আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। হাতে প্রায় তিন মাস সময় আছে। ভাবছি কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়। এর মধ্যেই হঠাৎ জনৈক মামাতো ভাই এসে হাজির। বাড়িতে আমার মন টিকছিল না। ভাবলাম, কিছুদিনের জন্য মামার বাড়ি বেরিয়ে আসা যাক।
আমাদের গ্রাম থেকে উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ১৩-১৪ কিলোমিটার। মামাতো ভাইয়ের সাথে উপজেলা সদরে গিয়ে মনে হলো একটা বই কিনে নিলে ভালো হয়। কী বই কেনা যায়? ভাবনা-চিন্তা করে কিনলাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ট্রাজেডিসমগ্র। বেড়ানোর ফাঁকে পড়ে নেওয়া যাবে। বই পড়ার প্রতি বরাবরই ঝোঁক ছিল। এবার হাতে অঢেল সময় পেয়ে সময়টাকে উপভোগ করা যাবে।
মামারা সাত ভাই আর বোন কেবল আমার মা। আমার বয়সি বা কাছাকাছি তিন মামাতো ভাই। আমিসহ চার জনের কাজ আপাতত টইটই করে গ্রামময় ঘুরে বেড়ানো। গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথায় যাই আর নিত্যনতুন আবিষ্কারের ধান্দায় থাকি। রাত হলে ভিসিআরে সিনেমা দেখি।
দুই দিন যেতে না যেতেই দায়িত্ব একটা চাপল আমার কাঁধে। এক মামা বললেন ছেলেমেয়েদের পড়াতে। পড়ানো অবশ্য সমস্যা না। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তৃতীয় শ্রেণির ছেলেমেয়েদের ক্লাস করিয়েছি। মানে আমাদের শিক্ষকগণ মাঝেমধ্যে বড়ো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিয়ে ক্লাস করাতেন। সেরকম আর কী!
সে না না হয় গেল ছোটোদের কথা। এখন যাদের পড়াতে বলা হচ্ছে; এদের মধ্যে ছোটো যেমন আছে, আমার সমবয়সি এবং বয়সে বড়োও আছে দুই জন। যাদের সাথে বন্ধুত্ব বা যাদের বড় জানি, তাদের কী করে পড়াই? কিছু করার নেই। আমি যাব বঙ্গে, (আমার) কপাল যাবে সঙ্গে অঙ্গে গেরোয়া বসন যতই পরি না। যাহোক, পড়ানো শুরু করলাম। বিশেষত, ইংলিশ গ্রামারের ওপর জোর দিলাম বেশি। এরা ইংলিশে অত্যাধিক দুর্বল। তারপর অন্যান্য বিষয়ে পড়ানো শুরু করলাম। ফলও আসতে লাগল দ্রুত। ভেবেছিলাম এদের পড়িয়ে জুৎ করতে পারব না।
আসলে এ এলাকাটা এত পশ্চাৎপদ যে, এখানে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। অনেক পয়সাওয়ালা লোকের ছেলেমেয়েও পড়ালেখা করে না। পড়ার যে পরিবেশ দরকার; সেটা এখানে অনুপস্থিত। মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যায় আর ছেলেরা কাজকর্মে ঢুকে পড়ে। অথচ এখানে অনেকের এমন সামর্থ্য আছে যে, চাইলে ছেলেমেয়েদের বিদেশে নিয়ে পড়াতে পারেন। যদিও বিদেশ বা শহরে নিয়ে পড়ানোর ইচ্ছে এদের নেই। অল্পবয়স থেকে টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারলেই হলো।
একমাস-দু’মাস-তিন মাস; সময় যে কেমনে কেটে গেল টেরই পেলাম না। এমন মৌজ-মাস্তি আর কোথাও করা হয়নি কখনও। সুযোগও পাইনি। শুধু মৌজ-মাস্তি, তা নয়। এসময়ে শেক্সপিয়রের ট্রাজেডিসমগ্র শেষ করেছি। শেষ করেছি বড়ো মামাত ভাইবোনদের সংগ্রহে থাকা বেশ কিছু বই। বেশ কিছু কবিতাও লিখেছি।
একসময় বাড়ি ফিরতে হলো। কলেজে ভর্তির তারিখ দিয়েছে। মিস করছিলাম মামার বাড়ির মুহুর্তগুলো। বাড়ি আসার সময় এক মামি পকেটে তিন হাজার টাকা গুঁজে দিলেন। আমি বিস্মিত হলাম। আসলে ওই সময়ে তিন হাজার টাকা অনেক টাকা। এত টাকা দিয়ে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে মনে খুব খুশিই হলাম। জীবনের প্রথম উপার্জন। খুশি না হয়ে উপায় আছে?
ছবিঃ প্রতীকী