ভ্যারিয়েন্ট কি?
সব ভাইরাসই সময়ের সঙ্গে স্বভাবতই বদলাতে থাকে, সার্স-কোভিড-২ এক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম নয়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে যখন এই ভাইরাসটি প্রথম চিহ্নিত হয়, তারপর এটির হাজার হাজার মিউটেশন হয়েছে। মিউটেশনের মাধ্যমে এভাবে যে পরিবর্তিত ভাইরাস তৈরি হয়, তাকে বলা হয় ভ্যারিয়েন্ট। কোন কোন মিউটেশন এমনভাবে ঘটে, যা ভাইরাসটিকে টিকে থাকতে এবং বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
প্রধান প্রধান ভ্যারিয়েন্টগুলো কী কি?
বিশেষজ্ঞরা মূলত চারটি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে চিন্তিত: আলফা (প্রথম ধরা পড়ে যুক্তরাজ্যে), বেটা (দক্ষিণ আফ্রিকা), গামা (ব্রাজিল) এবং ডেল্টা (ভারতীয় উপমহাদেশ)। এই ভাইরাসগুলো আরও বেশি সংক্রামক, এগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তি আরও বেশি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে এবং এই ভাইরাসটি আরও বেশি টিকা প্রতিরোধী হতে পারে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দিকেই সাম্প্রতিককালে বেশি মনোযোগ দেয়া হচ্ছে, কারণ এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চাইতে অনেক বড় হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, আলফা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এটি ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। আর আলফা ভ্যারিয়েন্ট আবার প্রথম ধরা পড়া করোনাভাইরাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রামক।
ডেল্টা প্লাস এবং ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্ট কি?
গত ২৩শে জুন ভারত ডেল্টা প্লাস বলে আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছে, যেটিকে তারা উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড এটিকে প্রথম ডেল্টার মতোই একটা ভ্যারিয়েন্ট বলে বর্ণনা করেছিল। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে আরেকটি মিউটেশনের (কে৪১৭এন) ফলে এই নতুন ধরনটি আক্রান্ত কোষের সঙ্গে নিজেকে আটকে ফেলতে পারে। ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে আরও নয়টি দেশে: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, সুইটজারল্যাণ্ড, জাপান, পোল্যাণ্ড, নেপাল, রাশিয়া এবং চীন। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডেল্টা প্লাস অনেক সহজে ছড়ায়, ফুসফুসের কোষে অনেক সহজে সংযুক্ত হতে পারে এবং এটির বিরুদ্ধে 'মনোক্লোনাল এন্টিবডি থেরাপি' বলে একধরণের ঔষধ কাজ করে না। তবে শীর্ষস্থানীয় ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, এরকম উপসংহারে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট তথ্য আসলে এখনো পাওয়া যায়নি। একারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো এটিকে একটি আলাদা ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেনি।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ল্যাম্বডা ভ্যারিয়েন্টকে তাদের তালিকায় যোগ করেছে। বেশ কয়েকটি দেশে এই ভ্যারিয়েন্টটি দেখা গেছে, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা এবং আন্দেজ অঞ্চলে (পেরু, চিলি, আর্জেন্টিনা এবং একুয়েডর)।
এই ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে টিকা কতটুকু কার্যকর?
তবে একটা সুসংবাদ হচ্ছে, সার্স-কোভিড-টু এর বিরুদ্ধে যত টিকা এখন পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো কাজ করছে বলে প্রমাণ মিলছে গবেষণায়।
তবে করোনাভাইরাসের আদি ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এসব টিকা যত কার্যকর ছিল, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বেলায় কিছুটা কম। বিশেষ করে যারা কেবল টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় বলা হয়, ফাইজার বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার একটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৩ শতাংশ সুরক্ষা দেয়, অন্যদিকে আলফা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় ৫০ শতাংশ। তবে যারা দুটি ডোজই নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ফাইজারের বেলায় ৮৮ শতাংশ এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার বেলায় ৬০ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যায়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক স্বতন্ত্র গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে পাওয়া ডেল্টা এবং কাপা ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রেজনেকার দুটি টিকাই কাজ করে। 'সেল' জার্নালে প্রকাশিত এত নিবন্ধে গবেষকরা বলেন, "এই টিকা ব্যাপকহারে অকার্যকর হচ্ছে এমন কোন প্রমাণ নেই । যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বর্তমান প্রজন্মের টিকাগুলো কাজ করছে।"
"কিন্তু যেহেতু এই টিকাগুলো শতভাগ কার্যকর নয়, তাই টিকা দেয়ার পরও বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত অনেককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এমনকি টিকা দেয়া অনেক মানুষ, বিশেষ করে যারা কেবল একটি ডোজ নিয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যুও ঘটবে", বলছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ জুন পর্যন্ত ১৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে টিকার সবগুলো ডোজ দেয়া হয়েছে। তবে টিকা নেয়ার পরও তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৭২৯ জনের কোভিড হয়েছে এবং ৬৭১ জন মারা গেছে।
বিশেষজ্ঞ মতামতঃ
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জিওগ্রাফিক ইনসাইটস ল্যাবের প্রফেসর এসভি সুব্রমানিয়ান বলেন, কেবল টিকা দিয়ে এই মহামারি থেকে কোন দেশ বেরিয়ে আসতে পারবে না। তিনি জোর দিচ্ছেন চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে আরও বেশি নজর দেয়া, বিশেষ করে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন এবং স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ানোর ওপর। "আমার মতে, এই ভাইরাসটি যখন মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে, এটির বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা কোনভাবেই জয়ী হতে পারবো না। কিন্তু আমরা এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, যাতে লোকজনকে আশ্বস্ত করা যায় যে, যখন দরকার হবে তখন তারা সহজে এবং সুলভে চিকিৎসা সেবা পাবে।" "চিকিৎসা এবং আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দিকেই আমাদের প্রচেষ্টা ফিরিয়ে আনার এটাই উপযুক্ত সময়", বলছেন প্রফেসর সুব্রমানিয়ান।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৫