somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনাবাসী জীবনের কড়চা২

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার লাইব্রেরী ও মায়ের বইপড়া

আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে কিছু বই আছে। বেশীরভাগই রাজনীতি ,অর্থনীতি, ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি ,সিনেমা, ভ্রমন, স্মৃতিকথা , আত্মজীবনী ও গবেষনামুলক বই।বিভিন্ন রেফারেন্সের বইও আছে।গল্প, উপন্যাস,কবিতা,দেশ বিদেশের রান্না বিষয়ক ও শিশুসাহিত্যের বই যে নেই তা নয়। এসব বইয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দেশে থাকাবস্থায় আমি আসলেই সর্বগ্রাসী, সর্বভুক পাঠক ছিলাম। কিন্তু আমাকে সব সময় টানতো রাজনীতি,ইতিহাস, আত্মজীবনী ও ভ্রমনের বই। বড় বড় তিন আলমিরা ও একটা বড় ওয়াল টু ওয়াল বইয়ের শোকেস ভর্তি বই দেশে ফেলে এসেছি। এক শোকেস ভর্তি দেশ বিদেশের হাজার বারোশত সিনেমার ডিভিডি,সিডি, ভিএইচ ক্যাসেট। এখানে এসে মুলতঃ বইগুলোর জন্য ভীষন মন খারাপ লাগে। যদিও প্রায় প্রতিদিনই মায়ের সময় কাটে আমার বইয়ের ঝাড়ফুক করে।তার কারনে বইগুলো এখনো যত্নে রয়েছে।
সকালে ঘুম ভাংলো মায়ের ফোনে। প্রাত্যহিক জীবনের নানান প্রসংগ নিয়ে কথাবলার এক পর্যায়ে আচমকা মায়ের প্রশ্ন, তুই কি তাসলিমা নাসরিন কে চিনিস? পরিচয় আছে?
হঠাৎ মায়ের Taslima Nasreen কে চিনি কিনা জানতে চাওয়ায় ভীমড়ি খেলাম। আমি সরাসরি কিছু না বলে উলটো জানতে চাইলাম, কেন আম্মা, কিছু হয়েছে নাকি?
- না, আমি জানতে চাইছি চিনিস কি না।
উনি বিখ্যাত মানুষ। তাকে কে না চিনে। কিন্তু আমি ঢাকায় তাসলিমা নাসরিনকে ১/২বার দেখেছি ৮৯ /৯০ সালে । কোথায় দেখেছি মনে পড়ে না। কখনো কথা হয়নি। পরিচয় বলতে তার লেখার সাথে, তার কবিতা, কলাম, বইয়ের সাথে। বছর ৭/৮ বা তারও অধিক সময় ফেসবুক ফ্রেন্ড। তার নির্বাচিত কলাম, লজ্জা বই দুটো আমার ভাললাগার বই। নব্বইয়ের দশকে যখন তাকে দেশছাড়া করা হলো, ব্লাসফেমী ল' করার জন্য জামায়াত ইসলামী ও অন্যান্য মৌলবাদী দল উঠে পড়ে লাগল তখন তাসলিমা নাসরিনের পক্ষে বাক- ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষায় গনতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য, ৯ ছাত্র সংগঠন ও বাম রাজনৈতিকদলগুলো আন্দোলন করেছে। সেইসব মিছিল, সমাবেশে রাজপথেই ছিলাম। গনতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নেতা হিসেবে নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতাও দিয়েছি। খেলাফত মজলিশের ডাকা হরতাল প্রতিরোধের সংঘর্ষে কিছুটা আহত হয়েছিলাম। সেইসব এখন স্মৃতি।
যাহোক মাকে কিছু জিগেস করার আগে একনাগাড়ে বলতে থাকেন, তার ভীষন মন খারাপ।গতকাল আমার বুকসেলফ থেকে তাসলিমা নাসরিনের 'নেই,কিছু নেই' বইটি নিয়ে পড়েছেন। মা'কে নিয়ে তার( তাসলিমা নাসরিন) আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে আমার মায়ের মন বারবার ভিজেছে। বইটি পড়ে মা যে খুব ভারাক্রান্ত হয়েছেন ফোনের এপ্রান্ত থেকে বুঝতে পারি তার গলাধরে আসায়।জানতে চাইলেন, তার আর কোন বই সেলফে আছে কিনা। আমি জানিয়ে দেই আমার সেলফে তাসলিমা নাসরিনের কম হলে ১০/১৫ টি বই আছে। খুজে নিতে হবে। আপনি পড়েছেন
তাসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর ষষ্ঠ খণ্ড।আমার সেলফে বোধ হয় আরো ২/৩ খন্ড আছে। দেখেন খুজে পেয়ে যাবেন।
মা'কে বলি তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরতে দেয়া হয় না।
মা অবাক হন। কেন দেশের মেয়েকে কেন ফিরতে দেয়া হয় না?
- মা, ধর্মদ্রোহি বলে,ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে আসতে দেয়া হয় না। সবই রাজনীতির চাল।এমন কি একটা সময় ভারতও তাকে থাকতে দেয়নি।
আমার মা রাজনীতির মারপ্যাচ বুঝবে না,তাই সংক্ষেপে বলি, দুইদেশেই ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাকে ভারত ও বাংলাদেশে ফিরতে দিবে না।
- তাহলে দুইদেশের সরকার কি করে?
মায়ের একথার উত্তর দেয়া হয় না। ফোন রাখার আগে মাকে বলি, সেলফ থেকে নির্বাচিত কলাম বইটি নিয়ে আগে পড়েন। আমার মেয়েবেলা, সেই সব অন্ধকার, উতল হাওয়া, দ্বিখণ্ডিত এবং আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ '। এ বইগুলো সেলফে আছে, খুজে নিয়ে ধীরেসুস্থে পড়তে পারবেন।
মায়ের ফোন রাখার পর চেস্টা করছিলাম "নেই,কিছু নেই" বইটি আবার পড়ার।মন্ট্রিয়েলে আমার চেনাজানা দু'একজন বইপ্রেমী আছেন, তাদের কাছে ফোন করে বইটি সংগ্রহে আছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। পড়াতো দুরের কথা দুঃখজনক হলো তাদের কেউ কেউ এই বইটির নামই শুনেনি।
যাহোক স্মৃতি যদি বিভ্রম না ঘটে বহু বছর আগে পড়া তাসলিমা নাসরিনের 'নেই,কিছু নেই' বইয়ের বড় একটি অংশজুড়েই রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর অভিমানের কথা। পুরো বইটি আসলে একটি দীর্ঘ চিঠি। তাসলিমা নাসরিন বইটিতে তাঁর মাকে স্মরণ করেছেন। বইটি উৎসর্গ করেছেনও মাকে। লিখেছেন, 'তুমি যখন বেঁচে ছিলে কত বই লিখেছি, কত কত মানুষকে উৎসর্গ করেছি। তোমাকে কোনও বই উৎসর্গ করার কথা কোনওদিন ভুল করেও ভাবিনি। আজ তোমাকে এই বইটি উৎসর্গ করতে চাইছি আমি, সম্ভবত তুমি নেই বলেই চাইছি। বেঁচে থাকলে চাইতাম না। তোমার অযোগ্য অপদার্থ কন্যা।'
শেষ দিকেও আক্ষেপ করে লিখেছেন, 'আমার জীবন তছনছ হয়েছে আগের চেয়েও অনেক বেশি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হলে, যেহেতু বাংলাদেশের দরজা আমার জন্য বন্ধ, কলকাতা থাকতে শুরু করেছিলাম। যে ভাষায় আমি লিখি, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সে আমার মাতৃভাষা, সে তোমার ভাষা মা। এই ভাষা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কলকাতায়। চার বছর থাকার পর পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। শুধু কলকাতা থেকে নয়, আমাকে ভারত থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জঙ্গী মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে বলে কোনও সরকারই আমাকে আর ও দেশে থাকতে দিতে চায় না। বাংলার মেয়ের বাংলায় ঠাঁই নেই। এখন উদ্বাস্তুর জীবন আমার, পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো হাঁটি। তোমার স্বপ্নটাই ঘুরেফিরে দেখি। ঘরের মেয়ে কি কোনওদিন ঘরে ফিরবে না! মাঝে মাঝে স্বপ্নটাও খুব ধোঁয়ার মতো, কী চাই বুঝি না, মাটি না মানুষ।'
মায়ের প্রতি তসলিমা নাসরিনের আকুতির শেষ দুটি লাইন 'এ প্রায়শ্চিত্ত নয় মা, এ স্বীকারোক্তি। আমি যতোটুকু ভাল, তা তোমার কারণে, যতটুকু মন্দ আমি, তা আমার নিজের কারণে। আমার মন্দটুকুর দায়িত্ব আমাকেই নিতে দাও।'
আমার ছুটির দুপুরে এ লেখাটি লিখতে লিখতে মায়ের জন্য আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে ভীষন খারাপ লাগছে। প্রত্যেক সন্তানের কাছে মা অনেক বিশাল কিছু, মা নামের সাথে অনেক আবেগ জড়িয়ে থাকে। ভিজে যাওয়া চোখের কোন মুছতে মুছতে চুপিসারে নিজেকেই বলি,
'আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ।'
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×