, অনুমোদনহীন এসব গাছ লাগানোর বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বৃক্ষ রোপণের জন্য যে ধরনের প্রকৃতিগত সহায়তা প্রয়োজন তা বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আছে বলে দাবি করছে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। তবে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বিদেশী প্রজাতির গাছ রোপণ এবং মনোপ্ল্যানটেশন বাংলাদেশের পরিবেশকে বিপাকের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ জানায়, অন্যান্য প্যাকেজের পাশাপাশি পাউলোনিয়া রুটস প্যাকেজের মাধ্যমে পাউলোনিয়া গাছের ১৫টি করে শেকড় একজন ভোক্তার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এ জন্য ডেসটিনি গ্রুপ দাম নিচ্ছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। প্যাকেজটি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সেøাগান হলোÑ ‘মিলে-মিশে পাউলোনিয়া বৃক্ষরোপণ করবো, আমরাই সবুজ বাংলাদেশ গড়বো’।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা জানান, দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী হাইব্রিড প্রজাতির গাছ পাউলোনিয়া। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘পাউলোনিয়া ইলাংগাটা’। বিশ্বে প্রায় ১৭ প্রকার পাউলোনিয়া প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে পাউলোনিয়া ইলাংগাটাই বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত। পাউলোনিয়া গাছের প্রথম দেখা মেলে চীনে। এ গাছের পাতা দেখতে অনেকটা
হৃদপি-ের মতো। আকারও অনেকটা বড়। নেদারল্যান্ডসের রানী ‘আন্না পাউলোনা’-এর নামে এ গাছের নামকরণ হয় পাউলোনিয়া। ১৭৯৫ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের রানী ছিলেন তিনি।
দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পাউলোনিয়া সম্পর্কিত তথ্য থেকে জানা গেছে, পাঁচ থেকে সাত বছরের ভেতরে ৫০ ফুট লম্বা হয় পাউলোনিয়া গাছ। এ গাছের শেকড় ১০০ ফুট মাটির গভীরে ঢুকে পানি শোষণ করতে পারে। পাউলোনিয়া গাছের জন্ম হয় শেকড় থেকে। গাছ কেটে ফেলার পর তার শেকড় থেকে আরো অনেক গাছের জন্ম হয়। এ গাছ শুরুর বছরে ১০ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। পরের বছর বাড়ে পাঁচ থেকে ১০ ফুট। ১০ বছরে ৪০ থেকে ৬০ ফুট লম্বা হয় এ গাছ।
পাউলোনিয়া গাছের ফুল গুচ্ছাকারে ফোটে বলে তা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এ গাছ গিঁটম্ক্তুভাবে বেড়ে ওঠে বলে এ গাছের কাঠ হয় হালকা ও মসৃণ। প্রথমবার কাঠ সংগ্রহের পর দ্বিতীয়বার আপনা আপনিই এ গাছ জন্ম নেয়।
পাউলোনিয়া গাছের মার্কেটিং ও এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডেসটিনি এমএলএম কোম্পানির মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন ডিপার্টমেন্টের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার রফিকুল ইসলাম সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, ডেসটিনির এ বনায়ন প্রকল্প দেশে এক বিপ্লব সৃষ্টি করবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক বিরাট দ্বার উন্মেচিত হবে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য দেশে বাণিজ্যিক বনায়ন বিশেষভাবে প্রয়োজন।
এদিকে পাউলোনিয়া গাছ রোপণের বিষয়ে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও বিশেজ্ঞরা সম্পূর্ণভাবে বিপক্ষে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বিদেশী এ গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত দেশের পরিবেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে বলে অভিমত দিয়েছেন। তিনি বলেন, গাছকে কেবল গাছ বা বাণিজ্যিক প্রোডাক্ট হিসেবে ভাবলে চলবে না। বিশাল ‘বায়ো ডাইভার্সিটির আধার’ হলো বৃক্ষ। কোন গাছ কোন খানে জন্ম নেবে তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। তিনি বলেন, বিদেশী গাছের সঙ্গে দেশের প্রাণী প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এসব গাছের ওপর দেশী পাখিরা বসে না।
ইউক্যালিপ্টাস গাছের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর পর এ গাছ পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা হবে অপূরণীয়। সেখানে নতুন করে বিদেশী গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত আমরা কিভাবে নিই?
এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মতিন বলেন, এসব গাছের কোনো বিষক্রিয়া আছে কিনা সে কথাও আমাদের জানা নেই। এমন আগন্তুক গাছের ব্যাপক বনায়নের ফলে স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত এবং কৃষিশস্যের পরিস্থিতি হুমকির সম্মুখীন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, আলাদা করে গাছ লাগিয়ে বন তৈরি করা যায় না। বনায়ন হলো প্রাকৃতিক বন রক্ষা করা এবং তা বিকশিত হতে দেয়া।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, মহাসর্বনাশা এ উদ্যোগকে সরকারের থামিয়ে দেয়া উচিত।
পরিবেশ আন্দোলনের আবু নাসের খান বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বিদেশী গাছ যাতে না লাগানো হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
পাউলোনিয়া বৃক্ষরোপণ সম্পর্কে বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন, বিদেশী বৃক্ষরোপণের আগে মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাবে কিনা সে সম্পর্কে ভাবনার অবকাশ থাকে। তিনি এ সম্পর্কে সরকারকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একটি দেশের পরিবেশ ভারসাম্য নিয়ে সরকারই কেবল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।
একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে বিদেশী গাছ রোপণকে কোনোভাবেই সমর্থন দিতে পারেন না বলে অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন। অতীতে এরকম বনায়নের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, বিদেশী প্রজাতির গাছ ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমণি রোপণে আমাদের পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কয়েক দশক ধরে আমরা সে সমাধান দিতে পারিনি। ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমণির পানি শোষণ ক্ষমতা অন্যান্য গাছের চেয়ে অনেক বেশি। তার আশপাশে দেশী প্রজাতির গাছ জন্ম নেয় না। তিনি বলেন, যেখানে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান দিতে আমরা ব্যর্থ, সেখানে নতুন সমস্যাকে আহ্বান করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
এ গাছ রোপণ করে চীন বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে, আমরা কি তা করতে পারি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জসীম বলেন, এটি চীনের ‘নেটিভ প্ল্যান্ট’। তিনি জানান, এ গাছ রোপণ করতে হলে গাছের সঙ্গে খাদ্যচক্রের সম্পর্ক আছে এমন প্রাণী আনতে হবে। কীটপতঙ্গ নিয়ে আসতে হবে, লতাগুল্ম নিয়ে আসতে হবে। বাস্তবিকভাবে যা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ আইন মেনে গাছ লাগাচ্ছে কিনা সে বিষয়টি অবশ্যই মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখবে।
পরিবেশবিদ ও উদ্ভিদবিদরা জানান, ‘কোয়ারেন্টাইন অ্যাক্ট’ মেনে বিদেশী গাছ রোপণ করতে হবে। তা না হলে সেটি দ-নীয় অপরাধ হবে। বিদেশ থেকে কোনো উদ্ভিদ বাংলাদেশে আনলে সেটার সঙ্গে কোনো রোগজীবাণু আছে কিনা কোয়ারেন্টাইন বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে সেটা। তারপর অনুমতি দেবে চাষাবাদের। বিদেশী প্রজাতির গাছ পরীক্ষামূলকভাবে বাগানে চাষ করতে হবে প্রথমে। চাষ করে দেখতে হবে সেটার উৎপাদন ক্ষমতা, ফলনশীলতা এবং এর সঙ্গে এ দেশের পরিবেশের কোনো সাংঘর্ষিক ব্যাপার আছে কিনা। দেশীয় প্রজাতিগুলোকে আক্রান্ত করবে কিনা। এগুলো দেখার পরই লাগানোর অনুমতি পাবে কর্তৃপক্ষ। তবে তাও সরাসরি লাগানোর অনুমতি দেয়া হবে না। কোয়ারেন্টাইন বিভাগের বিভিন্ন জেলাতে কিছু সাব-সেন্টার আছে। প্রথমে সেগুলোতে লাগাতে হবে। কোয়ারেন্টাইন বিভাগের অনুমোদনের পর সরকারি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তা রোপণ করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বিদেশী গাছ রোপণ করলে তা হবে বেআইনি।
‘কোয়ারেন্টাইন অ্যাক্ট-২০০০’ অনুসরণ করে এ প্যাকেজ ছাড়া হচ্ছে কিনা তা জানতে চাইলে ডেসটিনি গ্রুপের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিপার্টমেন্টের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বলেন, ‘সবকিছু’ মেনেই আমরা এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তিনি জানান, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ডেসটিনি এ গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ডাটা বা প্রমাণ আছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, আমরা জানি না এ গাছ আমাদের আবহাওয়া, জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাবে কিনা বা এ দেশের পশুপাখি কীটপতঙ্গের জীবনাচরণকে এ বৃক্ষ সাপোর্ট দেবে কিনা। তিনি বলেন, এ গাছের পাতার আকারও অনেকটা বড়। এ গাছের ছায়ায় অন্য কোনো দেশী গাছ টিকতে পারে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা আছে। এ বৃক্ষরোপণ স্বদেশী বনবৃক্ষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন, ২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি কোয়ারেন্টাইন অ্যাক্ট অনুমোদন করেছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা। এ আইন অনুসারে বিদেশী গাছ রোপণের ক্ষেত্রে এই গাছে কোনো রোগ-জীবাণু আছে কিনা তা রোপণ করার আগে নিশ্চিত করতে হবে।
www.bhorerkagoj.net

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




