somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেদিন বৃষ্টির পর

১১ ই মে, ২০১৭ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেদিন বৃষ্টির পূর্ব্যাবধি ঠিকঠাক চলছিল সবকিছু।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল ঠিকঠাক। টবে লতানো গাছটি জড়িয়ে ছিল তার একান্ত অবলম্বন। আদিবাসী মেয়েটি ঘরে ঢুকে পাল্টে দিচ্ছিল বিছানার চাদর, গুছিয়ে দিচ্ছিল বই-পত্র, খুলে দিচ্ছিল একঘেয়ে জানালাগুলো। শোনা যাচ্ছিল বাথরুমে ভ্রান্ত ঝর্ণার কলোরল।
জেসিকার মাইনাস ফিফটিন পাওয়ারের চশমা ঝুলছিল তার নাকের ডগায়। সামনে মেলে ধরা ছিল কোনো বিদেশী ঠাকুরের মোটা বই। ভেজা ভেজা নম্র চুলগুলি জড়িয়ে ধরেছিল তার খোলা পিঠ। আমার জন্যই জেসিকা তার নম্র চুলগুলো দিয়ে খোলা পিঠ ঢেকে রাখে। যেন আমি কষ্ট করে চুলগুলি সরিয়ে চুমু খাই তার খোলা পিঠে, এবং ঘাড়ে, এবং চিবুকে, এবং ওষ্ঠে, এবং বুকে এবং যত্রতত্র। সে জানে- চুমু খেতে আমি কৃপণতা করি না কখনো। সে জানে- নিষেধ সত্ত্বেও আমি চুমু খাই তাকে। যেহেতু আমি জানি- নিষেধ সত্ত্বেও চুমু খেতে জেসিকা বেশি ভালোবাসে।
সেদিনও জেসিকার ভেজা খোলা পিঠে চুমু খেতে গেলে নিষেধ করেছিল সে। আমি তার নিষেধ মানিনি। আমি হয়ে উঠেছিলাম সেদিন কোনো কুখ্যাত প্রেমিক। যে প্রেমিক বহুজন্ম আগে প্রেমিকার সান্নিধ্য পেতে ঝাঁপ দিয়েছিল জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে।
গতজন্ম বলে একটা জিনিস অনেকেই বিশ্বাস করে। আমি জানি না আমার কোনো গতজন্ম আছে কিনা। গতজন্মে আমি চোর, ডাকাত, খুনী, লম্পট কিংবা সাধু - যাই হই না কেনো;- এ জন্মে আমি শুধুই জেসিকার প্রেমিক। তাকে প্রেমের সাম্পানে অকূল পাথারে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমার দায়িত্ব।
আমাদের বিয়ের বয়স একবছর হতে চলল। বিয়ের পরপরই জেসিকা একটি প্রাইভেট হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে জয়েন করে। সে ডাক্তার হলেও সংস্কৃতমনা। ডাক্তারিটা সে মানবসেবার হাতিয়ার হিসেবেই বেছে নিয়েছে। সে শুধু ডাক্তারিই করতে চায়, ডাক্তারির নামে ডাকাতি নয়। শিফটিং এর কারণে জেসিকার সাথে প্রতিরাতে আমার দেখা হয় না। আমার ছুটির দিন হলো শুক্রবার। এমন অনেক শুক্রবার আমি একাকী কাটিয়েছি।
কিন্তু সেদিন শুক্রবার জেসিকার ছুটি ছিল। আমরা ছুটিটা দু’জন একসঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করি।
হ্যাঁ-সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারময় একটি দিন। এই দিনটি ভোলা হবে না আমার আর কোনোদিন। স্মৃতির লকাপে ঢুকে গিয়েছে বৃষ্টিস্নাত অদ্ভুতুড়ে ওই শুক্রবার।
জেসিকা আর আমি মিরপুরে আমার এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে যাই। খুব সম্প্রতি ওরা বিয়ে করেছে। ওদেরও সন্তান নেই, আমাদেরও নেই। যারা অর্থনীতি সম্পর্কে হালকা ধারণাটুকু রাখে, তারা এ বাজারে এতো সহজে কেনো সন্তান নিতে যাবে?
কিন্তু জেসিকা এসব পরিসংখ্যানে একদমই কাঁচা। বিয়ের দু’মাস পর থেকেই ওর স্লোগান হয়ে উঠেছে - ‘বাচ্চা কবে নেবে, বলো তো?’ প্রেমের অকূল পাথারে তাকে ভাসাতে ভাসাতে এবং নিজে ডুবতে ডুবতে বাধ্য হয়ে আমি বলি, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই / ছোটো সে তরী।’
আমরা দু’জন হয়তো ভাসছি প্রেমের তরীতে, কিন্তু সংসার ভাসছে ডিঙ্গি নৌকাতে। এ কথাটা জেসিকাকে বোঝানো আজকাল বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বন্ধুর বাসায় ডিনার সেরে বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক বেশ বৃষ্টি হয়েছে। বন্ধু ও বন্ধু স্ত্রী বলছিল ‘থেকে যেতে’।
কিন্তু পরের দিন ভোরে জেসিকার ডিউটি থাকায় সে অনুরোধ রাখা গেল না। তাই বেরোতেই হলো।
মোটরসাইকেলের পেছনে বসতে বসতে জেসিকা বললো, ‘সাবধানে চালাবে কিন্তু।’
আমি শুধু ‘হুম’ বলে স্টার্ট দিলাম।
সারা রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে ছিল। আমাকে গতি একটু বাড়াতেই হলো। ভেজা রাস্তায় বেশি সাবধানতা দেখাতে গিয়ে স্লো চালালে হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু শরীরটা খুব টায়ার্ড লাগছিল। চোখ দু’টো লেগে আসতে চাচ্ছিল। দুই কি তিন সেকেন্ডের জন্য চোখটা বন্ধ হতেই দুম্ করে একটা শব্দ হলো। কিছু একটার সাথে মোটরসাইকেল ধাক্কা লেগেছে। আমি অনেক কষ্টে ব্যালেন্স ঠিক রাখলাম। একবার পেছনে তাকালাম। বুঝলাম কোনো মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। রাস্তায় তেমন গাড়িঘোড়া নেই। আমি সাথে সাথে গিয়ার বাড়িয়ে দিলাম। জেসিকা মনে হয় ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ঘোর কাটতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুয়িং?’
আমি জেসিকার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। জেসিকা উত্তেজিত হতে লাগল। একসময় আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। আমি ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আমাকে থামাতে হলো। মিনিট পাঁচেক এ নিয়ে জেসিকার সাথে তর্কাতর্কি হলো। আমার যুক্তি সে মানবে না। সে ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিল।
আমি আবার মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম।
মিনিট পাঁচেক পরেই আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম দু’জন লোক ভিকটিমকে ধরে ফুটপাতের কাছে নিয়ে এসেছে। জেসিকা এগিয়ে গেল। আমিও এগিয়ে গেলাম। ভিকটিম একটা নয়-দশ বছরের বাচ্চা। পেট ফেড়ে গেছে, মাথা ফেটে প্রচুর রক্ত ঝরছে। বোঝা যাচ্ছিল না বেঁচে আছে না মরে গেছে।
জেসিকা তার ডাক্তারের পরিচয়পত্র দেখাতেই সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কেউ বুঝতেই পারেনি যে আমার মোটরসাইকেলেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। আমি একটা সি.এন.জি এনে জেসিকা ও বাচ্চাটিকে উঠিয়ে দিলাম। প্রত্যক্ষদর্শী আছে কিনা এতক্ষণ আমি এই ভাবনাতেই বিভোর ছিলাম। ভাবনাটা দূর হতেই খেয়াল হলো বাচ্চাটার কথা। জেসিকা কোলে নিয়ে ওকে বসে আছে সি.এন.জি-তে।
একবার জেসিকার মুখের দিকে তাকালাম। ভয়, বেদনা, বিস্ময়, হতাশা মিলেমিশে অদ্ভুত হয়ে গেছে তার মুখ। সবুজ শাড়ি প্লাবিত হচ্ছিল লাল রক্তে। মনে হচ্ছিল এটাই আমার দেশের পতাকা।
জেসিকা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাইক নিয়ে আমাদের ফলো করো। সময় খুব কম।’
আমি হকচকিয়ে গেলাম।
এ কে? জেসিকা? কোন্ জেসিকা? আমার স্ত্রী? আমার প্রেমিকা? না’কি একজন আদর্শ ডাক্তার? না’কি কোনো ভয়ার্ত মা? না’কি কোনো সাহসী মা? কার মা?
সি.এন.জি স্টার্ট নিল। আমিও মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম। ইঞ্জিন স্টার্ট দিলে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ হয় সবাই জানে। এতোদিন তা মনে হয় কান দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছাতো। কিন্তু আজ মনে হলো কান দিয়ে সেই শব্দ ভেতরে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে গেল। হঠাৎ মনে হলো ইঞ্জিনের মতোই হৃৎপিণ্ড স্টার্ট নিল।
তবে কি আমি এতোদিন মৃত ছিলাম? এতোদিন কি তবে হৃৎপিণ্ড ঘুমিয়ে ছিল? না’কি এতোদিন আমি বয়ে বেরিয়েছি হৃৎপিণ্ড নামক শুধুই একটা মাংসপিণ্ড?
হৃদয়ের উৎপত্তি না’কি এখানেই। তাহলে কি আজ আমার হৃদয় জেগে উঠল?
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল বাচ্চাটির মুখ। একটি নরম মুখ, একটি করুণ মুখ, একটি দু:খী মুখ, একটি ক্ষুধার্ত মুখ। একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো বুভুক্ষু বাচ্চার মুখ। যে মুখ বেয়ে এখন গড়িয়ে পড়ছে রক্তের রেখা। আমার মনে হতে লাগল ওই মুখটাই এদেশের মানচিত্র। যেই মুখ এখন মাথা গুঁজে আছে জেসিকার কোলে। জেসিকাকে আমার স্যালুট দিতে ইচ্ছে করলো।
চোখ এখন আর ঘুমে লেগে আসছে না। শুধু দু’চোখ বেয়ে কী যেন তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়লো। এটাকে যেন কী বলে - ‘কান্না’!
শব্দটা খুব মায়াবী। কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ল - আমি মানুষ; আমিও কাঁদতে জানি।
আমি ছুটে চলতে লাগলাম জেসিকার আগে আগে হসপিটালের দিকে। বাচ্চাটা বেঁচে আছে না মরে গেছে তা আমি জানি না। শুধু জানি এ লড়াইয়ে জেসিকা আমার পাশে আছে।
সেদিন বৃষ্টির পূর্ব্যাবধি ঠিকঠাক চলছিল সবকিছু।
এই যেমন রুটিনমাফিক অফিসযাত্রা। সন্ধ্যায় ফিরে তুমুল আড্ডা। রাতভর বৃষ্টির মতো জেসিকার মাঝে ঝরে পড়া।
সেদিন বৃষ্টির পর পাল্টে গেলো সবকিছু।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৭ রাত ১১:৩১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×