বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।
বিশ বছর বয়স পর্যন্ত অতি মাত্রায় অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম। যাকে বলে সাত চড়ে রা বেরোত না। তারপর জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় নিজের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এল।
যাহোক, ওই সময়টায় আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম না। গান শুনতে গেলে বা নাটক-সিনেমা দেখতে গেলেও আনন্দ পেতাম না। কেমন একটা বিষন্ণতা ভর করত নিজের মধ্যে। কেন জানি এই দুঃখকেই উপভোগ করতাম। নিজের বিফলতার জন্য নিজেই দায়ী, তবুও দেখা যায় দুঃখকে উপভোগ করার কমতি নেই।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, সেটা গ্রামের দিকে পড়েছে। চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল বা আনন্দ শোভাযাত্রা বেরোত। চলে আসত উপজেলার বাজার পর্যন্ত। বিকেলে হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ওই এলাকায় যে ক'বছর থেকেছি, প্রতি বছরই শোভাযাত্রায় যেতাম। আমার খুব আফসোস হতো এটা ভেবে যে, কেন নাট্যকলা বা বাংলায় ভর্তি হলাম না। অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও নিজের খোলস থেকে বেরোবার চেষ্টা করতাম।
ছবি আঁকতে পারতাম না, তাই চারুকলায় পড়ার আশা কখনো ছিল না। বাংলা বা ইংলিশে পড়ার সুযোগ ছিল। বাংলায় মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পর বাংলায় ভর্তি না হয়ে ব্যবসায় শিক্ষা শাখার একটা বিষয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা, ওটা জীবনের অন্যতম বড় ভুল ছিল আমার। পড়ালেখা বা যে কোনো কাজই যে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয় না, তা বুঝতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।
ব্যবসায় শিক্ষা কখনোই ভালো লাগেনি আমার। স্কুল-কলেজে পড়ালেখায় অতটা চাপ ছিল না, তাই সমস্যা হয়নি। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর চাপে পড়ে যাই। তারপর তীব্র অভাব-অনটনে ধুঁকতে লাগলাম। সব মিলিয়ে বেকায়দায় ছিলাম। ব্যবসায় প্রশাসনে পড়া ভীষণ বিরক্তিকর মনে হতো।
বাংলা, ইংলিশ, চারুকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত বিভাগগুলো ভালো লাগত আমার। ওদের সব অনুষ্ঠানেই যেতাম। সাহিত্যের প্রতি মুগ্ধতা তো ছোটবেলা থেকেই ছিল। দেখা যেত সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বসে সাহিত্য পড়ছি। ময়মনসিংহে যাওয়ার পরও এই অভ্যাসটা ছিল। মুসলিম ইন্সটিটিউট কিংবা জেলা গ্রন্থাগারে ছিল আমার নিত্য যাতায়াত।
ময়মনসিংহে দারুণভাবে বৈশাখ উদযাপন করা হতো। বিশেষ করে জয়নুল আবেদীন পার্ক তো রমরমা থাকত। সার্কিট হাউজ মাঠে খেলা হতো। বাহারি রঙে সেজে লোকজন আসত। বৈশাখী পোষাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে দারুণ মানাত। মেলা বসত। পুরো শহরে উৎসবের আমেজ থাকত।
আমি এখন পর্যন্ত যত জায়গায় গিয়েছি, ময়মনসিংহের মতো এমন টানে আর কেউ টানেনি। নিজের জন্ম-জেলা বলেই হয়তো মায়া কাজ করে। আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গীও বৈকি।
জয়নুল আবেদীন পার্ক যেমন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্রের পাড়টা তো আমার স্বর্গ মনে হতো। আমি শয়নে-স্বপনে-জাগরনে এই পাড়টার কথা ভাবি। এত মায়া কেন স্থানটার প্রতি নিজেও জানি না। ময়মনসিংহে যাওয়ার সুযোগ হলে এখানে যাই। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাতেও বিমল আনন্দ।
ছোটবেলার এলাকার কলেজের মাঠেও বৈশাখের অনুষ্ঠান হতো। পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার বৈশাখী মেলাগুলোও মিস করি অনেক। মাটির ব্যাংক, পুতুল বা হাড়ি, হাতি-ঘোড়ার মূর্তি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসত কুমোরেরা। ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে কিনত।
মিস করি ভোরে ঘুম থেকে ওঠে পান্তা খাওয়া। ইলিশ খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না আমাদের। মা চেষ্টা করতেন বড় মাছ ভাজি করতে, বা চ্যাঁপা-শুটকি রান্না করতে। অনেক সময় ক্ষেত থেকে কচু শাক তুলে আনতেন। কচুর ডাটা দিয়ে ঘন্টা রাঁধতেন। এর স্বাদ জগতের আর কোনোকিছুর সঙ্গে হয় না।
গ্রামে গ্রামে নতুন বছরকে বরণের যে ছোটখাটো প্রস্তুতি, তা আমাদের মতো শিশু-কিশোরদের নাড়া দিয়ে যেত।
ঢাকায় তো সার্বজনীনভাবে বৈশাখী উৎসব পালন করা হয়। রমনার বটমূলে বড় আয়োজন হয়। তারপর সারাদিনব্যাপী সংগীতায়োজন বেশ ভালো লাগে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে লোকজনের আলোচনা-সমালোচনা চললেও দেখা যায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ভেদাভেদ ভুলে বাঙালির চিরাচরিত রীতিতে সকলেই একীভূত হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:৪৬