অনন্য কে নিয়ে প্রথম যখন দেশের বাইরে আসি, আমি ভীষন হিমসিম খাই। কারণ, আমি একা সব কাজ করে ওকে টেক কেয়ার করাটা আমার জন্য ভীষন কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছিলো। কারন, আমরা বাংলাদেশে কাজের মানুষের উপর অধিকাংশ নির্ভরশীল এবং অভ্যস্ত। তার উপরে সে ভীষন চন্চ্ঞল। পরে অবশ্য সামলে নেই। এবং ভালো ভাবেই।
আমি আমার ছেলে বিকালে ঘুরতে বের হতাম। আমার বাসার কাছে বিশাল শপিং কমপ্লেক্স। হেটেই যাওয়া যায়। আমার সবসময় টার্গেট থাকতো দোকান গুলিতে "সেল" কবে দিচ্ছে। আর আমার ছেলের ছিলো মার্কেট এলার্জি। ঐ রাস্তায় হাটা শুরু করলেই কান্না শুরু করতো আর স্ট্রলার ধরে টানা টানি করতো। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতাম।
তার বদ অভ্যাস ছিলো একটা । কত দিন জুতা ফেলে দিয়েছে পা থেকে , আমি উঠিয়ে আনছি।
আমি ওকে একা বাইরে নিলে অঘটন একটা ঘটবেই। হয়তো ট্রেনের টিকিট হারাবো, নইলে সে জুতা হারাবে। একবার "উয়েনো" তে গেলাম ওকে নিয়ে। আমার বাসা থেকে বেশ দুর। ইচ্ছা কেনাকাটা করবো কিছু। যাবার সময় ট্রেনের টিকিট হারালাম! অগ্যতা বাড়তি পয়সা গুনতে হলো নেমে।
"উয়েনো" তে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তাকিয়ে দেখি নবাব সাহেব জুতা ফেলে দিয়ে নবাবের মত স্ট্রলারে বসে আছে। উল্লেখ্য , জুতাটা তার বাবা আগের দিন নিয়ে গিয়েছে ১০০০ ইয়েন দিয়ে। নতুন জুতা, কি করি!! আসা যাওয়ার পথে চক্কর দিলাম কয়েকবার । নাই তো নাই। টোকিওতে বসবাস কারীরা যানেন "উয়েনো"তে কি পরিমান লোক সমাগম হয়। শেষমেষ পাইলামই না।
ভারাক্রান্ত মনে হাটছি। হঠাৎ চোখে পড়লো একই জুতা একটা দোকানে!!! কিন্ত সাইজ একটু বড়। আগেরটা ছিলো ১৪.৫ সে:মি:। এইটা পেলাম ১৫ সে:মি:। তবুও পেলাম, আমি খুশি। পরে নতুন জুতা দেইখা ছেলের বাবা বলেছিলো জুতা কিনলাম এক সাইজ এখন দেখি আরেক সাইজ। আমি বলি ভুল দেখছিলা মনে হয়। পরে অবশ্য ঘটনা তাকে বলি।
আগের কেনা বাকি জুতাটা ফেলে দিয়ে নতুন জুতা পরিয়ে গন্তব্যস্হলে যাচ্ছি। আমরা "উয়েনো" পার্কের ভিতর দিয়ে আসছিলাম। ইউনিভার্সিটি যাবো, ছেলের বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরবো। হঠাৎ পেছন থেকে এক জাপানিজ ভদ্রলোক আমাদের দাড়া করালেন , বললেন এইটা কি তোমাদের জুতা?
আমার মেজাজটা এমন হইলো বলার না। আমি তাকে বিনীত ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বললাম, হ্যাঁ আমার ছেলের জুতা।
অনন্য বড় হচ্ছে। ভীষন দুরন্ত। অকারণেই লাফাতে থাকে। আমি ওর আচরণে মাঝে মাঝে বিরক্ত হই কিন্তু সেটার সময়ক্ষন খুবই সীমিত। ওর বয়স দুই বছর সাত মাস চলছে। সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে। কম্পিউটার অপারেটিং এর অনেক কিছু আয়ত্ব করেছে।
মিকি মাউস,টম এন্ড জেরীর দারণ ভক্ত। দেখার সময় তাদের অনুকরণ করে অভিনয় করে। আমি তাকিয়ে ওকে দেখি, হাসি। হাসলে তিনি আবার মাইন্ড করেন!
একবার ওকে খাওয়ানোর সময় জ্যাকি চানের মারামারি দৃশ্য দেখালাম ।ভাবলাম মারামারি দৃশ্য দেখলে উৎফুল্ল হয়ে খাবে হয়তো। ওমা!! হিতে বিপরীত হইলো। ছেলে মারা মারি দেইখা সোফা, খাট থেইকা লাফ দিয়া পইড়া ডিগবাজি খাইতে চায়। আমি নিজের কান ধরলাম। আর না.......
গান পছন্দ করে খুব, রেষ্টুরেন্টের সামনে দিয়ে গেলে একবার বলবে ,চল ওখানে বসে খাই। লিফট , স্কেলেটর দেখলেই উঠার জন্য পাগল হয়ে যায়। ট্রেনে ওঠার জন্যও পাগল থাকে, পরের ষ্টশনে আসলেই বলে, চলো চলো নামি। খাবার নিয়ে অনে..........ক বিরক্ত করে। তবে বাইরে খেতে পছন্দ করে। এখন অবশ্য মার্কেটে নিলে হাতে ফ্রেন্চ্ঞ ফ্রাই আর অরেন্জ জুস দিলেই মোটামুটি চুপ থাকে।
পৃথিবীর সব শিশু গুলির প্রতি আমার শুভ কামনা। সব মায়ের সন্তান সবাই খুব ভালো থাকুক।
অনন্য বড় হচ্ছে । আমার প্রার্থনা ,কোন জীর্নতা ওকে স্পর্শ না করুক । ওর সমস্ত অস্বাভাবিকতা,অসুস্হতা আমাকে ঘিরে রাখুক। সৃষ্টিকর্তাকে বলি আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখুক, অন্তত ততদিন,যতদিন অনন্য নিজের বোধটাকে কাজে লাগাতে না পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১:২০