‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটা দেখার পর দুর্গার জন্য মন খারাপ হয়নি; এমন মানুষ হয়তো নেই। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস হিসেবে যেমন মাস্টারপিস, চলচ্চিত্র হিসেবেও কম যায় না; এটা নিশ্চিত স্বীকৃত। অস্কারপ্রাপ্তি অন্তত তাই বলে। চলচ্চিত্রটা দেখার পর পরবর্তী সিরিজ ‘অপরাজিত’ আর ‘অপুর সংসার’ দেখা হয়নি। যদিও অপুর, তার মা-বাবার কী হয়েছিল, সেটা জানার আগ্রহ সবসময় ছিল।
এরমধ্যে একদিন হুট করে বসেই পড়লাম ‘অপরাজিত’ দেখতে। ‘পথের পাঁচালী’তে যেমন অপু-দুর্গার শিশুকাল দেখানো হয়েছে, ‘অপরাজিত’তে দেখানো হয়েছে তার কৈশোরের বেড়ে ওঠার ঘটনাবলি। বাবার মৃত্যুর পর সংসারে টানাপোড়েন। মায়ের অসহায়ত্ব। মায়ের সাথে মায়ের জ্যাঠার বাসায় চলে আসা। সেখানে বাবার পেশা পুরুতগিরি করা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
অপুর স্কুলে ভর্তি হওয়া এবং ভালো ফল করা সবাইকে খুশি করলেও মাকে একা রেখে কলকাতায় চলে যাওয়া ব্যথিত করেছে। তবে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য অন্য উপায় তো ছিল না। পুরুতগিরি করে তো জীবন পার করে দেওয়া যেত না। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আনুকুল্যে কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নিয়ে কাজ করে পড়ালেখা চালানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তবে অপু তার কাজ ভালো মতোই করেছে। যদিও তার মায়ের সাথে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। সে খুব কমই বাড়িতে আসতে পেরেছে।
অসহায় মা দিনের পর দিন তার আশায় থেকেছেন। শেষে বড়ো অসুখ হওয়া সত্ত্বেও অভিমানে ছেলেকে না জানানোটা মনে দাগ কেটেছে। আর তার মৃত্যুর পর অপু যখন বাড়ি এসে দেখে বাড়িটা পুরো বিরানভূমি, তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
চলচ্চিত্রটা দেখে প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। শুয়ে এটাসেটা ভাবছিলাম। রাত এগারোটা বাজছিল তখন। এরমধ্যে বাড়ি থেকে ফোন এলো। জানানো হলো আমার এক কাকা মারা গেছেন। মন খারাপের মাত্রাটা আরও বাড়ল। গতমাসের মাঝামাঝি একবার বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। এ মাসের ২ তারিখ একটা পরীক্ষা ছিল। ভাবছিলাম একবারেই যাই। টানাপোড়েনের মাঝে কিছু টাকা বাঁচুক। এমন ঘটনা যে ঘটে যাবে কে জানত? বিকেলেও যদি অবস্থা আঁচ করতে পারতাম, চলে যাওয়া যেত।
যাহোক, ভোরে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। সাড়ে ১০টা বাজল যেতে যেতে। গিয়ে দেখি বাড়িতে কান্নাকাটি করে সবাই অস্থির। মনটাকে স্থির করে কাকি আর কাকাত বোনকে সান্ত্বনা দিলাম। ফোনে প্রবাসী কাকাত ভাইকেও বললাম ধৈর্য ধারণ করতে। ২০-২২ বছরের একটা ছেলে, তার কি এত বুঝ আছে? বাবা সারা জীবন কষ্ট করেছেন। ছেলেটা চেয়েছিল বাবা-মার দুঃখ মোচন করতে। করেছেও অনেকটা। অনেক চিকিৎসাও করিয়েছে। এখন আর কিছু করার ছিল না। কিডনি দুটোই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শরীর ফুলে যেত। গলা দিয়ে রক্ত আসত। শুরু থেকে চিকিৎসা করার সুযোগ থাকলে হয়তো বেঁচে যেতেন, কিন্তু আমার বাবা-কাকারা বরাবরই গোয়ার্তমি করতেন। নিজেদের শরীরের ব্যাপারে বরাবরই তারা উদাসীন। বাবা-কাকারা সাত জন। এক কাকা (পঞ্চম) মারা গেলেন। বাকি রইলেন ছয় জন। আমার বাবাও মৃত্যুপথযাত্রী।
সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে কাকাকে অন্তিমশয্যায় শায়িত করে ভাবলাম কাকাত ভাইকে একটা ফোন দিই। দুই দিন ধরে সে ঘুমহীন, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। বললাম, “কিছু একটা খা। সবাই মরলে তো হবে না।” সে যখন আফসোসের স্বরে বলে, “বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পেলাম না।” আমি বলি, “তুই তো সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিস ভালো করতে। দেশে থাকলে এত টাকা তো পেতি না চিকিৎসার। সান্ত্বনা এটাই যে, শেষ চেষ্টাটুকু করতে পেরেছিস। আর আমি তো...”
ঢাকায় ফেরার সময় মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাবার কাছে গেলাম, বারবার মনে হচ্ছিল এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো?
ছবি: অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২৪ সকাল ১০:৩১