somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বর্ণ ব্যবসায় প্রতারণা

০৯ ই মে, ২০১১ সকাল ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শম্পা ইসলাম: ধানমন্ডির জেসমিন আক্তার এক বছর আগে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকায় কিনেছিলেন একটি সোনার হার। তিন ভরি ওজনের এ হার কেনার সময় বিক্রেতা তা ২২ ক্যারেট সোনার বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দামও নেয়া হয়েছিল ২২ ক্যারেটের হিসেবে। গত কয়েকদিন আগে ওই হারটি বিক্রি করতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে তার। এক লাখ ২৮ হাজার টাকা মূল্যের হার বিক্রি করতে হয় মাত্র ২৫ হাজার ৬০০ টাকায়। কেনার সময় খাঁটি সোনা বলে বিক্রি হলেও বিক্রির সময় দোকানি তা চিহ্নিত করলেন ভেজাল সোনা হিসেবে। আর ভেজাল বাদ দিয়ে তিন ভরির হারের আসল সোনা মিললো মাত্র এক ভরি। আর এই এক ভরি সোনাও সনাতনি বলে মূল দামের চেয়ে ২০ ভাগ বাদ দিয়ে দেয়া হয় ওই টাকা। জেসমিন দাম যাচাইয়ের জন্য একাধিক দোকানে ঘুরলেও এর বেশি দাম দিতে চায়নি কেউ। সোনার বাজারে এ ধরনের প্রতারণা চলছে হরহামেশা। হাতেগোনা কয়েকটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান সততার সঙ্গে ব্যবসা করলেও বেশির ভাগ স্বর্ণ ব্যবসায়ীই বেশি লাভের জন্য আশ্রয় নিচ্ছেন এমন প্রতারণার। এ কারণে উৎসব বা পার্বণে কেনা সোনা আনন্দের উপলক্ষ হলেও বিপদের সময়ে তা বিক্রি করতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ছে অনেকের। শুধু ভেজালই নয়, ২২ ক্যারেট বলে ২১ বা ১৮ ক্যারেটের সোনা বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে ক্রেতাদের। সোনার বাজারে এমন ভেজাল ও প্রতারণা ঠেকাতে সরকারিভাবে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। ভেজাল রোধে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি তৎপর থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে ভেজাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না তারা। এদিকে ভেজাল স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ আসে জানিয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জানিয়েছেন, অভিযোগ আসার পর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে থাকে। ওজনে ও পরিমাপে কম দেয়ার বিষয়টি শুধু মোবাইল কোর্ট দেখে থাকে। স্বর্ণের মান নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় অনেক সময় স্বর্ণের খাদ পরীক্ষা করা যায় না। তিনি জানান, অনেকে অভিযোগ করেন কেনার সময় যে ক্যারেট দেখানো হয় বিক্রির সময় তা ধরা হয় না। তখন স্বর্ণে খাদ দেখিয়ে দাম কম দেয়া হয়। র‌্যাবের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, অনেক জুয়েলারি মার্কেটে স্বর্ণের মান নির্ণয়ের জন্য যন্ত্র আছে। অল্প টাকা দিয়ে সেখানে মান নির্ণয় করা যায়। স্বর্ণ কেনার আগে যন্ত্রের মাধ্যমে মান নিশ্চিত হওয়া গেলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসটিআই স্বর্ণের ভেজাল ধরার জন্য বেশ কিছু দিন আগে দু’টি যন্ত্র কিনলেও কম দামে কেনায় এ যন্ত্র দু’টি এখন আর কাজে লাগছে না। এছাড়া, সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু স্বর্ণের ওজন ও পরিমাপের দিকটি দেখে। খাদ বা ভেজাল ধরার বিষয়ে বিএসটিআই’র কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসটিআই’র পরিচালক লুৎফর রহমান খান জানান, স্বর্ণের পরিমাপ ওজন দেখার জন্য একটি প্যাথলজি উইং আছে। তবে তারা শুধু ওজনের দিকটি দেখেন। ভেজাল বা খাদ নির্ণয়ে এখনও সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও বিএসটিআই’র নেই। স্বর্ণের ভেজাল নির্ণয়ের জন্য সামনে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান বিএসটিআই’র এই কর্মকর্তা।
রাজধানীর স্বর্ণের বাজার সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, পুরাতন স্বর্ণ যারা বিক্রি করতে যাচ্ছেন তাদের স্বর্ণে ৮ থেকে ১১ আনা পর্যন্ত খাত দেখানো হচ্ছে। একই স্বর্ণ কিনে খাদ মিশিয়ে তা নতুন হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। তাঁতীবাজারের এক স্বর্ণকারিগর পলাশ জানান, একমাত্র স্বর্ণকারিগর আর ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ স্বর্ণে খাদ ধরতে পারে না। ৩ ভরি ওজনের হারে কিভাবে এক ভরি স্বর্ণ হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন- এই ৩ ভরি ওজনের হারে দেয়া হয়েছে এক ভরি সোনা তার সঙ্গে এক ভরি ১০ আনা তামা ও ৬ আনা রূপার খাদ। তাঁতীবাজারের আরেক স্বর্ণকারিগর বরুণ জানান, ২২ ক্যারেট সোনার গহনা খুব কমই তৈরি হয়। বিভিন্ন দোকানে ১৮ ক্যারেটের সোনার গহনাকে এখন ২২ ক্যারেট বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিনতে গিয়ে কেউই এসব যাচাই করেন না। সবাই বিশ্বাস করেই স্বর্ণ কিনে থাকেন। ওই স্বর্ণ কারিগর জানান, খাঁটি সোনার রঙ অনেকটা হলুদাভ হয়ে থাকে। তারপরও বাজারে অনেক রঙের সোনা দেখা যায়। এ রঙ নির্ভর করে স্বর্ণের সঙ্গে কোন খাদ কি পরিমাণ মেশানো হয়েছে তার ওপর। স্বর্ণের সঙ্গে রূপা মেশালে সবুজাভ রঙ ধারণ করে। তামা মেশালে ধারণ করে লালচে রঙ। আর খাদ হিসেবে ৫০ ভাগ তামা ও ৫০ ভাগ রূপার শঙ্কর ব্যবহার করলে তা হয়ে যায় খাঁটি স্বর্ণের মতো হলুদ। তাঁতীবাজারের আরেক স্বর্ণকারিগর পীযূষ জানান, সোনা পাকাতে লাগে নাইট্রিক এসিড। আর সোনায় খাদ দিতে লাগে খাঁটি তামা, রূপা ও ব্রোঞ্জ। ইদানীং পিতলও ব্যবহার করা হচ্ছে। তামা, পিতল, ব্রোঞ্জ মিশিয়ে খাদ তৈরি করা হয়। খাদ মেশানোরও একটা নিয়ম আছে। ২২ ক্যারেটের ১ ভরি সোনায় খাদ মেশানো থাকে ১ আনা ২ রতি, ২১ ক্যারেটের ১ ভরি স্বর্ণালঙ্কারে ২ আনা ও ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণালঙ্কারে খাদ থাকবে ভরিতে ৪ আনা। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। সোনা কিনতে গিয়ে ঠকা না ঠকা নির্ভর করে দোকানদারের সততার ওপর। স্বর্ণকারিগর যতীনের কাছে ক্যারেট কি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ক্যারেট হলো পরিমাপের একক। ভরি, গ্রাম, কেজি এ সমস্ত যেমন পরিমাপের একক- ঠিক তেমনি ক্যারেটও মাপের একক। তিনি জানান, স্বর্ণালঙ্কারে খাদের মাত্রা পরীক্ষা করারও কৌশল আছে। স্বর্ণালঙ্কারের ১ কোণা কষ্টিপাথরে ঘষে তাতে নাইট্রিক এসিড ছেড়ে দিলেই খাদের মাত্রা আমরা অনুমান করতে পারি। আবার স্বর্ণালঙ্কার গলালে আসল সোনা নির্ধারণ করা যায়। খাদ বেশি মেশানো হয় নেকলেস, কানের দুলসহ বেশি ডিজাইন করা অলঙ্কারে। কেডিএম পদ্ধতিতে সোনা দিয়ে ঝালাইয়ের কাজ করা হয় বললেও মূলত খাদ দিয়েই এসব ঝালাই করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী খাদ মেশালে ২২ ক্যারেটে খাদ ১ আনা ২ রতি, ২১ ক্যারেটে ২ আনা ও ১৮ ক্যারেটে ৪ আনা খাদ মেশানো হয়। বিক্রির সময় সোনার ওজন থেকে এ খাদের ওজন বাদ দেয়া হয় না। খাদকেও সোনার দামে কিনে নিতে হয় ক্রেতাদের। স্বর্ণমান নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে কোন আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত বা ব্যবহৃত ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে কেউ কেউ এখন গোল্ড টেস্টিং-এর বিদেশী কিছু যন্ত্র আমদানি করেছে। তা-ও আবার নামীদামি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে।
আমিন জুয়েলার্স নিউমার্কেট শাখার সেলস এক্সিকিউটিভ আনিসুর রহমান হিটলু বলেন, খাদ ছাড়া কোন স্বর্ণালঙ্কার হয় না। আসল সোনা হচ্ছে ২৪ ক্যারেটের। তা বার হিসেবে থাকে। এসব বারে সোনার পরিমাণ থাকে ৯৯.৯৯ ভাগ। অলঙ্কার বানাতে তাতে অন্য ধাতুও মেশাতে হয়। বিশেষ করে তামা, রূপা ও ব্রোঞ্জের মিশ্রণেই খাদ দিতে হয়। এটিকে ভেজাল হিসেবে গণ্য করা যায় না। তিনি জানান, খাদের পরিমাণ যত বেশি হবে অলঙ্কার তত শক্ত হবে। অলঙ্কার বানানোর সময় খাদ মেশানোর পর ২২ ক্যারেটের ১ ভরিতে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ৯১ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২১ ক্যারেটের ১ ভরিতে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ৮৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। ১৮ ক্যারেটে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ৭৫ শতাংশ। নিউ মার্কেটের নিউ মাধুরী জুয়েলার্সের সেলসম্যান মো. নয়ন বলেন, সোনার আসল-নকল দেখে বোঝার উপায় নেই। ব্যবসাটাই চলছে বিশ্বাসের ওপর। আমরা অনেক সময় বিশ্বাসের ওপরই পাইকারি অলঙ্কার কিনি। ক্রেতারাও আমাদের কাছ থেকে বিশ্বাস করেই কিনে নিয়ে যান। তেমন কোন যাচাই বাছাই করেন না। খাদের হিসাবটাও অনেকটা অনুমানের ওপর ধরে নিতে হয়। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণ পরীক্ষা করার একটি প্যাথলজি আছে। সেখানে পরীক্ষা করালেই কোন সোনা কত ক্যারেটের তা নির্ণয় করা যায়। যদি কোন কাস্টমার চ্যালেঞ্জ করেন তাহলে আমরা সেখান থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনি। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি এম এ ওয়াদুদ খান স্বর্ণে ভেজাল দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, রাজধানীর সোনার দোকানগুলোতে সমিতির পক্ষ থেকে স্বর্ণে খাদ ও অন্যান্য বিষয়ে সতর্ক করে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সমিতির পক্ষ থেকে মনিটরিংও করা হয়। এরপরও কেউ এ ধরনের কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১১ সকাল ৯:০৩
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×