মূল: এম. কৎসুবিনস্কী
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
প্যানি নাতালিয়া বিরক্তিভরা ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখে খাবার ঘরের ভেজানো দরজাটা ধাক্কা দিলেন। রাতের কাপড় বদলে সকালের ফ্রক পড়তে পড়তে আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন,
_বারবারা, তুমি কি মেইন গেইট খুলোনি এখনো?
ধূলি ঝাড়া থেমে গেল বারবারার; মাথা নাড়ালো সে, একান্ত বাধ্যের ঢঙে মাথা নিচু করে বলল,
_এইতো, খুলছি।
_না, না, বোকামি করো না; একটা দরজাও খুলো না সারাদিন!
ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বারবারাকে আটকালেন নাতালিয়া। বেটে-মোটাসোটা হলেও ভীষণ কাজের আর সদা সতেজ বারবারা কিছু বুঝতে না পেরে ভাসাভাসা চোখে তাকালো।
_শহরে অনেক গ্যাঞ্জাম হতে পারে। ওরা ভীষণ বাজে ও ভয়ঙ্কর। আমার ভয় লাগছে, না জানি কেউ দরজা-জানালা ভেঙ্গেই ঘরে ঢুকে যায়! আজ আর বাজারে যেও না, ঘরে কি যথেষ্ট খাবার আছে?
_মাংস নাই।
_থাক, লাগবে না। মনে রেখো, আজ যা-ই হোক না কেন, একবারও বাইরে বেরুবে না; কাউকে ঘরেও ঢুকতে দেবে না কিন্তু। অপরিচিত কেউ খুঁজলে বলে দিও আমরা বাসায় নেই; বেড়াতে গেছি দূরে কোথাও।
নাতালিয়া কথা বলছেন ফিসফিসিয়ে, বারবারার কানের কাছে মুখ নিয়ে। তার ছানি পড়া চোখ অস্বাভাবিকভাবে খুঁজছে কিছু একটা; কিন্তু কী_ তা নিজেই জানেন না।
বারবারা যেতে না যেতেই নাতালিয়া আরেকবার চারদিক পরখ করে নিলেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর। হলুদ রশ্মির তীক্ষনতায় ঠিকই দেখা যাচ্ছে দরজা-জানালা-দেয়ালের অস্পষ্ট ডোরাকাটা দাগ। নাতালিয়ার মনে হল, এগুলো মৃতাত্মার রূপ ধরে ভীষণ ভয় দেখাচ্ছে তাকে। দ্রুত পাশের ঘরের দরজা-জানালাও পরখ করে নিলেন।
কয়েক সেকেণ্ড পরপরই নাতালিয়া রাস্তার কাছের জানালায় কান পাতছেন আর ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন কোন অনাহুত শব্দের। ভাসা ভাসা কিন্তু একটানা একটা শব্দ অবিরত কানে বাজছে তার।
কিভাবে শেষ হয়েছিল দিনটা? সরকারী অশ্বারোহী বাহিনী পিষে ফেলছিল মানুষ; কেউ কেউ বা বেয়নটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল একেকটা তাজা প্রাণ। এরকম অসভ্য দিন কেন যে আসে! আর এখন? ওরা হামলে পড়েছে বুদ্ধিজীবিদের উপর। স্বামীর কাছে তিনি কতোই না আকুতি মিনতি করেছেন_ চলো, বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে যাই এ নরক ছেড়ে দূরে কোথাও...; নাহ্, স্বামীটা চাননি এ পরাজিত প্রস্থান। অনেক দেরি হয়ে গেছে; ওহ্ স্রষ্টা! এখন কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য...!
শোচনীয় দিনটার কথাই ভাবছেন তিনি। গর্দভ লিফলেটগুলো হাওয়ায় উড়ছে, উড়ছে তুষারপাত; আর প্রশাসন কতর্ৃক শত্রু নিধনের নামে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে উড়ে যাচ্ছে অগুনতি মানুষের আত্মা! তাদেরও যে নাম আছে 'রাষ্ট্রদ্রোহী ও নিধনযোগ্য'দের দলে। হঁ্যা, এটনর্ী ভ্যালেইরিয়ান চু্যবিনস্কী পুলিশের কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নায়িত ছিলেন; রাষ্ট্রে সুশৃঙ্খলতা ফিরিয়ে আনার মহৎ দায়িত্ব পালনের নামে তাকেও রাখা হয়েছে হিটলিস্টে!
পাশের ঘর থেকে বাচ্চাদের উচ্চহাসি ভেসে আসছিল। নাতালিয়া আরেকবার তাদের ধমকে দিলেন_ 'দোহাই লাগে, চুপ করো তোমরা!' তার জামার লম্বা হাতা বিস্ময়ে বা ভয়ে চমকে ওঠা পাখির ডানার মতো পতপত করে উড়ছিল; গলা থেকে বেরুচ্ছিল তীব্র মনোস্তাপের অদ্ভুত শব্দ। 'বাচ্চাদের খামখেয়ালি চঁ্যাচামেচি যদি বাইরে থেকে শোনা যায়...' তিনি ভয়ে তাকালেন জানালার দিকে।
বারবারা ভীষণ উপকারী ও কর্মচঞ্চল। অসীম ধৈর্যে একবার কাপড় চোপড় গুছাচ্ছে, পরমুহূর্তেই মোজা পরাতে পরাতে বাচ্চাদের শোনাচ্ছে এমন সব গল্প_ যাতে তারা মনোযোগী হয় আর চিৎকার-চ্যাচামেচি না করে; গৃহকর্ত্রীও যেন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে না ওঠেন। তাকে মনে হচ্ছে বিশ্বস্ত, নিরাপদ ও দূরদর্শী সঙ্গীর মতো।
'বারবারা, একবারো কি বাইরে গিয়েছিলে?' _নাতালিয়া জানতে চাইলেন।
_না, কেবল কিছক্ষণ গেটে দাঁড়িয়েছিলাম।
_ভালো! রাস্তাঘাট কি সুনসান?
_কয়েকজন লোক ছিল। তারা জানতে চাইছিল স্যারকে দেখেছি কিনা।
_তাই নাকি? তাদের চেনো তুমি?
_নাহ্... এই কয়েকটা লোক...
_সঙ্গে কিছু ছিল?
_হঁ্যা, লাঠি ছিল।
_উফ্...!
_আমি বলেছি স্যার বাসায় নেই; কেউ-ই নেই বাসায়।
_ভালো, খুব ভালো করেছো বারবারা। মনে রেখো লক্ষ্মীটি, কেউ জানতে চাইলে বলো, একজনও বাসায় নেই।...ওহ্ গড!
'বারবারা'_ অস্বস্তির কণ্ঠে ডাকলেন প্যান ভ্যালেইরিয়ান চু্যবিনস্কি, 'সব দরজা-জানালা বন্দ কেন?'
বারবারা রান্নাঘরে যাচ্ছিল, নাতালিয়া থামালেন ওকে। মিস্টার প্যান সরাসরি তাকালেন বারবারার দিকে। তার চোখ দুটো দুর্বল আর সংশয়মাখা। জমকালো পোশাকটাকে বাদ দিলে মনে হয় যেন কদাকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাথের কোন বৃদ্ধ ভিখারি।
_দরজা-টরজা সব বন্দ রাখতে দাও...। বোঝার চেষ্টা করো, কেন আমি জোর দিচ্ছি কথাটাতে। তুমি ভালো করেই কল্পনা করতে পারো আজ কী হতে পারে! ...আমি তোমাকে এখন কিছুতেই কোথাও যেতে দেবো না।
_ননসেন্স! এখনই খুলে দাও সব।
_প্লিজ শান্ত হও, বোঝার চেষ্টা করো, হাত জোর করছি আমি; বাচ্চাদের দোহাই!
প্যানি নাতালিয়ার চোখ আরক্তিম হয়ে ওঠে। ভ্যালেইরিয়ান রেগে উঠলেন, 'বোকার মতো বকো না, লুকিয়ে থাকতে পারি না আমরা!' কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো, স্ত্রী তার ঠিকই বলেছেন।
বারবারা বাসন-কোসন সাজালে সবাই খেতে বসলো সকালের নাস্তা। আয়োজন প্রায় অন্যদিনের মতোই; তবু কিছু একটা বেতাল মনে হচ্ছে আধা-অন্ধকারে ঢাকা ঘরটায়। দেয়ালে ও হাড়ি-পাতিল রাখার আলমারিতে হলুদ আলোর ছেঁড়া ছেঁড়া খণ্ডগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে, দমকা বাতাসে জমজম করছে জানালাগুলো। ছোট্ট বালক-বালিকাদের ফিসফিসানি পরিবেশটাকে করে তুলেছে এমন আতঙ্কগ্রস্ত ও ভয়ঙ্কর সংবেদনশীল যে, প্যান ভ্যালেইরিয়ান আনমনা হয়ে কাঁপছেন আর টেবিলে তার এক হাতের কম্পন বেজে উঠছে ছন্দবদ্ধভাবে। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে, তবু তিনি আরেক হাতে জঙ্গল হয়ে থাকা নিজের চুলে আঙ্গুল বুলানো থামাচ্ছেন না; উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন। তার এই হঠাৎ কেমন হয়ে যাওয়া সেদিন থেকে, যেদিন কয়েকটা সন্দেহজনক লোক সারাদিন তার সামনে ঘুরঘুর করছিল আর সে রাতেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল আবছায়া কেউ একজন_ তিনি তাকাতেই যে পালিয়ে গিয়েছিল। মাত্র একদিন আগেই স্রষ্টার নামে উচ্চারিত একটা সুর বেজে উঠেছিল তার কানে_ 'ইনি সেই সুবক্তাদের একজন, যারা নরকদণ্ডপ্রাপ্ত!' একটা কুৎসিত লোক জ্বলজ্বলে চোখে তার গায়ের উপর পড়ে হঠাৎ এমন ফোঁসফোঁস করছিল যে, প্যান ভ্যালেইরিয়ান বিস্মিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।
তিনি এসবের কিছুই জানাননি স্ত্রীকে। তারপরও, কেউ কেউ তাকে 'জ্ঞানের অপার সম্ভার' বলে ডাকে। অগুনতি মাথা, ঘর্মাক্ত রঙিন মুখে সহস্র দৃষ্টির তী্নতায় হালকা কুয়াশা বইয়ে দিচ্ছিল তার অবয়বে। কথা বলার সময় তার নিশ্বাস থেকে বেরুচ্ছিল মহাসাগরের আদর্্র হাওয়া। কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছিল খুন হতে থাকা আহত পাখির মতো কাতরানিময়। তবু মনে হয় অন্তত কথা বলতে পারায় সফল ছিলেন তিনি। সহজ ও জীবন্ত করে উপস্থাপন করেছিলেন মালিকপ ও শ্রমিকপরে মধ্যতার তুলনা। ফলে, তার মনে হয়েছিল এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট পারদর্শী। উপস্থিত সবাই যখন মুহুমর্ুহু হাততালি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, অনুধাবন করছিলেন এইসব সাধারণ মানুষের বিবেকের সজাগতা। সেদিন সব ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর; কিন্তু আজ? আজ কী হবে?
চু্যবিনস্কী স্ত্রীর দিকে সরাসরি তাকালেন। জিজ্ঞাসুর চোখ আর ছটফটে পাখির মতো মুখ নিয়ে বসে আছে বেচারা! বদ্ধ দরজা-জানালা পরিবেশটাকে ক্রমশ উন্মাদগ্রস্ত করে তুলছে। শীতলপাটির মতো স্থির নদী যেন অলুক্ষুণে গুম মেরে আছে, একবার ফুঁসে উঠে শহরের সব আবর্জনাময় জীবন সাফ করে দেওয়ার আশায়!
দরজায় কেউ একজন নক করতেই প্যানি নাতালিয়া লাফিয়ে উঠলেন। সবাই জড় পদার্থের মতো শক্ত ও অনড়। 'কেন ভয় পাচ্ছো তুমি?' প্যান ভ্যালেইরিয়ান ধমকে উঠলেন, 'হবে হয়তো কোন দুষ্টু বাচ্চাকাচ্চা; কিংবা অন্যকেউও হতে পারে।' বিড়বিড় করে বললেন,'কে যে, তা কেবল স্রষ্টাই বলতে পারেন!'
রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল বারবারা।
নাতালিয়া অাঁকড়ে ধরলেন ওকে,
_কী হয়েছে বারবারা?
_প্যানিচ গোর্বাচেভস্কি ঢুকেছেন রান্না ঘর দিয়ে।
_ঠিক আছে, ওকে আসতে দাও।
মাথা নত করে 'বাধ্য ছাত্র' গোর্বাচেভস্কি বারবারার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল।
'কী হয়েছে আমাদের খুলে বলো।' _সম্ভাষণের জবাবে জানতে চাইলেন গৃহকর্তা।
_অবস্থা ভীষণ খারাপ। হাজার হাজার নিগ্রো সারারাত নিকিতা এলাকায় মিটিং করেছে। তারা মদ খাচ্ছিল আর কথাবার্তা বলছিল তাদের 'প্রথম শত্রু'র প্রসঙ্গে। তারা 'সুবক্তা' ও 'গণতন্ত্র'_ এ দুটি বিষয়কে ঢালাওভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মধ্যে।
_ওহ্ স্রষ্টা, মহান!
_ঘাবড়াবেন না, প্যানি! যদিও তারা হইচই করে সংশয় জাগিয়ে তুলছে; তবু হয়তো কিছুই হবে না তেমন।
একটু ভেবে সে আরো যোগ করলো,
_তারা সবাই তিন-চারজন করে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আছে। তাদের মুখ উজ্জ্বল, হিংস্র ও রাগী। বুদ্ধিজীবিরা ওদের চোখে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ...চা হবে একটু?
প্যানি নাতালিয়া গ্লাসে চা ঢেলে দিলেন। তার হাত এখনো কাঁপছে। কয়েকফোঁটা চা ছিটিয়ে পড়লো চারপাশে।
_তুমি আর কী জানো?
পায়চারী করতে করতে জানতে চাইলেন প্যান ভ্যালেইরিয়ান চু্যবিনস্কি।
_ধন্যবাদ প্যানি। ...আ... বাজারের কাছ দিয়ে আসার সময় প্রচণ্ড হইচই শুনেছি। মনে হয় ওদের চাঙ্গা রাখতে কেউ ফ্রি ভোদকা বিলোচ্ছিল। কয়েকজন রহস্যময় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকারীকে দেখলাম। তারা কারা আর কী করছে_ জানি না আমি। কেবল কিছু নাম শুনেছি_ মাচিনস্কী, জ্যালকীন, আপনার...
_ওহ্ ডিয়ার গড!
_মনে হয় না এ নিয়ে দুঃখ পাওয়ার কিছু আছে। হইচই করে পুরুষের দঙ্গল ভোদকা গিলছে_ এটাই রবিবারের প্রধান দৃশ্য। ...কিছু রুটি হবে? ...ধন্যবাদ। আমি এখনও আপনাদের নিয়ে বিস্মিত। একবারের জন্যও কি শহর ছেড়ে দূরে যেতে পারেন না? একটু আগে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দরজা-জানালা বন্দ দেখে ভাবছিলাম, কেউ নেই বাসায়। কবে ফিরবেন তা জানার জন্যই নক করেছিলাম। অথচ আপনারা এখনো...! বিপজ্জনক ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে এটা।
_এ-ই ভাবছো তুমি! কতো যে আমি জোরাজুরি করেছি: অন্তত বাচ্চাদের জন্য হলেও চলো দূরে কোথাও যাই...
অশ্রুসিক্ত নাতালিয়া উদ্বিগ্নভাবে বুক চাপড়ানো শুরু করলেন,
_অনেক দেরি হয়ে গেছে, সম্ভব নয় আর।
ধমকে ওঠেন প্যান ভ্যালেইরিয়ান। অসংলগ্নভাবে সিগ্রেটের পর সিগ্রেট টানছেন তিনি আর পাক খাচ্ছেন বেপরোয়াভাবে পায়চারি করতে করতে। মাথার ভেতর রাজ্যের দুশ্চিন্তার পাহাড় কুয়াশায় ঢেকে আছে যেন।
_কী হচ্ছে, কে জানে; ওহ্...
মেয়েলি কণ্ঠের একটা উচ্চ হাহাকার ভেসে এল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখল, রান্নাঘর দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে আছড়ে পড়েছে ছোটখাটো গড়নের হৃষ্টপুষ্ট এক ভদ্র মহিলা। এই বদ্ধঘরে তার সঙ্গে ঢুকে পড়েছে একফালি সতেজ আলো। তার তীর্যক টুপি আর আলুথালু লাল চুল সেই আলোয় অগি্নশিখার মতো জ্বলজ্বল করছে, যা সে রাস্তা থেকে বয়ে এনেছে।
_উফ্, কী অন্ধকার! কেউ কি নেই ঘরে?
সম্ভাষণ জানাতে বা জবাব দিতে কেউ এগুলো না। মহিলাটি ঝটপট টেবিল মাড়িয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
_আমার প্রিয় আত্মারা, কী সৌভাগ্য আমার, তোমাদের ঠিকঠাক ফেরত পেয়েছি! সম্রাটের ছবি অনেক উঁচুতে ঝুলিয়ে এই রাস্তা দিয়ে লোকগুলো যাচ্ছিল; আমি তো ভেবেছিলাম...! পরে দেখলাম, তারা কেবল সাইক্যাচকে পেটাচ্ছে আচ্ছামতো।
_কোন সাইক্যাচ?
_একটা কলেজ ছাত্র। সে তার কপালে সম্রাটের ছবি লাগাতে রাজি হয়নি। তাকে দেখলাম রক্তাক্ত মাথায় যাচ্ছে। জামা কাপড় শতচ্ছিন্ন। তারা ওকে একজন আরেকজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল আর পালা করে মারছিল। তার রক্তাভ চোখ বন্যপশুর মতো ক্রুব্ধ দেখাচ্ছিল। তাকাতে পারিনি। ওহ্, কী ভয়ানক দৃশ্য! তোমরা কি ভাবতে পারো ঐ নৃশংস লোকগুলোর সঙ্গে আমি কাদের দেখেছি? সব সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। সবার পরনে সস্তা জ্যাকেট আর উঁচু জুতো। কেবল সহজ-সরল-শ্রদ্ধাযোগ্য কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো_ যারা সারাদিন ফসল ফলাতো। আমাদেরই গ্রামের ওরা; কী শান্তশিষ্ট, অমায়িক আর কর্মপ্রাণ ছিল!
'ওরা ভীষণ বদ, তাতিয়ানা স্তেপানোভ্না।' _গোর্বাচেবস্কী মন্তব্য ছুড়ে দিল।
_নাহ্, এভাবে বলো না! আমি ওদের পাঁচ বছরের মতো স্কুলে পড়িয়েছি। কিন্তু এখন ওদের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার সময় এসেছে; কেননা, ওরা এখন আমাকেও পেটাতে চায়। অভিজাত সব সমপ্রদায়ের প্রতি ওদের তীব্র ােভ বাসা বেঁধেছে। কার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল_ ভাবার ইচ্ছে নেই ওদের। কেবল আমাদের সবকিছু লুট করতে চাইছে। শুধু ধনীদের করলেও চলতো; আমার পাশের বাড়ির গরিব বুড়িটাও রেহাই পায়নি। তার এক ছেলে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে, আরেকজন জেলে। এখন তার কিছুই নেই_ জীর্ণ কুঠির আর পুরনো দুঃখ ছাড়া। সব ধ্বংস করে ফেলেছে, পিষে ফেলেছে সব; অনেক কষ্টে আর ভালোবাসায় এতোদিন আগলে রাখা ছেলেদের বইখাতাও রেহাই পায়নি ওদের হিংস্রতা থেকে। কারণ, অন্যদের মতো মাহিলাটি তাদের বন্দনা করতে চায়নি। ...হঁ্যা, কেউ কেউ অবশ্য ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মূর্তি নিয়ে এসেছিল, নতজানু হয়ে করুণা চাইছিল আর রেহাই পাবার আশায় পাষণ্ডদের হাতে চুমু খাচ্ছিল। কিন্তু জন্তুগুলো ওদেরও একটু করুণা করেনি!
'কী ভয়ানক!' _প্যানি নাতালিয়া যন্ত্রের মতো বলে উঠলেন। চাপা উত্তেজনায় তিনি ঋজু হয়ে বসে আছেন এখনো; যেন বিশেষ কিছু না ঘটলে একটুও নড়বেন না!
_হিস্স্স্স্...
হঠাৎ ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলেন তিনি, সাবধানী হওয়ার সঙ্কেতে।
শব্দটা খুব কাছাকাছি। সবাই কান খাড়া করে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। মনে হয় ছুটে আসছে কোন আদিম টর্নেডো কিংবা বন্যপশুর উদ্ভট ঝড়ো স্বর। 'আহ্... আহ্... আহ্...' দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটানা আর্তনাদ। বাইরের পাথর ঢালা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল অগুনতি পদধ্বনি।
_বদমাশের দল, আসছি আমি; দাঁড়া...
ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরেই কাকে যেন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চু্যবিনস্কী। মুহূর্তে সবাই ছোঁ মেরে আটকে ফেলল তাকে, যেন বাইরে যেতে না পারেন। বেরুলে ছেলেমেয়েসহ তার স্ত্রীকে হয়তো ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় দাঁড়াতে হবে। একজন সর্বহারাকে দেখে েেপ উঠেছিলেন তিনি। প্যানি দোহাই দিলেন, চু্যবিনস্কী বাইরে বেরুলে আত্মহত্যা করবেন তিনি। সম্বিৎ ফিরে পেলেন প্যান। ভয় পেয়ে যাওয়া শিশুরা ঘরের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে তখনো কাঁদছে।
_বারবারা...
প্যান ভ্যালেইরিয়ান আদেশ দিলেন,
_শিশুদের পাশের ঘরে নিয়ে যাও, আর যেভাবেই হোক শান্ত করো।
প্রশস্ত দেহ আর জীর্ণ পোশাক নিয়ে প্রশান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো বারবারা। কী যেন বলতেই শিশুদের কান্না থেমে গেল। দীর্ঘ হাত দিয়ে আদর করে ওদের কোলে তুলে পাশের ঘরে নিয়ে গেল সে।
সময় যেন থেমে থাকলো আরো কিছুণ!
_তোমরা ভাগ্যবান, এতো ভালো একজন কাজের মেয়ে পেয়েছো...
তাতিয়ানা মন্তব্য ছুড়ে দিলেন। এই তুমুল বিষণ্ন সময়ে তার এ কথায় এক উল্লসিত অনুভূতির স্বাদ পেলেন নাতালিয়া,
_আমার বারবারা সত্যিই একটা চাঁদের টুকরা! ও আমার সত্যিকারের বন্ধু। চুপচাপ, চিন্তাশীল আর বিশ্বস্ত ও অনুগত। ভাবো একবার, ও আমাদের কাছ থেকে মাসে মাত্র ত্রিশ টাকা নেয়।
_ও ন্যাচারালিই ভালো...
প্যান ভ্যালেইরিয়ান যোগ করলেন,
_চার বছর ধরে আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা ওকে ভালোবাসি, সেও আমাদের এবং আমাদের বাচ্চাদের ভীষণ যত্ন করে।
বাড়িটা যখন এ আলোচনায় স্বস্তি পাচ্ছিল, এখানে আসার কারণটা অতিথি তাতিয়ানার তা মনে পড়ে গেল। তার মনে হয়েছিল, প্যানকে তার সতর্ক করা উচিত। সেদিন মিটিংয়ে প্যান যা বলেছিলেন, তার পর থেকে বিস্ফোরিত এই দাঙ্গাকালীন সময়ে তাদের কিছুদিন বাসা থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে থাকা উচিত। কোন বিশ্বস্ত উপত্যকায় লুকিয়ে থাকতে পারলেই ভালো হয়।
কিন্তু গোর্বাচেভস্কির ঠিক উল্টো ধারনা। তার মতে প্যানের স্বপরিবারে বাড়িতে থাকাই ভালো; বরং কোন কারণেই বাড়ির বাইরে বেরুনো চলবে না। এই বাড়িটা দুর্বৃত্তদের ঠিক চেনা-জানা নয়। কারণ, মাত্র কয়েকদিন হলো তারা এ বাড়িতে থাকছেন। দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ রাখলে কেউ বুঝবে না এখানে কেউ আছে কি না।
_আমি কিছুদিন এখানেই থাকবো, সময় পেলে এসো...
অতিথিকে বিদায় জানাতে গিয়ে বললেন চু্যবনস্কী।
এখন স্বামী-স্ত্রী এ ঘরে একা। প্যান চু্যবিনস্কী একইভাবে সিগ্রেটের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় পালানো উচিত কিনা, তা ভাবছেন আর এলোমেলো হাঁটছেন। নিজের পাশে ধপাস করে বসে পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্যানি নাতালিয়া তাকে একমনে দেখছিলেন।
_এতো ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই...
নিজের কণ্ঠস্বরকে স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফিসফিসিয়ে বললেন নাতালিয়া,
_...এখানে সত্যিকারের ভয়ঙ্কর কিছু নেই। ঐ লোকগুলো কেবল চিৎকার-চ্যাচামেচি করে গলা ফাটাবে, তারপর বাসায় ফিরে যাবে।
_আমি আসলে ঘাবড়ে যাইনি। আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না। একটু অস্বস্তি লাগছে কেবল। আমারও মনে হয়, তেমন কিছু হবে না। আমি নিশ্চিত, বিােভকারী লোকদের মধ্যে কেবল অল্প কজনই উচ্ছৃঙ্খল; বেশি হবে না...
প্যান ফিসফিস করলেন। শিউড়ে শিউড়ে ওঠা শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নাতালিয়া। কিন্তু কণ্ঠ ঠিকই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে; কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার,
_রক্তয়ী কিছু ঘটবে না, দেখো।
_হঁ্যা, অবশ্যই ঘটবে না!
সময়টা এতো ভারি যে, তাদের মনে হলো উচ্চশব্দে বিস্ফোরিত বোমার গ্যাস-বলয় ভয়ঙ্কর শত্রু হয়ে ঘিরে ধরেছে তাদের আর এই অলুুণে সময় থেকে রেহাই পেতে তারা পরস্পর কোন মুখোশ পড়বেন_ বুঝতে পারছেন না।
তিনি কোথায় আছেন এ ব্যাপারে ওরা তো নিশ্চিত নয়, তবে কিভাবে তিনি উচ্ছৃঙ্খল বিােভকারীদের শিকার হবেন! তবু যদি দুবর্ৃত্তরা এসে পড়ে? হঁ্যা, তখন ওদের ঘিরে ধরলে আমৃতু্য যুদ্ধ করতে হবে।
উচ্চশব্দে কলিং বেল বেজে ওঠলে ভাবনায় ছেদ পড়ে চু্যবিনস্কীর। লাফিয়ে ওঠেন তিনি।
_যেও না! খুলো না দরজাটা...!
প্যানি নাতালিয়া অদ্ভুতভাবে হাত নেড়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। বেলটা ঝমঝম করে বেজেই চলেছে। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন চু্যবিনস্কী, 'বারবারা, বা-র-বা-রা...!'
_চুপ্, চিৎকার করো না...!
ধমকে ওঠেন নাতালিয়া। কিন্তু বারবারার দেখা নেই। তারা কী করবেন এখন? দুজন যখন দুজনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন অবাধ শূন্যতা নিয়ে, তখন এল কাজের মেয়েটি,
_ডাক্তার এসেছেন রান্নাঘর দিয়ে।
বারবারার কথা শেষ না হতেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলেন ডাক্তার। হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে উত্তেজনায় ভূতুরেস্বরে কথা বললেন দীর্ঘদেহী লোকটি,
_রাজ্যের কোন খবর না রেখেই ঘরের ভেতর দেখছি সেঁদিয়ে আছো তোমরা! ওদিকে ওরা মানুষ খুন করছে! যাকে সামনে পাচ্ছে, কসাইয়ের মতো নৃশংসভাবে হত্যা করছে। ডাক্তার গার্নিয়ারের এপার্টম্যান্টকে ধ্বংসসূ্তপ বানিয়ে দিয়েছে। চুরমার করে ফেলেছে সব যন্ত্রপাতি। বেচারার স্ত্রীকে চুল ধরে টেনে বাইরে সরিয়ে রেখেছে। হামলাকারীদের কপালে জারের ছবি আঁকা ছিল।
_ওহ্, স্রষ্টা!
_ওরা ইভান্কোকে ক্যাব থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। যতণ না স্বৈরতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দিব্যি কেটেছে, জালিজকো বেদম পিটুনি খেয়ে গেছে। মুমূষর্ু হবার আগ পর্যন্ত পিটুনি থামেনি ধাত্রীবিশারদ রাস্কেচেভিচের উপর। ওখানে কোন পুলিশ ছিল না। মাতাল দুবর্ৃত্তদের হাত থেকে কারো নিস্তার নেই। আমাদের অবশ্যই আত্মরা করতে হবে। ডোমার কাছে আমাদের জড়ো হওয়া উচিত। ...তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? নষ্ট করার মতো একটুও সময় হাতে নেই। নিজ হাতেই আমাদের আত্মরা করতে হবে।
যেন ডোমা স্কয়ারে হাজারো মানুষের নেতৃত্ব দিচ্ছে_ এরকম উত্তেজনায় একটানা কথা বললেন ডাক্তার। নাতালিয়ার মনে হলো, এ কণ্ঠ ভয়ানক তেজে তার হৃদয়কে ছিদ্র করে যাচ্ছে। 'জোরে নয়, এত্তো জোরে নয়...' _তীব্র যন্ত্রণায় কুচকে যাওয়া তার চোখ আর মুখবিকৃতি নিজের সঙ্গে জেরা করার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফুটে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে বুকের ক্রমবর্ধমান ও অসহিষ্ণু কম্পনকে আরো একবার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেন তিনি,
_ওহ্, প্যান ডাক্তার, প্যান ডাক্তার, একটু দয়ালু হবেন! ওহ্, স্রষ্টা...
ডাক্তার সেদিকে মন দিলেন না,
_তোমার বিভলবারটা নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।
_আমার তো রিভলবার নেই...!
রাগতস্বরে জবাব দিলেন চু্যবিনস্কী। বিস্মিত হওয়ার ভান করে শিস বাজালেন ডাক্তার,
_কেন? এটা কিভাবে বললে তুমি, যখন আমাদের... নো, মাই ডিয়ার স্যার, তা হতে পারে না। খাঁচায় বন্দি মুরগির মতো ঘাপটি মেরে বসে থেকে তুমি ধরা পড়তে চাও? ...ওকে, আমি যাচ্ছি!
_কিন্তু কোথায়...
চিৎকার করে জানতে চাইলেন প্যান ভ্যালেইরিয়ান চু্যবিনস্কী,
_যত্তোসব আজগুবি খোয়াব, তুমি কিছুই করতে পারবে না।
চু্যবিনস্কীর কথা অবজ্ঞা করে হাত নাচাতে নাচাতে তীব্র বেগে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার।
এক লজ্জাজনক ভয় পেয়ে বসলো চু্যবিনস্কীকে। কী করতে পারেন তিনি? শোচনীয় ও ভয়ঙ্কর পথে ধ্বংস হয়ে যাবার ইচ্ছে তার নেই। তার কি লুকানো উচিত? সারা ঘরে চোখ বুলালেন তিনি। দুহাতে মাথা চেপে ধরে বেহুঁশের মতো গোঙ্গাচ্ছে নাতালিয়া। বারবারা টেবিলের দিয়ে বিস্ময়কর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। মনে হয় তাদের এুণি পালানো উচিত, দৌড়ে। আলেয়ার মতো বিভ্রান্তকর হাজারো চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে আর মুহুমর্ুহু দিক বদলাচ্ছে। নাহ্, করার কিচ্ছু নেই। একটা তী্ন ভয় তাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর শিহরণকে চেপে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি; বিড়বিড় করে বলছেন নিজেকেই_ 'মাথাটা বিগড়ে ফেলো না!' তবু মাথা বিগড়ে যাচ্ছে খাঁচায় বন্দি বন্যপ্রাণীর মতো।
বারবারা কী বলছে?
_নাস্তা দেবো, সকালের?
কথাটায় কেমন যেন একটু প্রাণশক্তি খুঁজে পেলেন চু্যবিনস্কী,
_কী বলছো তুমি!
_সকালের নাস্তা এখনো খাননি কেউ; দেবো স্যার?
_নাস্তা? নাহ্! তুমি কি বুঝতে পাচ্ছো না কী হচ্ছে আজ?
_হঁ্যা!
এই 'হঁ্যা' শব্দটা তাকে সেই বিশৃঙ্খল চিন্তার পথ থেকে সরিয়ে দিল। দেখলেন, হঠাৎ কেমন করে যেন কেঁপে উঠছে তাদের কাজের মেয়েটা। একটা হালকা ভাব ছুঁয়ে গেল চু্যবিনস্কীকে,
_ওরা গণহত্যা করছে...
বর্ণনা করতে গিয়ে বিস্মিত হলেন তিনি, তার শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠলো উচ্চ হাসির শব্দে।
_কী হলো?
_আ... আ... আমি...
হাসির শব্দ আরো উচ্চস্বরে বাজতে লাগলো,
_হাহ্... হাহ্... হাহ্...হাঃ...! গুণ্ডারা সবাইকে মারছে! ভালো, মারতে দাও! হাহ্... হাহ্... হাঃ...! ওদের তো বহুত মতা! হাহ্... হাহ্... হাঃ...! তোমার কৃপা, হঁ্যা পরম করুণাময় দয়ালু, ওই লোকগুলো খামোকা দেরি করে নাই!
নিজের বুকে ক্রুশ চিহ্ন অাঁকলো বারবারা। ওর মুখ ঝলসে উঠছে, রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। মাতালের মতো দুলে দুলে হাসছে সে, জোর থেকে জোরসে। লাল হাত নাচছে। ভারি বুক দুলছে ব্লাউজের ফাঁক গলে। চর্বিভরা দেহ কাঁপছে থরথরিয়ে। এই উৎসবোন্মত্ত হাসির গর্জন বিপজ্জনক হয়ে উঠলেও থামছে না। মুখ ছিটকে বেরুচ্ছে থুথু।
_হাহ্... হাহ্... হাহ্... হাঃ...! ওদের উচিত সব নিশ্চিহ্ন করে ফেলা... হাহ্... হাঃ... এইসব ভদ্দরনোকদের বাচ্চাকাচ্চাসহ! হাহ্...
হাসতে হাসতে ফুঁপিয়ে উঠছে সে। এই না থামা উচ্চ হাসি সারা ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে ঝকঝকে বরফ কিংবা ছুরির মতো তী্ন আতঙ্ক নিয়ে। এ যেন হাসির মুষলধারা কিংবা ঝলসে দেওয়া বজ্রপাত, যা মৃতু্যগন্ধ মাখা আর ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনিময়।
চু্যবিনস্কী টেবিলের দিকে ঝুঁকে তাকালেন। এই হাসি তাকে কী এক অজানা অভিনন্দন জানাচ্ছে বলে মনে হল তার! বারবারা কী বলছিল তবে? কতক উদ্ভট-গর্দভমার্কা কথা!
_দূর হও আমার সামনে থেকে... বাসা থেকে বের হও...
প্যানি নাতালিয়া প্রথমটায় কিছু বুঝতে না পেরে লাফিয়ে উঠেছিলেন। আতঙ্কিত কণ্ঠে বারবারাকে আদেশ দিয়েও আশ্বস্ত হতে পারলেন না তিনি; তাকালেন স্বামীর দিকে,
_ও আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলবে; ওকে বের করে দাও!
বারবারা হাসি থামালো। তার বুক এখনো যাত্রার নৃত্যরত নায়িকাদের মতো বিশ্রীভাবে লাফাচ্ছে। কিছুণ মাথা নিচু করে রাখলো সে। তারপর আড়চোখে প্যানির দিকে তাকিয়ে পড়ে তাকা থালাটা তুলে নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেল। প্যান ও প্যানি তার অস্বাভাবিক হাঁটার শব্দ শুনলেন।
চু্যবিনস্কীর মনে হল তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। চারদিকে চোখ বুলালেন তিনি। কয়েক পা হেঁটে বারবারার দিকে তাকাতে ইতঃস্তত করলেন। দ্রুতবেগে রান্নাঘরের দরজা খুললেন তিনি। যা দেখলেন তা অদ্ভুত ও অভাবনীয়। এ এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন যেন_ টেবিলের উপর নুয়ে নির্ভীক চিত্তে আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে আর থালা-বাসন ধুচ্ছে বারবারা!
_বারবা...
আটকে গেল নামটা! কিছু বলতে পারলেন না চু্যবিনস্কী, কেবল দাঁড়িয়ে থাকলেন। তার প্রশস্ত চোখ কী যেন খুঁজে চলেছে_ তিনিই বুঝতে পারছেন না। চারপাশের দৃশ্যগুলো অন্ধের মতো মগজে গেঁথে ফেলতে চাইছেন_ ঘামে মাখা পশুর মতো খসখসে নগ্ন লাল পা কিংবা কাঁধের উন্মত্ততা বারবারার মাঝে কোন উষ্ণতা তৈরি করেনি; দিয়েছে ফ্যাকাসে মেজাজ আর চোখের নিচে গাঢ় নীল দাগ। 'খাবারের টেবিলে ওর সাজানো খাবারগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় ওর সারাটা জীবন আমরা খেয়ে ফেলেছি'_ হুট করে এ কথাটা মনে হল গৃহকর্তা চু্যবিনস্কীর।
রান্নাঘরের আবছা ধোঁয়া, টেবিলের উপর পানি উপচে পড়া বালতি, ময়লা-আবর্জনার গুহাজীবন... অন্যদের জন্য খাটতে খাটতে ওর জীবনটা দুর্বল, একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে; হয়ে গেছে বিষণ্ন, থরথরে কুয়াশায় সাজানো জোয়ালের গরুর মতো দাসত্বের চিহ্ন মাখা। আশার নিভু নিভু আলোবিহীন এই বারবারা সবই করছে কেবল অন্যদের স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে। চু্যবিনস্কীর মনে হলো, কাজের এই মেয়েটির সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার অজান্তেই তারা দিন দিন করে যাচ্ছেন।
তিনি কোন কথা বললেন না। কেন বললেন না? সব কি পরিস্কার নয় তার কাছে? বসার ঘরে ফিরে এলেন চু্যবিনস্কী।
_তুমি কি দেখেছো...
স্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন,
_দ্যাখোনি? তোমার দেখা দরকার।
_কেন সেও যায়নি স্ট্রাইকে!
_কেন যায়নি বারবারা?
উত্তর দেওয়ার বদলে স্ত্রীর কথাটাকেই পুনারাবৃত্তি করতে গিয়ে উদ্ভটভাবে ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। খোলা চাবুকের মতো পতপত করে পুরো ঘরে হাঁটলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। জানালার দিকে ঝুঁকে দ্রুত ও অস্থিরভাবে বল্টুগুলো আলগা করে দিলেন।
_করছোটা কী, তুমি!
চিৎকার করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন নাতালিয়া। ভাবতে পারছেন না চু্যবিনস্কী। সব শক্তি দিয়ে খুলে ফেললেন বল্টু। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে পড়ল জানালাটা আর মুহূর্তেই অবাধ সৌন্দর্যময় কুয়াশাচ্ছন্ন হলুদ আলোয় ভরে গেল বন্দি থাকা ঘরটা। হেমন্তের দমকা বাতাসে একপাল ঠাণ্ডা ময়লা আর বিশৃঙ্খল কণ্ঠস্বর হুহু করে ঢুকে পড়ল এই সুযোগে।
_কেন সে আন্দোলনে যায়নি?
দূর থেকে ভেসে আসা হাঙ্গামার গর্জন আর ঠাণ্ডা বাতাস চু্যবিনস্কীকে দম নিতে দিচ্ছে না। তার ভেতর দিয়ে যেন সমস্ত রাজপথ এখন গোঙাচ্ছে।
_আ... আ... আ...
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে ভেসে এলো আর্তনাদ।
_আ... আ... আ...
মনে হয় কাছে কোথাও উৎপন্ন হচ্ছে এই স্পষ্ট উচ্চারণ, গ্লাসের টুংটাং, হৃদয় বিদারক আহাজারী আর হাজারো পায়ের হুমড়ি খেয়ে পড়ার শব্দ।
ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচতে গিয়ে একটি ট্যাঙ্ িক্যাব আছড়ে পড়লো পাথরের দেয়ালে, যখন আকাশে ভেসে বেরাচ্ছে হলুদাভ মেঘ আর 'আ... আ... আ...'
[ইউক্রেনিয়ান লেখক ও বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক 'মিখাইল মিখাইলোভিচ কৎসু্যবিনস'ি (1864-1913) ভিনাসা শহরের এক কেরানি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইউক্রেনের নানা গ্রাম ও উপশহরে তার শৈশব ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো কেটেছে। তার মা ছিলেন অন্ধ আর বাবা চাকরি হারালে পুরো পরিবারটিই এক গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন_ 'আমাদের পরিবারের দুর্ভাগ্য আমাকে দ্রুত অধিক আন্তরিক ও চিন্তাশীল করে তুলেছে।'
বিপ্লবের সঙ্গে তার আত্মিক বন্ধনেরর কারণে পরবর্তীকালে তিনি আদালতে জেরার মুখে পড়েন। এ সময় তার বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশী চালানো হয় এবং অত্যন্ত সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে তাকে গোপনে তী্ন নজরদারীতে রাখে পুলিশ।
1884 সালে কৎসু্যবিনস্কি সাহিত্যকর্ম শুরু করেন; যদিও তার প্রথম লেখা লেখা ছাপা হয় আরো ছয় বছর পর। ধীরে ধীরে গ্রামের একজন গ্রাজুয়েট স্কুল শিক থেকে তরুণ সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন তিনি। 1898 থেকে তিনি চেরনিগোভ শহরে বাস করতে শুরু করেন। স্বাস্থ্যের উন্নতির ল েএ সময় নানা দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। এ রকমই এক মুহূর্তে ইতালির কাপরি শহরে বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ম্যাঙ্মি গোর্কির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার।
কৎসুবিনস্কির সাহিত্যকর্ম খুব বেশি নয়। দুখণ্ডে সমাপ্ত 'ফ্যাটা মোরগানা' নামের দীর্ঘ উপাখ্যানটি তার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরবর্তীতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়েছে_ যেখানে চিত্রিত হয়েছে রুশ বিপ্লবের আগে ও পরে (1905-1907) ইউক্রেনিয়ান মেজুর শ্রেণীর নির্মম জীবনযুদ্ধ। তিনটি ঠোট আখ্যান ছাড়াও চলি্লশটির মতো গল্প লিখেছেন তিনি। 1906-এর 7 ফেব্রুয়ারি চেরনিগোভে বসে লেখা 'হলুদ মেঘ' গল্পটি 'ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউজ, মস্কো' থেকে প্রকাশিত তার 'ক্রাইসেলাইস এন্ড আদার স্টোরিজ' গ্রন্থের 'লাফার' -এর অনুবাদ_ যা মূল রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জেকব গুরালস্কি]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



