তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী। জনপ্রিয়তায় সমসাময়িক অনেক স্বনামধন্য লেখককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তার জীবদ্দশাতেই। বঙ্কিম ও রবীন্দ্র যুগের আলো তাকে ম্লান করতে পারেনি আজো। নীতি বা প্রচলিত সংস্কার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পক্ষপাতশূন্য; বঙ্কিম দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন সংস্কারকে; শরৎচন্দ্র তখন সংস্কার ভাঙ্গার সাহস দেখালেন! তিনি রমা, রাজলক্ষ্মী, অভয়ার মতো চরিত্রের পক্ষ নিয়ে প্রীতিহীন নীতি ও ক্ষমাহীন সমাজকে প্রশ্ন করেছেন, তারা মানুষের কোন মঙ্গল সাধন করেছে? সচেতন ও অর্ধসচেতন মনের উপর বাহিরের ঘটনা আঘাত করলে যে সব গভীর অনুভূতির জন্ম হয়, তারই প্রকাশ ঘটে উপন্যাসে, গল্পে, কবিতায়। তাই লেখকের সৃষ্ট চরিত্রে অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যায় তার মনস্তত্বের খানিকটা ছাপ। তা যে সবসময়ই ঠিক তা নয়, তবে অনুমান করা যায়।
শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের মনের ভিতর দুইটি দিক পাশাপাশি কাজ করে। প্রথমটি বুদ্ধি, যা সমাজ ও সংস্কার হতে পাওয়া, দ্বিতীয়টি মনের গভীর থেকে উঠে আসা আবেগ ও অনুভূতি। সচেতন বুদ্ধি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বটে, কিন্তু আবেগের উত্থান এতো গভীর প্রবৃত্তি থেকে আসে যে তা সবসময় সংস্কার আশ্রিত বুদ্ধির ধার ধারেনা। এই পরস্পরবিরোধী শক্তির চিত্রণেই শরৎচন্দ্রের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ। বিশেষ করে নারী চরিত্রে প্রবৃত্তির সাথে সংস্কারের সঙ্ঘাত বড় হয়ে উঠে এসেছে। যে মীমাংসাহীন দ্বন্দের মধ্যে নারীজীবনের সব ঐশ্বর্য মহিমা নিঃশেষ হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাই সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। হিন্দুঘরের বিধবা রাজলক্ষ্মীর সত্যিকার মনের বিয়ে যদি কারো সাথে হয়ে থাকে তবে তা শ্রীকান্তের সাথে, তবে তা বিবাহমন্ত্রে পাওয়া নয়। কিন্তু যখন মিলনের সময় আসলো তখন রাজলক্ষ্মীর মধ্যে ধর্মবুদ্ধি এমন ভাবে সচেতন হলো যে সেটাকে আর থামানো গেলোনা। একদিকে তার প্রাণাধিক ভালোবাসা ও অন্যদিকে সামাজিক শক্তির নিপীড়ন। এর মাঝেই জীবনের অপচয়, আর তা নিয়েই ঘটনাপ্রবাহ। অন্নদাদিদি, নিরূদিদি, অভয়া, রাজলক্ষী – এই মহিলাদের সাথে সমাজের অনুভূতিহীন নিয়মের সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের মন এতো স্বাধীন যে এমন কোন আইন হতে পারে না যা এদের জীবনের গৌরব নষ্ট করে। এই বিষয়টা থেকে শরৎচন্দ্রের মননের অনেকখানিই আভাস পাওয়া যায়। তৎকালীন সমাজ সংস্কারের সাথে তার সঙ্ঘাত, লেখক মানসে অবিরাম দ্বন্দের তৈরী করলেও তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন- একদিন নির্দয় সমাজনীতির উপর হৃদয়ের ভাবাবেগের জয় অবশ্যম্ভাবী। যে প্রণয়াকাঙ্ক্ষা মনের অনেক গভীর থেকে উঠে আসে তার জন্য কোন আইন খাটেনা! তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের সংস্কার আসে বাহিরের সমাজ, সভ্যতা ও ধর্ম হতে, কিন্তু সে আশ্রয় নেয় তার মনে। আর প্রেমলিপ্সার সাথে সংস্কারের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি হয় নারীর মনে। শরৎচন্দ্র সম্ভবত ধারণা করতেন নারীর সমস্ত চেষ্টার মূলে থাকে প্রেম আর স্নেহ! তাই রাজলক্ষীর ক্ষমতালিপ্সা পূরণ হয় শ্রীকান্তকে পেয়ে আর সাবিত্রীর অধিকারবোধ সীমাবদ্ধ থাকে সতীশকে নিয়ে। নারীর মনকে তিনি দেখেছেন চলমান সংঘাত হিসেবে, যেখানে স্বতস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষা বাধা পেয়েছে চিরায়ত সংস্কারের দেয়ালে। ‘পল্লীসমাজে’ রমা রমেশকে ভালোবাসত, বিয়ের কথাও হয়েছিলো। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে পল্লীসমাজের নানান দলাদলি ও সংকীর্ণতার মধ্যে রমার একান্ত প্রিয় মানুষও তার শত্রুতে পরিণত হয়। আবার রমা তাকে ভালোবাসতো খুব। এটাই রমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। শরৎচন্দ্র সচেতন ভাবেই এই মানসিক দ্বন্দ-সংঘাত কে নিপুণ ভাবে তুলে এনেছেন। হতে পারে এটা তার একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার ফল অথবা গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ফসল।
প্রত্যেক খেয়ালী লোকই স্নেহ ও কৃপার পাত্র, হয়তো মাঝে মাঝে এমনটাই ভাবতেন শরৎচন্দ্র। তাই ‘বড়দিদি’ মাধবীর সুরেন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিলো তার অদ্ভুত চরিত্র দেখে-কোন কিছুরই খেয়াল খবর সে রাখতো না। বিধবা মাধবীর হৃদয়ে প্রথমে জেগেছিলো খানিকটা মাতৃস্নেহ, পরে তাই রূপান্তরিত হলো প্রেমে। খুব একটা সহজ বিষয় নয় এটা, অন্তত সেই সময়ের জন্য তো অবশ্যই। লেখক ভাবতে পেরেছিলেন কারণ মানব আবেগের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ভালোই ওয়াকিবহাল ছিলেন। আর মানুষ হিসেবে তিনি নিজেও ছিলেন খেয়ালী ও বোহেমিয়ান প্রকৃতির। তিনি হয়তো মনে করতেন পুরুষের মনে প্রেমের আকাঙ্ক্ষা বহু প্রবৃত্তির মধ্যে একটি, পুরুষের অধিকাংশ কাজ বাহিরের জগতের সাথে; সেখানে সে অর্থ চায়, ক্ষমতা চায়। তাই গঙ্গামাটিতে যখন শ্রীকান্তের দিন কাটতো না, রাজলক্ষ্মী নিজেই বলেছে, “গঙ্গামাটির অন্ধকূপে মেয়েমানুষের চলে, পুরুষমানুষের চলেনা।“ শ্রীকান্ত আর লেখকের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও, একথা বলা সম্ভব নয় যে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস লেখকের জীবনের ছবি। বরং এটা ভাবাই যুক্তিসঙ্গত যে এখানে লেখকের মনস্তাত্বিক ছায়া পড়েছে বেশিমাত্রায়।
শরৎচন্দ্রের মননে যেমন নারীর প্রণয়িনী রূপ ছিলো, তেমনই ছিলো নারীহৃদয়ের বাৎসল্যের রূপ। তার লিখায় নারীহৃদয়ের বাৎসল্য তথা সন্তান স্নেহের বহু চিত্র ফুটে উঠেছে। জননীর যে স্নেহ বহু বাধা অতিক্রম করে, তা তাকে মুগ্ধ করেছে সবসময়। তবে এখানে একটা বিষয় প্রায়ই এসেছে, তা হচ্ছে- মাতৃস্নেহ প্রকাশিত হয়েছে ঈষৎ দূরসম্পর্কিত সন্তানস্থানীয় আত্মীয়ের জন্য অনেক বেশি; গর্ভজাত সন্তানের জন্য ততোটা নয়। ‘রামের সুমতির’ নারায়ণীর সমস্ত স্নেহ সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে উপচে পড়তো তার সৎ দেবর রামলালের জন্য। তাতে তার স্বামী বা নিজের মা কারোরই সমর্থন ছিলোনা। তারপরও সে তার নিজের মায়ের নির্মমতা থেকে শিশু দেবরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রাজলক্ষ্মী তার সন্তানের তৃষ্ণা মিটিয়েছে পরের ছেলে বঙ্কুকে নিজের ছেলে কল্পনার ছেলেখেলা দিয়ে। লেখকের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা হয়তো তাকে নারীর এই মহৎ দিকের পরিচয় দিয়েছিলো। তার মনের গভীরে নারীদের মাতৃরূপের এক অনন্য প্রদীপ জ্বলতো সবসময়, যা উদ্ভাসিত করেছে তার সব সাহিত্যকর্ম। অনেক সময় মনে হয়েছে তার সৃষ্ট নারী চরিত্রদের কাছে প্রণয়ের পরিণতি হচ্ছে সন্তানকামনা। গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী লেখক শরৎচন্দ্র তার বিশ্লেষণী মনের সাহায্যে এমন অনুসিদ্ধান্তেই হয়তো পৌছেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের পুরুষ চরিত্ররা গৌণ। তাদের আবির্ভাব যেন অনেকটা নারী চরিত্রবিকাশের সহায়ক হিসেবে। একদল সরল প্রকৃতির, বৈষয়িক লাভালাভ সম্পর্কে অসচেতন, আরেকদল নিষ্কর্মা ও চরিত্র কালিমালিপ্ত। অনেকেই বাল্যপ্রেমের অভিশাপে নিপীড়িত। দেবদাসের কাহিনীতে মনের দূর্বলতা আর পরাজয়ের গ্লানির আধিক্য। তবু লেখক তাকেই নায়ক করেছেন, সচেতন ভাবেই তার প্রতি পাঠকের প্রীতি ও সহানুভূতি আকর্ষণ করেছেন। হয়তো লেখকের মনে এইরকম প্রেমের জন্য ট্র্যাজেডির প্রতি গভীর ভালো লাগার বোধ ছিলো, ভালোবাসার জন্য জীবনের এই ক্ষয়ের মহানুভবত্ব ছিলো। তার এই বোধের প্রকাশ ঘটছে দেবদাসে। ‘চরিত্রহীন’ এ লেখক অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এই নামকরণ করেছিলেন উপন্যাসের প্রধানচরিত্র সতীশকে লক্ষ্য করে। তিনি দেবদাসের জন্য সবার অনুকম্পা চেয়েছিলেন, কিন্তু সতীশের জন্য তার কোন সংকোচ নেই। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন প্রচলিত নীতি যাকে চরিত্রহীন বলে ঘৃণা করবে, মতের উদারতায়, মনের গভীরতায়, অনুভূতির ব্যাপকতায় সে অনন্যসাধারণ হতে পারে! হতে পারে সামাজিক সংস্কার আর আচারের বিরুদ্ধে তার মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত ছিলো বহুদিন, তাই এখানে বিদ্রোহী হয়ে বের হয়ে এসেছে।
ইন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের অপরূপ সৃষ্টি। সে একজন সত্যিকার মহামানব। নানা প্রতিকূল অবস্থায় সে পড়েছে, খেলার মাঠে মারামারি, গঙ্গায় মাছচুরি, সাপ, বুনো শুয়োরের বন্য পথে বেড়ানো- এসব তার প্রতিদিনের কাজ। জীবন সংগ্রামে ক্ষত বিক্ষত মানুষের পক্ষে তার অবস্থান। তার আছে নিঃশঙ্ক সাহস, লাভলোকসান সম্পর্কে নির্লিপ্ততা। তাকে কল্পনা করলে মনে হয় সে যেন শরৎচন্দ্রের কল্পলোকের আদর্শ মানুষ। লেখক নিজেও হয়তো কল্পনায় এমন মানুষই হতে চাইতেন। তার নিজের কল্পনায় মনের গভীর থেকে উঠে এসেছে ইন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্র এমন মানুষের কথা ভেবেছেন যার মধ্যে মহামানবের বলিষ্ঠতা ও শিশুর চঞ্চলতা ও সারল্য পাশাপাশি থাকবে। সেই চরিত্রই ইন্দ্রনাথ, যে গভীর রাতে অচেনা মৃতদেহ সৎকারের জন্য তুলে নিয়ে বলতে পারে-“মড়ার আবার জাত কি?”
(তথ্যসূত্রঃ শরৎচন্দ্র- শ্রী সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৫০