শুধু এই উপমহাদেশ কিংবা সেলুলয়েডের পাতা নয়; ইংরেজ বানিজ্য ও সাম্রাজ্য বিস্তারে ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” এক কেন্দ্রিয় চরিত্র, অন্যতম চালিকাশক্তি। সপ্তাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে পরবর্তী প্রায় তিনশত বৎসর ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” এক একটি ইতিহাস গড়ে গিয়েছে; তৈরী করেছে নায়ক-খলনায়ক (ক্লাইভ লয়েড, হেস্টিংস্, ওয়েসলি, কর্ণওয়ালিস্ প্রমুখ)।
কিভাবে শুরু:
মূলত সপ্তাদশ শতকে লন্ডন বিভিন্ন কারণ হেতু প্রাচ্যের সাথে সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠে। ষোড়শ শতাব্দী, মানচিত্রবিদ্যা যখন বিকাশের আরম্ভকাল ও উন্মেষের সন্ধিক্ষণে, তখন থেকেই প্রাচ্যের বাণিজ্য সম্ভবনা ও সম্পদের প্রাচুর্য ইউরোপীয়দের মনে এক নতুন উদ্যোমের জোয়ার তৈরী করে। সেসময় প্রাচ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল মূলত চীন, পারস্য সাগর ও লোহিত সাগর সংলগ্ন ব্যবসা কেন্দ্রসমূহের সাথে। সম্ভবত সেই বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো থেকেই পশ্চিমারা প্রাচ্যের প্রাচুর্য নিয়ে একটা ধারণা পেয়েছিলো। তবে ইংরেজরা গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে আরও অনেক পরে। মজার ব্যাপার হলো শুরুতে প্রাথমিকভাবে ইংরেজদের কাছে প্রাচ্য অভিযানের যে কারণসমূহ যৌক্তিক বলে মনে হয়েছিলো তন্মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ গুরুত্ব পায়নি! বরং যা আওতাধীন হতো:
১. ওলন্দাজ (ডাচ) ও পর্তুগিজ বাণিজ্য জাহাজের যোগাযোগ পথকে বিঘ্নিত করে আধিপত্য বিস্তার।
২. জলদস্যুতা দমন।
৩. মিশনারিকে ধর্ম প্রচারে সহায়তা।
কিন্তু, স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক-এর পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর (১৫৭৭-১৫৮০) থেকে প্রাচ্য সম্পর্কে ইংরেজদের চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আর এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে ১৬০০ সালে রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” এর প্রতিষ্ঠা।
”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র গঠন এবং প্রাচ্যে বাণিজ্য অভিযানে ইংরেজ অভিজাত শ্রেণীর বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রার্চ্যে সুগন্ধি মসলা, দামি পাথর, সিরামিক, সিল্ক- এসব বিলাসী দ্রর্ব্যে সম্মোহনী অভিলাষ অভিজাত শ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করতে।
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেও ইংরেজ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা প্রাচ্য তথা এই উপমহাদেশে বাণিজ্য সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলো। প্রাচ্য সম্পর্কে তাদের তথ্যেও ঘাটতি ছিলো। ফলে,তৎকালীন প্রাপ্ত তথ্যসমূহকে প্রাচ্য অভিযানে ব্যবহারে সন্দিহান ছিলো। এছাড়া, ব্যবসায়িক লোকসানের আশংকা অভিযান প্রস্তুতি থেকে তাদের বারবার পিছিয়ে আনছিলো।
ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগলিক পরিচিতি ও সভ্যতা সম্পর্কে ইংরজরা কতটুকু অজ্ঞ ছিলো তা ১৬০০ সালের ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র চার্টারে প্রতিফলিত হয়েছে। অবশ্য ইংরেজ ইতিহাসবিদগণ সেই অজ্ঞতাকে এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে সুনির্দিষ্ট উদ্দশ্য নয় বরং স্রেফে আগ্রহই ছিলো প্রাচ্য এবং উপমহাদেশে অভিযানের মূল কারণ।
মূলত ১৫৮০-১৫৯০ সালের মধ্যেই প্রাচ্যে ও উপমহাদেশে অভিযানের জন্য ইংরেজদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তৎকালীন লেখক রিচার্ড হেকল্যুট এবং থমাস হিকওক এর মতো অনুবাদকের কর্মবিবরণ ও তৎপরতা সাক্ষ্য বহন করে যে সেই অভিযানের প্রস্তুতি ছিলো কতটা ব্যাপক ও সুপরিকল্পিত। কিন্তু উপমহাদেশের ভৌগলিক ও সভ্যতা সম্পর্কে অজ্ঞতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রিচার্ড হেকল্যুটের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো, ”জাতি হিসেবে ইংরেজর্দে ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব ও আধিপত্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে প্রাচ্যে বাণিজ্য অভিযান ও উপনিবেশ স্থাপনের ওপর।” তিনি নিজে এব্যাপারে প্রাচ্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য এক বিরাট কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। অভিজ্ঞ নাবিকর্দে সাক্ষাৎর্কা, বিদেশী ভ্রমন বৃতান্তের অনুবাদ, প্রচলিত ইতিহাস কিংবা মিথ- কোন কিছুই হেকল্যুটের কর্ম থেকে বাদ যায়নি। তাঁর এই প্রচেষ্টা পরবর্তীতে তাঁকে ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”এর উপদেষ্টা পদ পেতে সহায়তা করেছিল।
এত কিছুর পরও ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র অভিযান বহরের সাফল্য নিয়ে খুব কম লোকই নিশ্চিত ছিলেন। ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র ফ্লিট (বহর) কেপ অব গুড হোপ দিয়ে যখন ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করবে, তৎপরবর্তী অভিযান পদক্ষেপ নিয়ে ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”র সবাই অন্ধকারে ছিল। এর প্রমাণ, ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” কে অনুমোদন দেয়া ১৬০০ সালের রয়্যাল চার্টার। চার্টারে প্রাচ্যে যে কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য কিংবা বন্দর্রে কথা ছিল না। ফলশ্রুতিতে, ”ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” শুরুতে এই সিদ্ধান্তে পৌছায় যে, জাভা, সুমাএার বাজার তার্দে বানিজ্যিক লাভের ক্ষেএ হতে পারে; আর ভারতীয় উপমহাদেশকে তারা তখন কেবল মাত্র গমন পথের রুট হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। (চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ২:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




