বাসার কাছেই একটা মনিহারি দোকান। কমবয়সী এক ছেলে বসে, মাঝেমধ্যে বসে মধ্য বয়সী এক লোক। একদিন কিছু একটা কিনতে দোকানটায় ঢুকলাম। দোকানে বসা ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক মহিলা বললেন, মামা, কী লাগবে?
আগে কখনও উনাকে দেখিনি। হঠাৎ আমাকে মামা ডাকায় বিরক্ত হলাম। এত বয়স্ক কি আদৌ হয়েছি? বললাম, আমি আপনার কোন কালের মামা?
মহিলা হাসলেন। বললেন, ছেলের বয়সী তো হবেন।
মহিলা আমার চেয়ে ৪-৫ বছরের বড় হতে পারেন বড়জোর। সে হিসেবে আমি উনার ছোট ভাই হতে পারি, ছেলের মতো কীভাবে হই?
যাহোক, বললাম, ছেলের মতো যেহেতু তাহলে বাবা ডাকুন।
তাই বলে সম্বোধন করলেন।
কথাপ্রসঙ্গে উনার ছেলের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। উনি জানালেন উনার ছেলে এবার অনার্সে ভর্তি হবে।
আর আমি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম ১৩ বছর আগে। বুঝতে পারছি না বয়স কি আমার বাড়েনি না কি?
প্রাণ- এ এক সপ্তাহ কাজ করার সময় একদিন এক ছেলে এল। তুমি সম্বোধন করে কথা বলছিল। আমি জানতাম এই ছেলে আমার চেয়ে কমপক্ষে আট বছরের ছোট হবে। তাও ওর কথা শুনছিলাম। আমার এক সহকর্মী বলল, ভাই কিন্তু আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। অনার্স-মাস্টার্স অনেক আগেই শেষ। ছেলেটা থতমত খেল। বলল, ভাইকে দেখে মনেই হয় না উনি বড়।
একবার এক কোচিং এ ক্লাস নিতে গেলাম। পরিচালনায় থাকা ম্যাডাম তুমি সম্বোধন করে বললেন, পড়াতে পারবে তো? আমি বললাম, ৬ বছর ধরে পড়াচ্ছি। পারার কথা তো। উনি ভাবছিলেন আমি মাত্র অনার্সে পড়ি। প্রসঙ্গত, ওই কোচিং এর বেশিরভাগ শিক্ষকই অনার্স পড়ুয়া ছিলেন।
যাহোক, দোকানের ওই মহিলার সঙ্গে অনেক কথা হলো। আমি কী করি, কোথায় থাকি; এসব আর কী।
অনেকদিন পর ওই দোকানে যেতেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফের দেখা। চিনতে পারলেন না। আগের কথা মনে করিয়ে দিতেই চিনতে পারলেন। বললেন, উনার ছেলের জন্য যেন একটা-দুটো টিউশনি দেখি।
২
অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলাম। আমার আগের বাসার বাড়িওয়ালীর সঙ্গে দেখা হলো। অনেক কথাও হলো। আমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলেন। বললাম সব। তারপর আমাকে বললেন উনার মেয়ের জন্য যেন ভালো চাকরি দেখি। মজার ব্যাপার হলো, উনার মেয়ে পাশেই এক জায়গায় একটা চাকরি করেন। আমার চেয়ে ৫-৭ হাজার বেশি তার বেতন। বাসায় থেকে-খেয়েও পোষায় না। আমি তাকে কী করে চাকরি দিতে পারি? বললাম না কিছুই।
বাড়িওয়ালী টিউশনি দিতে বললেন। আমি বললাম, কার জন্য?
উনি জানালেন উনার নিজের জন্য।
আমি বুঝতে পারছিলাম না হাসব না কি কাঁদব। ষাটোর্ধ এক নারী, উনি না কি টিউশনি করাবেন। যার আবার ঢাকায় ৩ টা বাড়ি আছে।
উনি জানালেন সময় কাটানোর জন্য টিউশনি দরকার। হালকা হাত-খরচ এলেও মন্দ না। দেখব বলে কেটে পড়লাম।
মহিলার বাসায় কয়েকমাস ছিলাম। সিঙ্গেল একটা রুমে উঠার কথা ছিল আমার। অগ্রিম টাকা দিতে পারিনি বলে অন্য রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল।
৩
চাকরি হারানোর পর এমন দুরবস্থা হয়েছিল যে বাড়ি চলে যাব ভাবছিলাম। তারপর ভাবলাম দেখি ঢাকায় কোনোমতে টিকে থাকা যায় কি না। মোড়ে মোড়ে পড়াতে চাই লিখে লিফলেট টাঙালাম। কোনো ফোন পাইনি। তারপর একটা টিউশন মিডিয়ায় যোগাযোগ করি। তারা একটা টিউশনি জুগাড় করে দেয়। মালিবাগ থেকে মুগদায় যেতাম পড়াতে। যাওয়া-আসা ১ ঘন্টা। পড়ানোয় ১ ঘন্টা। মাস শেষে পেতাম ২ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫০০ চলে যেত ভাড়াতেই।
তারপর একদিন একটা ফোন পেলাম টিউশনির। বেতন নিয়ে কথা হয়নি। মাস শেষে ৪ হাজার টাকা পেলাম। ওই মুহুর্তে ওই টাকাই অনেক। অফিস শেষে এই টিউশনিটা এখনও করাই। তবে আমি যে ঠকে যাচ্ছি তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। ইংলিশ ভার্সনের একটা ৩য় শ্রেণির বাচ্চা সপ্তাহে ৬-৭ দিন পড়িয়ে মাস শেষে ৪০০০ পাই। কোনো কোনো মাসে তারও কম। টিউশনিটা দরকার তাই ছাড়তেও পারি না।
ঢাকা শহরে টিউশনি জুগানোও কঠিন, টেকানো তো আরও কঠিন। কত বুয়েট-মেডিক্যাল-ঢাবির শিক্ষার্থী। এদের ভিড়ে অন্যান্য ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সুযোগই পায় না।
আমি যেখানেই যাই, অনেকেই বলে টিউশনি জুগাড় করে দেন। ওদের বলতেও পারি না ঢাকায় চলতে যে খরচ, আমার নিজেরই আরও টিউশনি দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:১৯