♖ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল- খাওয়ার পানি নেই, মরে মরে বেঁচে আছে মানুষ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, চারিদিকে পানি আর পানি। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই পানির রাজত্ব। তবুও যেন পানির-ই অভাব। ঝড়, জলোচ্ছাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী-ভাঙ্গন ইত্যাদির কারণে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। চারিদিকে এখন কেবল দূর্গতদের হাহাকার। যেই পানির কারণে এতকিছু, সেই পানির অভাবেই মরছে মানুষ। এ যেন দূর্গত অভাবী মানুষের সাথে এক প্রহসন। সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা, বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষিরা, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলছে ভয়াবহ পানির হাহাকার। সমগ্র অঞ্চল সয়লাব হয়ে গেছে লোনাপানিতে। তাছাড়া এসব এলাকার বেশিরভাগ টিউবওয়েলই নষ্ট। আশে পাশে মিঠা পানির কোন উৎস নেই। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিবসা নদী। এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে অবনী বৈদ্য। পানি নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। এক পর্যায়ে করুণ কন্ঠে বললেন- “পানির দেশের মানুষ আমরা আর পানির অভাবেই মরণদশা”।
♖ ডুবে যাচ্ছে হাতিয়া, কুতুবদিয়া, ভোলা
মনপুরা দ্বীপের হাজিরাহাট লঞ্চঘাট ও মালামাল অবতরণ কেন্দ্রের চায়ের দোকানদার সালউদ্দিন বললেন, ১৫ বার নদী ভাঙ্গনের পর নতুন আস্তানা গেড়েছেন। মাইলখানেক দূরের নদীর পশ্চিমের চর দেখিয়ে বললেন, এইডা (চর সমসুদ্দিন) আর এইডা (মনপুরা) একলগে ছিল।
বঙ্গোপসাগরের কাছে মনপুরা দ্বীপ দক্ষিণের জেলা ভোলার একটি উপজেলা। আর এই উপজেলা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যেই ছিল, আছে। তবে সালাউদ্দিন মনে করেন, গত কয়েক বছরে ভাঙ্গন বেড়েছে। সালাউদ্দিন এর মত সাধারণ মানুষসহ প্রশাসনেরও অনেকে বলেছেন, ভাঙ্গন আগের চেয়ে বেড়েছে। ভোলার মূল ভূ-খন্ডের আলীমুদ্দিন বাজারে গেলে ভাঙ্গনের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়। ভাঙ্গনের ভয়াল থাবা থেকে বাদ পড়েনি শাতাব্দী প্রচীন এই বাজারটিও। বাজারে কথা হয়েছে এমন সবার আশঙ্কা, আগামী বর্ষায় বাজারটি একেবারে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তারা জানান, গত বর্ষায় যে পরিমান ভেঙ্গেছে, ১৫ বছরেও সে পরিমান ভাঙ্গেনি।
ভোলা জেলার ৭টি উপজেলায় নদীভাঙ্গনে এ বছর বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৭৭০০ পরিবার মেঘনায় ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এদের অনেকে রাস্তার পাশে, বাধের উপর, অন্যের জামিতে বসবাস করছে। আবার কেউ কেউ মেঘনার মাঝে জেগে ওঠা চড়ে ঠাঁই নিয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবি আবদল্লাহ টুনু চৌধুরী জানান, এবছর এ গ্রামে প্রায় ৬৫০টি পরিবার ঘর জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভোলা সদর সহ অন্যান্য উপজেলারও অবস্থা একই ধরনের।
♖ হারিয়ে যাচ্ছে হাতিয়া:
ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাতিয়া। হাতিয়ার এ ভাঙ্গন কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ জানেনা। মেঘনার ভাঙ্গনে বিপুল সংখ্যক পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে ভূমিহীন হয়েছে। নদীভাঙ্গা বিভিন্ন ভূমিহীন পরিবারের কেউ কেউ হাতিয়ার বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাধে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ হাতিয়ার অন্যান্য ইউনিয়নে নতুনভাবে ঘর বেধে মাথা গোজার ঠাই করে নিয়েছে। আবার কেউ চলে গিয়েছে হাতিয়ার বাইরে। ভূমিহীন এইসব পরিবারের পরিসংখ্যান বোর সরকারী দপ্তরে নেই। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে রাজকুমার সাহারহাট, মনু ব্যপারীর হাট, সাহাবানি বাজার, চৌরঙ্গী বাজার, জাইল্লা বাজার, মফিজিয়া বাজার, নওচিড়া নতুন বাজার ও ভূইঞার হাট মেঘনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
পরিবেশবিদরা এর মধ্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে- সমুদ্রের পানি যে হারে বাড়ছে ১০০ বছরের মধ্যে ডুবে যেতে পারে বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় দ্বীপগুলো। এর মধ্যে কয়েকটি এমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যে আগামী ৫০ বছরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এসব দ্বীপ। এর জন্য দায়ী লোভী, স্বার্থবাদী মানুষও।
♖ জলবায়ু পরিবর্তনে কেমন আছে সুন্দরবন
ছোট্ট একটি ঘটনা বলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি দ্বীপে সাপের ভয়াবহতা থেকে নিষ্কৃতির জন্য একবার সেখানে আমদানী করা হল কিছু বেজীর। যার ফলশ্রুতিতে সেখানে ভয়াবহ প্রাকৃতিক সমস্যার সৃষ্টির হয়। হ্যামিলনের বিড়ালগুলো ইঁদুর খেয়ে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা বলেই তো যত কান্ড। আর অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশ তাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে যে যুদ্ধ চালায় সবজী ক্ষেতে ও ফসলের মাঠে! জীব বৈচিত্রের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের স্বাভাবিকতাই স্থান, কাল ও পাত্র বিশেষে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন আসুন জীব-বৈচিত্র বিনাশে বাংলাদেশের সমস্যায়।
বিগত একশ বছরে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র, ইমপ্যাক্ট জোনের (সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট লোকালয়) প্রাণবৈচিত্র ও লোকালয়ের মানুষজনের জীবনাচারে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য, সেই সঙ্গে পরিবর্তন মোকাবিলায় স্থানীয় মানুষজনের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাও এর জন্য অনেকটা দায়ী। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অনুভূত হয় সুন্দরবনে।
গঙ্গা নদী বিভিন্ন সময় তার বঙ্গোপসাগরে বিলীন হওয়ার মোহনা বারবার পরিবর্তন করেছে। গঙ্গার মূলস্রোত পূর্ব অভিমুখী হয়ে যাওয়ার কারণে ভাগীরথী-হুগলী নদীর মিষ্টি জলের প্রবাহ অনেক কমে যায়। প্রবাহ বেড়ে যায় মেঘনা নদী আর বলেশ্বর নদের মোহনায়। এদিকে ভূ-অভ্যন্তরীণ বিশেষ পরিবর্তনের ফলে ভাগীরথী অঞ্চল থেকে মেঘনা মোহানার স্থলভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু হয়ে যায়। উত্তর থেকে নদীবাহিত মিষ্টি জলের প্রবাহ কমে যাওয়া, পূর্ব সুন্দরবনের স্থলভাগ উঁচু হওয়ায় পশ্চিম সুন্দরবনের মিষ্টি জলের নদীগুলোর জলপ্রবাহ কমে গিয়ে এ নদীগুলো হয়ে পড়ে সমুদ্রের বাড়ানো হাত। উত্তর থেকে প্রবাহের চাপ না থাকায় সমুদ্রের লবনজল সরাসরি পশ্চিম এলাকার বনভূমি ও লোকালয়ে ঢুকে যায়। মাটিতে লবণের ভাগও বেড়ে যায়। ফলে বনের কিছু অঞ্চলে ও লোকালয়ে ব্যাপকভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই জলাবদ্ধতা ও সামুদ্রিক জলের স্রোতধারার নানামুখী পরিবর্তনে অবনমন প্রক্রিয়ার শুরু হয়। দেখা গেল, যেখানে এককালে নিবিড় বন ছিল হঠাৎ করেই সেই বনাঞ্চলের তলার মাটি ধসে গিয়ে বন তলিয়ে গেল।
সুুন্দরবনের ভারতীয় অংশ এবং বাংলাদেশের পশ্চিমপ্রান্তের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে সুন্দরীগাছ নেই বললেই চলে। গোলপাতার অবস্থাও অনেকটা একই রকম। সামুদ্রিক জলস্তরের উচ্চতা এবং জলে ও স্থলে অতিরিক্ত লবণাক্ততা এর কারণ। এই লবণের প্রভাব পূর্বাঞ্চলের সুন্দরীসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতেও হামলা করেছে আগামরা রোগের মাধ্যমে। অনেকে বলেন আগামরা রোগ শুরু হয়েছে ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায়। তথ্যটি সত্য নয়, ১৯০৪ সালে প্রকাশিত ডেভিড প্রেইনের সুন্দরবনের গাছপালা সম্পর্কে প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় সুন্দরীর আগমরার উল্লেখ আছে। তবে সেটা ছিল অল্পমাত্রায়। ফারাক্কার পর আগামরা মহামারি আকাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য গাছও আগামরা ও পাতা কঙ্কালকরণ পোকার আক্রমনের শিকার হচ্ছে। আক্রান্ত হবে বাইনের বাগানও।
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল দক্ষিণবাংলার প্রায় তিন কোটি মানুষ। আমরা সুন্দরী গাছ হারালে নৌকা বানানোর কাঠ, ঘরের খুঁটির মারতœক অভাব দেখা দেবে। আর গোলপাতা ছাড়া ছাউনি সুন্দরবন এলাকার মানুষ ভাবতে পারেনা। সমুদ্রজলের উচ্চতা বেড়ে গেলে আমাদের সুন্দরবনের ভূ-ভাগের ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। নতুন নতুন খাঁড়ির সৃষ্টি হবে। মাটি ধ্বসে ও ক্ষয়ে গিয়ে জমি বা বনের এলাকা কমে পানির এলাকা বেড়ে যাবে। নতুন চাড়া গর্জন, গরান, গেওয়া ছাড়া অন্য গাছ টিকতে পারবে না। পূর্বাঞ্চলের বন নবগঠিত হওয়ায় এ এলাকার মাটি পশ্চিম এলাকার চেয়ে নরম। ফলে জলস্তরের পরিবর্তনে এই অঞ্চলে মারাতœক ভূমিক্ষয় হবে।
সমুদ্রজলের উচ্চতায় বাঘের বনভূমির এলাকা কমে গেলে স্বভাবতই বাঘের সংখ্যা, তার শিকার কমে যাবে। কুমির বাড়তে পারে, গাঙ্গের শুশুক কমবে। মায়া হরিণ একেবারে শেষ হয়ে যাবে। চিত্রা হরিণও কমে যাবে। শূকড় বাড়তে পারে। বানর, ভোঁড়রের অবস্থানে খুব বেশি হেরফের হবেনা। শঙ্খচূড় সাপ কমে যাবে। মাস্কড কিনফুট একবোড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। পলাশ ফিশ ইগলও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। মাটির তলবাসী, চরবাসী প্রাণসম্পদ বাড়তে পারে। তবে কীটপগঙ্গ অত্যন্ত বেড়ে যাবে।
(চলবে)
আলোচিত ব্লগ
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।