ঘুটঘুটে আধার জড়ানো পরিবেশে হেটে যাচ্ছে অভ্র! এতটাই অন্ধকার যে সে নিজের হাতটাও ঠিক মত দেখতে পাচ্ছে না! একটার পর একটা দিয়াশলাই এর কাঠি জ্বালিয়ে একটু একটু করে আগাচ্ছে সে। হুট করে একটা আলো, ঝলমলে আলো দেখতে পেল সে৷ এবারও সে নিশ্চিত ওই আলোটা কাছে গেলেই পাবে না! হঠাৎ তার কানে এল কেউ একজনের পায়ের আওয়াজ! অভ্র সাথে সাথে পিছনে ফিরল! দিয়াশলাই এর অতটুকু আলোতে কাউকে খুঁজে পেল না! একটুপর খেয়াল করল পদচারণার আওয়াজ তার চারপাশ থেকে আসছে! লোকালয়ের খুব কাছে চলে এসেছে হয়তো! হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, "পথ হারিয়ে ফেলছো?"
"কে বললে এটা? কে? সামনে এসো, সামনে এসে বল!" কোন উত্তর এল না! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অভ্রের!
অভ্র আবারও হাটতে শুরু করল সেই আলোর দিকে। একটুপরেই অভ্র কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেল! বিভিন্ন স্থানে ধরে প্রাথমিকভাবে ধারণা নিল এটা একটা দেয়াল। দিয়াশলাই কাঠিগুলো এক এক করে জালিয়ে দেখল সেখানে লেখা আছে "যশোহর জংশন"! একটু পরেই ট্রেনের আওয়াজ এল, যেই আলোটার দিক থেকে হাটা শুরু করেছিল সেদিক থেকে। অভ্র খুবই ভয় পাচ্ছে! একটা হাসির আওয়াজ এল তার কানে! সাদা কাপড় পরা সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক এসে পাশে বসল। কিন্তু তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না! পাশে এসে বসার সাথে সাথে হাসতে শুরু করল আর বলল, "অভ্র, এই সেই স্টেশন না?" আবারও চিৎকার দিয়ে হাসতে শুরু করলো সে! কণ্ঠ মনে রাখতে পারে না সে। কিছুক্ষণ পর আরও একটা আওয়াজ কানে এল অভ্রের! এদিকে ট্রেনের আওয়াজ আরও স্পষ্ট হচ্ছে! অভ্র শেষ দিয়াশলাই এর কাঠি জালিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে ছুড়ে মারল। মাটিতে পরে যাওয়া হালকা নিভু নিভু আগুনটাও হঠাৎ বেড়ে গেল! এর পাশেই কে যেন এসে দাড়ালো। জ্বলন্ত কাঠিটা মাটি থেকে তুলে নিল সে। অভ্র দেখলো এবার রাজকীয় পোশাক পরে এল এক সুন্দরী তরুনী! কিন্তু তারও মুখ দেখা যাচ্ছে না! তবে সে হাসছে না! কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার দিকে খুব মায়াবী আর দুঃখ নিয়ে তাকিয়ে আছে! হঠাৎ তার চোখজোড়া দৃশ্যমান হয়ে উঠল! এক পর্যায়ে কান্না শুরু করে দিল! সাদা পোশাকের যুবক আর সেই নারীর হাসি কান্না একসাথে বেজে উঠছে! সহ্য করার মত নয় এই দৃশ্য! সেই তরুনী হঠাৎ ফু দিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিল! আবারও ঘুটঘুটে অন্ধকার! এবার ট্রেনের আওয়াজ আরও স্পষ্ট হয়ে আসল। বাতিটা এতটাই তেজ আলো দিচ্ছে যার ফলে অভ্র আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না! হঠাৎই অভ্রের দুইহাত ধরে কারা যেন রেললাইনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে! অভ্র অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু পারছে না! কিছু একটা বলতে যাবে সেটাও বের হচ্ছে না! শব্দগুলো আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎই কারা যেন বলল, "বিদায় অভ্র! প্রতি ঘুমে দেখা হবে!" এই বলে ধাক্কা দিল অভ্রকে। এক পর্যায়ে অভ্র আর সহ্য করতে পারল না সে! ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে পরল! ঠাণ্ডা রাতেও ঘেমে একাকার সে!
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত ৩টা ১৭বাজে! এদিক সেদিক হাটাহাটি করে আবারও শুয়ে পরলো কিন্তু ঘুম আর আসছে না তার!
"কপাল ভাল তুই টিকেট করে রাখছিলি! না হলে এই ভিড়ে টিকেট পাওয়াই মুশকিল!"
প্লাটফর্মে বসে হামজা আর হুজাইফার কথোপকথন। হামজাকে বিদায় দিতে এসেছে সে। তারা দুইজন চাচাতো ভাই এবং বয়সে এক বছরের ছোট বড়! ট্রেন প্লাটফর্মে দারিয়ে আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে ভিতরে তাই কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না! একটুপরেই মাইকে বলতে শুরু করল, "টিকেট ব্যতীত কেউ প্লাটফর্মে প্রবেশ করবেন না!" একথা শুনে হামজা হাসতে শুরু করল! হুজাইফা বলল, "এখন বের হই কিভাবে?"
হামজা বলল, "চল তোকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি, না হলে জরিমানা করতে পারে!" দুইভাই কথাবার্তা চালিয়ে হাটা শুরু করল। গেটে আসতেই হামজা বলল, "তো ঈদে দেখা হচ্ছে তাহলে? আসবি না?" হুজাইফা বলল, "আল্লাহ ভরসা, বছরে একবারই যাওয়া হয় গ্রামে তাও যদি না যাই... আব্বু এবার যাবে বলছে।" বিদায় নিয়ে আবার প্লাটফর্মের দিকে হাটা দিল হামজা।
টিকেট বের করে দেখল কোচ নং "চ" সিট ৪৩! ট্রেনে উঠে সিট খুজতে লাগলো। সিট দেখেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল হামজার! সিঙ্গেল সিট, এই প্রথম ট্রেন জার্নিতে এত ভাল সিট পরল। ব্যাগপত্র রেখে বসতে যাবে তখনই এক মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যালো ভাইয়া, এটা কি চ নম্বর বগি?"
হামজা স্বাভাবিকভাবে বললো, "জ্বি জ্বি!"
মেয়েটা আবারও বলল, "আসলে কোন বগিতে উঠেছি খেয়ালই করি নি! আর ৫২ নং সিট খুজছি।" হামজা আশেপাশে তাকিয়ে ৫২ নম্বর সিট খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ খেয়াল করল ৫২ নম্বর সিট তার মুখোমুখি সিঙ্গেল সিটটা! হামজা দেখিয়ে দিল তাকে। এবার সে খেয়াল করল মেয়েটার চেহারার দিকে। কোথায় যেন দেখেছে তাকে কিন্তু মনে করতে পারছে না!
হুইশেলের সাথে চলতে শুরু করল। হামজা কিছু বলতে যাবে কিন্তু আর বললো না। ধীরে ধীরে ট্রেনের কামরাগুলো যাত্রীর ভীরে পূর্ণ হতে থাকলো। সুন্দরবন ট্রেন, খুলনা লাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের এরচেয়ে বাজে অবস্থা দ্বিতীয় কোনো ট্রেনে নেই! যখনই কোন স্টেশনে থামে দারানো মানুষজন সামনের দিকে হোচট খায়! খানিকক্ষণ পরেই ট্রেন আপনা-আপনি চার পাঁচ কদম পিছনে চলে যায়! এই ট্রেনের এমন বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। এমন চলতে চলতে হঠাৎ হামজা মেয়েটার দিকে খেয়াল করলো। কেমন যেন তাকে অস্থির অস্থির লাগছে! হামজা ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলো, "আ... আপু আপনার কি শরীর খারাপ? কেমন যেন অসুস্থ লাগছে আপনাকে দেখে!" মেয়েটা বলল, "আসলে ট্রেনের গতির বিপরীতে বসেছি তো তাই জানালায় তাকালেই মাথা ঘুরছে!" হামজা বুঝতে পেরে বললো, "তাহলে আপনি আমার সিটে বসেন, জার্নির শেষ পর্যন্ত! আপনার গন্তব্য এলেই আমি আমার সিটে বসবো!"
তারা দুইজন সিট চেঞ্জ করে নিল। মেয়েটা যেন এক দীর্ঘশ্বাস পেল। হামজা আর কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটা স্বাভাবিক হয়ে উঠে বলল, "ভাইয়া আপনাকে ধন্যবাদ।" হামজা বলল, "আরে না আপু, ধন্যবাদ কিসের! আমার মনে হল তাই আরকি!"
মেয়েটা বলল, "আসলে এটা আমার দ্বিতীয় ট্রেন জার্নি, এখনও অভ্যাস হয়ে উঠে নি একা একা জার্নি করার। বাসে টিকেট পাই নি তাই ট্রেন একমাত্র উপায়।"
"ওহ আচ্ছা, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।"
সে একটু চুপ থেকে বলল, "আ... আপনার নামটা জানা হল না! তার আগে আমার পরিচয় দিই, আমি মীম, আসমাউল হুসনা মীম।"
"জ্বি, আমি হামজা, আমির বিন হামজা"
এভাবেই শুরু হল সেদিনের কথা। আস্তে আস্তে অনেক কথাই বললো দুইজন। কিন্তু হামজা এখনও মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে একে! কথায় কথায় মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, "আপনি কি পড়াশোনা করেন নাকি চাকরি?" সে উত্তরে বলল, "না না মাত্র অনার্স ভর্তি হলাম দুইদিন আগে!" হামজা আবারও জিজ্ঞেস করল, "আপনি যাচ্ছেন কোথায়?"
"যশোর, যশোর ক্যান্টনমেন্ট। এই কয়েক বছর আগেই শিফট হয়েছি সেখানে।"
- আ.. আঙ্কেল কি ডিফেন্সে আছেন?
- জ্বি জ্বি! আমার রিলেটিভদের ৯০% ডিফেন্সে! আর আব্বু সবসময় বলে যে জীবনে থ্রিল, রোমাঞ্চ আর চ্যালেঞ্জ নাই সেটা লবণবিহীন তরকারির মত! কোন স্বাদ নেই! আব্বু চ্যালেঞ্জ খুবই পছন্দ করেন।"
দেখতে দেখতে যাত্রার এক অংশ পারি দিল তারা! অনেকক্ষণ ধরে ট্রেন এক স্টেশনে দারিয়ে আছে। বিরক্ত লেগে যাচ্ছে!
"প্রত্যেকবারই এখানে ট্রেন অনেক সময় ধরে বসে থাকে, বিরক্তিকর!" মীমের কথা শুনে বলল, "আসলে সেতু পূর্ব স্টেশন, এখানে লাইন ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা করা লাগে, দেখেন না কেমন পিপড়ার গতিতে ব্রিজে ট্রেন চলে!"
কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেল আরেকটা ট্রেন ক্রস করে চলে গেল। আবারও ট্রেন চলতে শুরু করল! হামজা দেখল মীম ঘড়ি বের করল। হামজার তাকিয়ে থাকা দেখে মীম বললো, "ওহ আসলে স্টপওয়াচ চালু করলাম, দেখি কত সময় লাগে!" হামজা বলল, "প্রায় সতেরো মিনিট লাগবে।"
"আপনার দেখি এসব ভালই জানেন!" মীমের কথায় হামজা বললো, "আসলে আমার দাদার বাড়ি ছিল এখানেই। আর এতবার ট্রেন জার্নি হয়েছে যে প্রায় সবই মাথায় গেথে আছে।"
"কি রে হিরো? কি অবস্থা তোর?" মিল্লাত পাশে এসে বসলো। অভ্র একরাশ বিরক্ত নিয়ে বলল, "এতক্ষণ ঠিক ছিলাম কিন্তু এখন নাই!"
মিল্লাত হেসে বলল, "হো!!! আমি আসছি বলে, তাই তো? কি গুরু কি করিস এখানে?"
"দেখতেছি!"
"কি দেখিস?" "কিছু দেখি না, ভাবতেছি।"
"কি নিয়ে? রিয়া নাকি সুমনা?"
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, "ওই তরে কোনদিন কইছি আমি ওই দুইজনের একজনরেও পছন্দ করি?"
"ওহ আচ্ছা আচ্ছা! বিষয় কি?"
"নতুন ব্যাচ আসবে আর দুই সপ্তাহের মধ্যে। এবারও দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে, জুনিয়রদের দেয়া যাবে না, গতবার সিনিয়ররা অনেক অপমান করছে এবার সেটা হতে দেয়া যাবে না।"
মিল্লাত অনেক ভেবে বললো, "বাদ দে না রে ভাই, কিসব নিয়া আছিস এখনও! আমাদের সামনে সময় কম, ফিউচার বলেও তো একটা কথা আছে বাকি?"
"হাতে এখনও নয়মাস সময় আছে, এরমধ্যে ক্রিকেট, ফুটবলসহ আরও নানা খেলার আয়োজন আছে! ভ্যালেন্টাইনস, পহেলা বৈশাখসহ আরও নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান! কোনোটাতেই অন্য ব্যাচকে নাক গলাতে দেয়া যাবে না।" অভ্র বলল। সে আবারও বলল, "আমি এভাবে ভার্সিটি শেষ করতে চাই না, আমি চাই সবাই আমার নাম মনে রাখবে।" মিল্লাত বলল, "অনেক মেয়েই তোর নাম মনে রাখছে!"
"ধুর হারামজাদা, বাইর হ, দুর হ, যা ভাগ, আজকে তরে যদি আর সামনে পাই তাহলে খবর করে ফেলব।" মিল্লাতকে তারিয়ে দিল অভ্র!
অভ্র, খিটখিটে মেজাজের ছেলে, উচা-লম্বা, ফিট ফিটনেস, দেখতে কোনো নায়কের চেয়ে কম না! যেটা একবার ভাবে সেটা করেই ছাড়ে। ক্লাসে ওর উপর সাথে কথা বলার সাহস কেউ পায় না। অভ্রের পার্সোনালিটি অনেক মেয়েকেই বশ করে ফেলে কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দেয় না! বরং বেশ গর্বের সাথে এভোয়েড করে থাকে।
"হ্যালো, এক্সকিউজ মি, মীম! মীম!" একটু পর চোখ খুললো মীমের। হামজা আবারও বললো, "যাক উঠেছেন, না হলে খুলনা পৌঁছে যেতেন।"
"স্টেশনে এসে গেছে?"
"না, তবে সামনেই স্টেশন। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা দিয়ে যাচ্ছি।" মীম চার্জার, ফোন, ইয়ারফোন সবই ব্যাগে ঢুকালো। গোছগাছ শেষে বলল, "অনেক তাড়াতাড়ি এসে পরলাম মনে হচ্ছে!" মীমের কথায় হামজা বলল, "তা ঠিক, চুয়াডাঙ্গা থেকে যেভাবে ঘুমে তলিয়ে গেলেন সেটা যমুনা বা ঢাকা থেকে শুরু করলে আরও আগেই পৌঁছে যেতেন।"
মীম হেসে দিল।
ট্রেনের গতি কমে আসতে শুরু করল, হামজা আশেপাশে দেখে নিল কিছু রেখে দিল কিনা। স্টেশনে ট্রেন থামতেই নামার জন্য বের হল তারা। মীম বলল, "আশাকরি আবার কোনো এক সময়ে দেখা হবে।" হামজা বলল, "যশোর বেশ ছোট একটা শহর! মানুষ হাটতে বের হলেই পরিচিত অনেকের সাথে না চাইতেও দেখা হয়ে যায়। কোথাও হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে।"
মীম কোনো উত্তর করলো না। গেটের বাইরে হামজা দারিয়ে আছে রিক্সার জন্য। মীম এসে বলল, "আ... আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভাল লাগলো। আসি, দোয়া করবেন।"
"জ্বি ইনশাআল্লাহ, আর আপনার এই স্টপওয়াচটা নিয়ে নিন। ফেলে এসেছিলেন সিটে।" মীম আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। হামজাও রিক্সায় উঠে চলে গেল। সেদিনের মত এভাবেই যাত্রা শেষ হল তাদের।
"আরে এত সুন্দর ঘটনা ঘটে গেল আর তুই মেয়েটার নাম্বার পর্যন্ত চাইতে পারলি না? ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দিছিল নাকি?"
"হয়তো, আমার শুধু চেহারাটা মনে আছে, আর নামটা জানছি, মীম!"
"বাহ! কি চমৎকার নাম রে ভাই! তারপর প্ল্যান কি? প্রেমের প্রস্তাব দিবি?"
অভ্র রাগান্বিত চোখে মিল্লাতকে বলল, "অভ্র করিম শেখ, কখনও কোন মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় নি এবং দিবেও না।"
"হুম কিন্তু অভ্র তার কালো জাদু দিয়ে শুধু মেয়েদের পটিয়ে নেয়!"
অভ্র কিছুক্ষণ জন্য চোখ বন্ধ করল। শুধু ভাবছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা। ভর্তি অফিসের সামনে দারানো অভ্রের কাছে মেয়েটা কলম চেয়ে বলল, "ভাইয়া আপনার কাছে কলম আছে?" কোন উত্তর না দিয়ে অভ্র সোজা কলমটা দিয়ে দিল! মেয়েটা লেখা শেষে সুন্দর করে ধন্যবাদ বলে চলে গেল!
"আর এতেই হিরো কুপকাত!" মিল্লাত বলল।
"জানিস কিছু কিছু চেহারা না খুব স্পেশাল হয়!"
মিল্লাত জিজ্ঞেস করল, "কি রকম?"
- এই যেমন ধর মীম মেয়েটা! কি সুন্দর সাধারণ চেহারা! সেই সাথে টোল পরা হাসি আর হাসলেই ডান পাশের দাঁতটা একটু করে বের হয়ে যায়! উফফ এটা মুগ্ধতা আরও বারতে থাকে।
অভ্রের কথা শুনে মিল্লাত বলল, "ওই অল্পসময়ে এতকিছু খেয়াল করে ফেললি!
"হুম, বিশেষ করে তার বাকা দাঁতের হাসিটা!"
"রুমমেট আবশ্যক, সার্বক্ষণিক গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুত সহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা! আধুনিক, সুন্দর এবং মনোরম পরিবেশে একজন রুমমেট(ছেলে এবং অবশ্যই ছাত্র হতে হবে) অবশ্যক।
যোগাযোগ..." হামজা ফোন বের করেই কল করলো নাম্বারটায়। কথাবার্তা সেরে তারা বললো ৫টার দিকে দেখা করতে। ক্লাসের দিকে রওনা দিতেই খেয়াল করল খুব পরিচিত এক চেহারা তার দিকে তাকিয়ে আছে! হামজা চশমা পরে নিল। কাছে আসতেই দেখে এটা মীম!
মীম সালাম দিয়ে বলল, "আসলেই কি এটা আপনি?"
হামজা উত্তরে বলল, "আমারও সেম কথা! কোন ডিপার্টমেন্টে আপনি?"
মীম বলল, "রসায়ন। আর আপনি?"
"বায়োকেমিস্ট্রি।"
"আমি কখনও কল্পনাও করি নি এভাবে আপনার সাথে দেখা হবে।!"
হামজা বলল, "তাই তো বলা হয় দুনিয়া খুব ছোট এবং গোলাকার!"
"তাহলে এখন আসি, লাঞ্চ ব্রেকে সময় থাকলে ৩য় তলায় দাঁড়াবেন।" এই বলে মীম চলে গেল ক্লাস করতে! হামজা হিসাব মিলাতে পেরেছে। ভর্তির দিন একেই দেখেছিল কিন্তু ভাবে নি প্রতিদিনই এখন তার সাথে দেখা হবে।
"তা কি নাম যেন তোমার?"
"জ্বি ভাইয়া, হামজা।"
"হুম, রুম দেখছো না? পছন্দ হয়েছে আশাকরি?"
জ্বি, ভাইয়া। সামনের সপ্তাহে উঠতে চাচ্ছি!"
"ঠিক আছে, আমার সাথে তো পরিচয় হল, আমি আতিক, ম্যাথ ২য় বর্ষ। এখানে মিল্লাত ভাই আর অভ্র ভাই থাকে, তাদের সাথে ভার্সিটিতে পরিচয় হয়ে নিও।"
"জ্বি আচ্ছা। আসি আজ, আসসালামু আ'লাইকুম।"
"তারপর, কি অবস্থা?" মীম জিজ্ঞেস করল।
"এইতো আলহামদুলিল্লাহ, আপনার?"
মীম বলল, "এই আপনি সম্বোধনটা যদি বাদ দিয়ে তুমি কিংবা তুই তে নামা যায় তাহলে ভাল হতো না?"
হামজা বলল, "যায় তবে আপনি সম্পর্কটায় মানুষের প্রতি একটা সম্মান কাজ করে। আর বিরক্তিকর তো "তুমি" শব্দটা।"
"এভাবে তো ভেবে দেখি নি!"
মীম আবারও জিজ্ঞেস করল, "পরের ক্লাস কয়টায়?" "দুপুর ২টায়, ল্যাব!"
"আহ বিরক্তিকর জিনিস! আমার আপাতত ক্লাস নেই আর কাল অফ ডে! আপনাদের অফ ডে আছে?" হামজা বলল, "হুম, শুক্রবার!"
হামজা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "ঠিক আছে, আমি উঠি সময় হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের, আসি।"
"হামজা, বাজারে চল। রাতের বাজার করে নিয়ে আসি।" অভ্র আর হামজা চলে গেল বাজার করতে। বাজার শেষে অভ্র বলল, "চল চায়ের দোকানে বসি, চায়ের স্বাদ নেয়া যাক।"
দোকানে বসে হামজাকে বলল, "আচ্ছা তোদের ক্লাসে স্টুডেন্ট কয়জন?"
- ৪৭ জন ভাই।
- এরমধ্যে সুন্দরী কয়টা? তোর কোনটারে পছন্দ হইছে?
হামজা হালকা হেসে বলল, "আরে না ভাই কিসের পছন্দ! কথাই বলি না কোনো মেয়ের সাথে!"
অভ্রের নিশানা ঠিক দিকেই আগাচ্ছে। সিগারেট টান দিয়ে বলল, "তাহলে যে মেয়ের সাথে তরে মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসের ৩ নম্বর মাঠে দেখি সে কে?" হামজা কিছুটা অবাক হয় বলল, "ভাই আপনি চেনেন না তাকে?" অভ্র কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! পরে বলল, "আরে আমার কি অন্য কোন কাজ নাই? সারাক্ষণ জুনিয়র খুঁজে বেড়াবো? চল উঠি, বুয়া আসছে হয়তো!"
মেসে ফিরে হামজা পুরানো ঘটনা সবগুলো শেয়ার করল অভ্রের সাথে। হামজা বলল, "ভাই সে অনেক ফ্রি মাইন্ডের। অ্যাটিচুড খুব ইন্টারেস্টিং!" অভ্রের মনের কৌতূহল সে কাউকে বুঝতে দেয় না। যথেষ্ট সতর্ক থাকে এসব ব্যাপারে। সে শুধু অপেক্ষা করছে উপযুক্ত সময়ের! বিছানায় শুয়ে ভাবছে হামজার কাছ থেকে তথ্য আজ জানতে পেরেছে সে তাই এই সপ্তাহে জুনিয়রদের সামনে যাওয়া যাবে না। তিন চারদিন পর যেতে হবে।
সকাল বেলা ক্যান্টিনে অভ্র, মিল্লাত আর আতিক বসে নাস্তা করছে। এমন সময় কিছু জুনিয়র ছেলে এসে তাদের পাশেই বসে গেল! অভ্র মিল্লাত এরা একে অপরের দিকে তাকালো। ইশারা বুঝতে পেরে আতিক সালাম দিয়ে বলল, "ভাইয়া, আপনারা কি সিনিয়র?"
একজন বলল, "হ্যা, সেকেন্ড ইয়ার!"
মিল্লাত বলল, "ভাইয়া সাবজেক্ট/ডিপার্টমেন্ট?"
"রসায়ন।"
কথাটা শুনে অভ্র চায়ের কাপ রেখে বলল, "ওহ আচ্ছা, ভাইয়া আমরা ১ম সেমিস্টারে! ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট।"
আরেকজন বলল, "তাহলে তুই করেই বললাম, আসিস ডিপার্টমেন্টে, আর কোনো হেল্প লাগলে জানাবি। আমি আসিফ, আর এ হচ্ছে তামিম আর তানভীর।"
"জ্বি ভাইয়া, আসি তাহলে।" এই বলে মিল্লাত, আতিক আর অভ্র উঠে গেল।
অভ্র বলল, "ডিসিশন ফাইনাল, আধাঘন্টার মধ্যে আমরা ফার্স্ট ইয়ারে এটাক দিব আর ওদের সি আর কে ডাকবি। আমাদের ক্লাসের ডেয়ারিং পোলাডি রে খবর দে R16 রুমে মিটিং এর জন্য।"
বেলা ১১টা,
নিচ তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত রসায়নের প্রায় ৫০ জন ছাত্রছাত্রীকে তিন ভাগে ভাগ করে সিরিয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সিনিয়ররা! হামজা আর তার বন্ধু আব্বাস করিডোর দিয়ে যেতেই সিরিয়ালে সালাম পেতে থাকলো! একটু দুরে যেতেই দেখে মীমও এই সিরিয়ালে! আব্বাস বললো, "নিশ্চিত র্যাগিং চলতেছে এদের। আচ্ছা তুই আর আমি র্যাগ এর শিকার হই নি তাই না?"
"ম্যাথের আতিক ভাইয়ের জন্য বেঁচে গেছি।"
অনেকক্ষণ ধরে কল দিয়েও ওয়েটিং ছাড়ছে না হামজার! অভ্রের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে! অবশেষে কল রিসিভ হল তার,
"কোথায় তুই?"
"ভাই কোথায় যে আছি স্পটের নাম জানি না তবে তিনটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে সামনে!"
"আচ্ছা ওখানেই থাক, আসতেছি।"
হামজার কাছে গিয়ে বলল, "কার সাথে কথা বলছিলি এতক্ষণ ধরে?"
হামজা বললো, "আব্বুর সাথে!"
"এত সময় ধরে কথা!"
"আচ্ছা এখন বলেন কি হয়েছে?"
অভ্র কিছু বলতে যাবে এমন সময় দেখে মীমও সেখানে! ওকে বলল, "তুমি কে? আগে তো দেখি নি! এই ভার্সিটির?"
হামজা বুঝতে পারল অভ্র কি চাইছে তাই কোন কিছু বলল না। মীম বলল, "জ্বি ভাইয়া।"
"কোন ডিপার্টমেন্ট?"
"রসায়ন, ১ম বর্ষ।"
অভ্র ভারী স্বরে বলল, "ফার্স্ট ইয়ার!! আমাকে চেন?"
মীম কম্পিত কণ্ঠে বলল, "না ভাইয়া।"
"গতকাল ক্লাসে ছিলে? থাকলে তো চেনার কথা। নাম কি তোমার?" "মীম।"
"আগে পরে কিছু নাই? শুধু মীম?"
"আসমাউল হুসনা মীম।"
"নিজের ইন্ট্রডিউসও ঠিক মত দিতে পারো না!!!! কি জন্য ভার্সিটি ভর্তি হয়েছো তুমি? ঢেঁকি একটা।"
মীম মনে মনে ক্ষেপে গেল কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। অভ্র শেষে বলল, "তোমরা ফ্রেশাররা, ভার্সিটির প্রত্যেকটা প্রোগ্রামে তোমাদের যেন দেখি, আর সিনিয়র দেখলে সালাম দিবা, ম্যানার কি তোমাকে লিখে লিখে হাতে কলমে শিখাতে হবে?"
"সরি ভাইয়া।"
অভ্র চলে যাওয়ার পর মীম বলল, "আচ্ছা উনি এমন কেন? স্বাভাবিকভাবে কথাই বলতে পারে না?" হামজা কিছু বলল না। হামজা বুঝতে পেরেছে অভ্র ভাই মীমকে পছন্দ করে। কিছুক্ষণ পর বলল, "কি জানি! হয়তো ছোট থেকেই এমন।"
মীম বলল, "উনার নাম অভ্র না, অভদ্র হওয়ার ছিল। চুলা কোথাকার।"
হামজা হাসতে শুরু করল! পরে বলল, "আচ্ছা ক্লাসে গেলাম, পরে কথা হবে।"
"মিল্লাত ভাই, ও মিল্লাত ভাই?" মিল্লাতের রুমের সামনে দারিয়ে ডাকতে লাগলো হামজা।
"হুম, ভিতরে আয়, দরজা খোলা।"
হামজা বসে জিজ্ঞেস করল, "একাই দাবা খেলছেন যে ভাই?"
"নিজের সাথেই যুদ্ধ করছি, আমিই জিতবো আবার আমিই হারবো!" মিল্লাতের কথায় হামজা বলল, "তাহলে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে যান, থ্রিল নিয়ে খেলেন?" মিল্লাত বলল, "খেলবি?"
দাবা খেলা শুরু করল দুইজন। খেলতে খেলতে মিল্লাতকে জিজ্ঞেস করলো, "ভাই একটা কথার সত্যে উত্তর দিবেন?"
"খন্দকার মিল্লাত মাহবুব, যা বলে সবসময় সত্যিই বলে, উত্তর দেয়ার মত হলে উত্তর অবশ্যই দিব।"
"আচ্ছা ভাই, অভ্র ভাই কি উনার জুনিয়র মীমকে পছন্দ করে?" মিল্লাত একটু হেসে বলল, "দাবা খেলায় সবচেয়ে ছ্যাঁচড়া মুভ কার বলতে পারবি?"
"ঘোড়া?" "হুম, ঠিক। অভ্র হল এই ঘোড়া! আড়াই ঘরের এই ঘোড়া এমন এমন প্যাঁচ বাধিয়ে দেয় যা ছুটানো মুশকিল। ঘোড়া তো যেকোনো একটাকে ধরে কিন্তু অভ্র তা করে না। সে নিজেকে আকর্ষণীয় করে মেয়েদের সামনে উপস্থাপন করে! তবে এটা ঠিক, আমি যতদিন হল ওকে জানি এখন পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে রিলেশনে যায় নাই। কিন্তু যেদিন থেকে মীমকে দেখেছে সেদিনই ওর প্রেমে পরে গেছে কিন্তু সে স্বিকার করবে না। আমি চিনি ওকে ভাল করেই!"
"রাজা চেক!" মিল্লাত দেখলো রাজাকে চেকের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। "বেশ! খুব সুন্দর খেলা পারিস তুই!"
"তাহলে কি অভ্র ভাইয়ের লাইনটা ঠিক করে দিব মীমের সাথে?"
মিল্লাত সবকিছু গুছিয়ে বলল, "একটা এডভাইস নিয়ে নে আজ, কখনও প্রেমের ক্ষেত্রে কাউকে হেল্প করবি না এবং নিজেও প্রেম জড়িয়ে নিস না। কাকে কার দরকার আল্লাহ তায়ালা খুব ভাল করে জানেন এবং সময়মত জুটি বেধে দিবেন।"
লাইব্রেরীর এসির বাতাসে বসে ক্লান্তি দুর করায় ব্যস্ত হামজা! এতই শান্তি লাগছিল তার যে খুব ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। অভ্র লাইব্রেরীতে ঢুকেই দেখে হামজা ঘুমে ঝিমানো শুরু করেছে! পাশে বসেই হালকা ধাক্কা দিল অভ্র। হামজা চোখ খুলে দেখে অভ্র! "আরে ভাই, আপনি?"
"আমি না আসলে তো লাইব্রেরিয়ান দরজায় তালা দিয়ে দিত! এত ঘুম কেন?"
অভ্র আবার বলল, "ফোনটাও মাঝে মাঝে চেক করা লাগে.." হামজা ফোন বের করে দেখে ৮টা মিসড কল। অভ্র জিজ্ঞেস করল, "কয়বার কল দিছি?"
"ভাই আপনি ৬বার দিছেন আর মীম দুইবার! আপনিতো আসলেন মীমকে কল ব্যাক দিই..." অভ্র স্বাভাবিক থাকলো। একটুপর মীম আসলো, হাসিখুশি মেয়েটা অভ্রকে দেখে মলিন হয়ে গেল। সে সালাম দিল, "আসসালামু আ'লাইকুম।"
"হুম, কি অবস্থা? বস ওদিকে।" অভ্র বলল।
"জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।" "যাক তুমি এসে গেছ ভালই হল, তোমাকে কিছু বলার আছে। আশাকরি মনোযোগ দিয়ে শুনবে।" অভ্রের কথায় মীম সম্মতি জানালো।
"কথা হল, তোমার আশেপাশে অন্য কোন ছেলে দেখা আমার পছন্দ না, তাই বিষয়টা খেয়াল রাখবা।"
"মানে?" মীম ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না! "মানে হচ্ছে তোমাকে আমার খুব ভাললাগে, আর আমি আমার পছন্দের যেকোনো কিছুর আশেপাশে অন্য কারও বিরচন পছন্দ করি না। হামজা?"
"জ্বি ভাই"
"মীমের খেয়াল রাখবি, কোনো ছেলেকে ওর আশেপাশে ঘুরতে দিবি না।" মীম কিছু বলতে যাবে তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে অভ্র বলল, "তোমার রায় আমি শুনতে চাইনি! যেটুকু বললাম খেয়াল রাখবা। গেলাম, হামজা খেয়াল রাখবি।"
অভ্র সীমানার বাইরে চলে যাওয়ার পর হামজা খুশিতে বলল, "ইয়েস!!! জানতাম উনি তোমাকে পছন্দ করে! গতকালই চিন্তা করছিলাম এই ব্যাপার নিয়ে।"
এদিকে মীম রেগে লাল! কলম দিয়ে খাতায় মাঝ বরাবর আঁচড় দিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে হামজার দাঁত ক্যালানি হাসি!
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:০৬