গাজীপুরের কোনাবাড়িতে থাকতাম তখন। পড়াতাম একটা বেসরকারি স্কুলে। যাদের শহরের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে, তারা জানেন এখনকার ছেলেমেয়েদের সামলানো কী কঠিন। শুধু পড়ালেখার কথা বলছি না। এদের আচরণ ঠিক করা, মনমতো চলা, ক্লাশে মনোযোগ ফিরিয়ে আনা- এসব যে কী কষ্ট, অভিজ্ঞরাই কেবল জানে। ঘাম বেরিয়ে যায়।
প্রায় ১০-১২ টা স্কুলে পড়িয়েছি। টিউশনিও করিয়েছি অনেক। কত যে বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতা। শুরুতে সামলাতে না পারলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্ততা চলে আসে। একটা সময় এমন হয়েছে যে, ছেলেমেয়েদের গালমন্দ বা মারপিট করলেও মন খারাপ করত না। অবশ্য ওরা দ্বিধায় পড়ে যেত আমার আসল রূপ কোনটা ভেবে। আমি বকাঝকা বা মারধর করি। আমি দুষ্টলোক এটা। না কি আমি সাহিত্যমনা। ওদের আদর করি। ভালো লোক।
মাঝেমধ্যে রাগারাগি করে অফিসে এসে বলতাম, ইচ্ছামতো বকাঝকা করেছি। মারধরও করেছি। সহকর্মীরা বলতেন, আসলেই? আপনি বকতেও পারেন? আমি বুঝাতেই পারতাম না যে আমি মাঝেমধ্যে ক্রুদ্ধ হয়ে যাই।
সেখানে থাকতে থাকতে সবার প্রিয় হয়ে ওঠেছিলাম। এমন হয়েছে প্রতিষ্ঠানে কাকে নিয়োগ দেবে না দেবে, পরীক্ষার প্রশ্ন, উত্তর সব আমি দেখতাম। আমার পরামর্শে প্রধান শিক্ষক শিক্ষক নিয়োগ দিতেন।
একবার এক শিক্ষক এসে পরীক্ষা দিলেন। মোটামুটি ভালো হয়েছে পরীক্ষা, কিন্তু ক্লাশে গিয়ে পড়াতে পারেন না। ছেলেমেয়েরা পছন্দ করে না। আমি তার সম্পর্কে ভালো জানতাম। প্রথমদিন হয়তো ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেছেন। প্রধান শিক্ষককে বলায় কেবল আমার সুপারিশেই তার চাকরিটা হলো।
যদিও অন্যান্য সেক্টরে তেমন সুবিধা করতে পারিনি। সরলতা কোনো কাজে লাগেনি। কাজে লাগেনি ভালোমানুষি। সবাই নিজের মতো চলে। অবস্থান দেখে মানুষের মূল্যায়ন করে। সেসব অন্য আলাপ। এখন বিব্রতকর একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করব।
সপ্তম শ্রেণির ক্লাশ নিচ্ছি। আলামিন নামের এক ছাত্র বলল, স্যার, ওয়াশরুমে যাব। খুব জরুরি। আমি সরল মনে তাকে যেতে দিলাম। প্রায় প্রতিদিনই দেখি সে ওয়াশরুমে যায়। দেরি করে আসে।
একদিন দেখি সে ওয়াশরুমের কথা বলে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। আমলে নিলাম তার মতিগতি। পরদিন যখন বলল, স্যার, ওয়াশরুমে যাব। আমি না করলাম। সে বলল, ক্লাশে করে দেব, স্যার। করে দাও। আমি বললাম।
একটু পর এক ছাত্র বলে উঠল, স্যার, আলামিন ক্লাশে প্রস্রাব করে দিয়েছে। আমি দেখলাম সত্যি সত্যি সে একটা বোতলে প্রস্রাব করে দিয়েছে।
বললাম, এটা কী করলে? সে বিব্রতভাবে বলল, স্যার, আমি কিন্তু বাইরে যেতে চেয়েছিলাম। আপনিই যেতে দেননি।
আমি বললাম, তোমার অবস্থা ওই মিথ্যাবাদী রাখালের মতো হয়েছে, যে প্রতিদিন বাঘ, বাঘ বলে চিল্লাত। লোকজন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত। তার মিথ্যা কথায় বিরক্ত হয়ে তারা যখন আসা বাদ দিল, একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এল। রাখালের চিৎকারে কেউ আর এগিয়ে এল না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:৫০