somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃহন্নলা-কথন এবং নিউটনের তৃতীয় সূত্রের একটি সামাজিক বাস্তবায়ন

২১ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মধ্যরাত। মুহুরিপাড়ার জোড়া-খাম্বার সামনের সুনশান রাস্তাটায় দু'টো মাত্র প্রাণী। একটি আপনমনে পায়চারি করছে এদিক-সেদিক;অন্যটি খাম্বায় আলতো হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে।উভয়ের মধ্যেই অসম্ভব মিল। দু'টোই ম্যামিলিয়ান ভার্টিব্রেট। তাই একটা সময় পর্যন্ত অকৃত্রিম মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তারপর সে বন্ধন ছিন্ন করে নিষ্ঠুর জীবন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে;একটিকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে;অপরটিকে সমাজের কৃত্রিম নিয়মে কিংবা ভাগ্যের প্রবঞ্চনায়। প্রথম প্রাণীটি খানিকটা লোম ওঠা সাদা-কালো একটি আহত কুকুর।দ্বিতীয়টি মানুষ;তবে পরিহাসের এ পরিচয় ছাপিয়ে ওর বড় পরিচয়-ও একজন বৃহন্নলা,আমাদের ভাষায় 'হিজড়া'। ওর অপলক দৃষ্টি রংচটা ছয়তলা বিল্ডিংটার তৃতীয় তলার দক্ষিণের বারান্দায়। চোখজুড়ে অভিমান,স্মৃতি আর জল। বছরের কেবল এদিনটাতেই ও অভিমানে পাথর হয়ে যাওয়া ওর পাথুরে চোখজোড়াকে সিক্ত হতে দেয় আর মনের গহীনতম প্রকোষ্ঠটায় বন্দি শৈশবের স্মৃতিগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখে।আজ যে ওর জন্মদিন-ওর মানুষবেলায় দিনটা সবাই ঘটা করে পালন করত।

প্রতিবছরই এরাতটাতে ও গুরুমাকে ফাঁকি দিয়ে ছুটে আসে শৈশবের স্মৃতিবিজরিত বাড়িটার সামনে। গুরুমা জানতে পারলে অবশ্য রক্ষে নেই! সেই বারো বছর বয়সে হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে যাওয়া ওর প্রিয় ছোট চাচ্চু ওকে ফেলে রেখে যায় শিবগঞ্জের হিজড়া-পল্লীটার গুরুমার কাছে। শুধু ছোট চাচ্চুই না,ওই ভয়ংকর সময়টাতে অচেনা হয়ে গিয়েছিল সবাই-কেবল ওর মা বাদে। মাকে ঘুমের ওষুধ গিলিয়ে তবেই তো ওকে গুরুমার কাছে নিয়ে যাওয়া গেছে। আচ্ছা,ওর মা-ও কি ওকে ভুলে গেছে? এদিনটায় ওর খুব ইচ্ছে হয় মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার।ওর একটা ইচ্ছা আছে-একদিন এমনি এক জন্মদিনে হঠাৎ করেই তিনতলার ঐ বাসাটায় উঠে বলবে-মা,একটু পায়েস রেধে খাওয়াবা?এ-ই শেষ,আর কোনদিন মুখ দেখাব না। দিবা?

কিন্তু সেদিন যদি আর সবার মত ওর মা-ও ওর দিকে ভয় আর ঘৃণাভরা চোখে তাকায়?মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়? এ ভয়েই ও যায় না। অন্তত মায়ের অচেনা হয়ে যাওয়াটা ওকে নিজ চোখে দেখতে হয়নি,দেখতেও চায় না।

এই 'ও'রা কিন্তু আমাদের সামনে মোটেও এমন অনুভূতিপ্রবণ নয়। ওদের আবেগ-অনুভূতি থাকতে নেই। ওরা নির্লজ্জ,বেহায়া,অসভ্য,অসামাজিক। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ঘৃণা আর লজ্জার বোঝা বইতে ওদের বয়েই গেছে! যে সমাজে ওদের স্থান নেই,সে সমাজের নিয়মনীতি ওরা কেন মানবে? সমাজের তীর্যক দৃষ্টি যে ওরা পরোয়া করে না,তা দেখিয়ে দিতে হবে না!

ভাবুন তো,মা সন্তানকে শাসন করলে সন্তানটা কি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে না-কখন মা এসে আদর করে ওর রাগ ভাঙাবে? তাহলে আচানক মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া হতভাগা ওই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানগুলোকে যখন হিজড়া-পল্লীতে ফেলে আসা হয়,ওরা কি কিছুকাল অভিমানে অপেক্ষা করে না,কখন মা-বাবা আদরের সোনামণিটাকে এসে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? ওদের ছাড়াও মা-বাবা থাকতে পারবে-এও কি ওদের বিশ্বাস করতে হবে!কিন্তু দিনের পর দিন কেটে যায়,ওরা বুঝতে পারে ওদের অপেক্ষা কোনদিনও ফুরাবে না। ওদের জীবন্ত অভিমানগুলোও তাই জীবাশ্ম হয়ে ধীরে ধীরে পাথর হয়ে যায়,সারা জীবনের জন্য।

জানি না সময় নষ্ট করে আদৌ লেখাটা কেঊ পড়ছেন কি না। যদি পড়ে থাকেন,তবে অনুরোধ করব আরেকটু সময় নষ্ট করে একটিবার ওদের পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করে দেখুন তো। আপনি কি পারতেন এত বড় একটা ধাক্কা সয়ে যেতে? আপনার মনোজগতে যে ঝড় বয়ে যেত,তারপর কি পারতেন নিজের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি আর সম্মানবোধ ধরে রাখতে? বড় মানসিক আঘাতে মানসিক ভারসাম্য হারানোর ঘটনা তো বিরল না। আচ্ছা,ওদের মনোজগতে যে তোলপাড় ঘটে যায়,তা কি মানসিক ভারসাম্য হারানোর জন্য যথেষ্ট না?তাহলে ওদের অসভ্য আচরণকে কেন আমরা একপ্রকার মানসিক ভারসাম্যহীনতা ভাবতে পারি না? এর দায় কি ওদের নাকি আমাদের সভ্য সমাজের?



এবার একটুখানি বিজ্ঞান আনা যাক। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে জন্মানোর পেছনে অনেকগুলো কারণ এবং ব্যাখ্যা রয়েছে। তন্মধ্যে সহজতম উদাহরণটা দেওয়া যাক।...মানবদেহে ২২ জোড়া অটোজোমের সাথে একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম থাকে।মায়ের থেকে একটি আসে-X;আর বাবার থেকে আসতে পারে X কিংবা Y এর যেকোনটি। বিধাতার পাশার চালে যদি XX উঠে থাকে তবে আপনি নারী,আর XY উঠে থাকলে আপনি পুরুষ।কিন্তু ধরুন বিধাতার খেয়ালে মিয়োসিস-১ এ গন্ডগোলের কারণে মা থেকে হ্যাপ্লয়েড X না এসে ডিপ্লয়েড XX চলে এল,আর বাবার থেকে Y। তাহলে XXY সেক্স ক্রোমোজোমবাহী সন্তানের দেহে XX এবং XY সহাবস্থান করে। কোন একজোড়ার আধিপত্যে শিশুকালে বুঝা না গেলেও বয়ঃসন্ধিকালে জটিলতাগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

আচ্ছা,প্রকৃতির নিয়মে যদি মানুষের চারটি আঙ্গুল থাকত,তবে দৈবক্রমে পাঁচ আঙ্গুল নিয়ে জন্মানো মানবসন্তানকেই তো আমরা 'অস্বাভাবিক' আখ্যা দিতাম,বাঁকা চোখে তাকাতাম। তার অর্থ দাঁড়ায় আমাদের কাছে স্বাভাবিক এবং ত্রুটিপূর্ণের মানদন্ড সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে সামঞ্জস্য।তাহলে নারী-পুরুষের ১:১ অনুপাতের মত যদি নারী-পুরুষ-বৃহন্নলার জনমিতিক অনুপাতও ১:১:১ হত,তবে কি পারতেন এতটা অবহেলে এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীকে সমাজে অবাঞ্চিত আখ্যা দিয়ে দিতে?শারীরতাত্ত্বিক তফাৎ তো নারী-পুরুষের মাঝেও রয়েছে। আমরা কেন তবে ওদের শারীরতত্ত্বকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারি না-বিধাতার সৃষ্টির ক্রুটি ধরার স্পর্ধা আমরা কি করে দেখাই?



"প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে।"-নিউটনের তৃতীয় সূত্রটি কেবল বলবিদ্যায় নয়,মানবজীবনের এবং মানবসমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরম সত্য এবং বাস্তব। বৃহন্নলাদের ক্ষেত্রেও তাই।ক্রিয়াটা আসে সমাজ থেকেই। উন্নত দেশগুলোতে তো ওদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মত না। ওসব দেশের বৃহন্নলারা কি আমাদের দেশের বৃহন্নলাদের মত উৎপাত করে? বরং সমাজ কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ওরা যোগ্যতা অনু্যায়ী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছে। শুনেছি ইন্দোনেশিয়ায় নাকি ওদের মসজিদে সবার সাথে নামাজ পড়তেও দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে কেন এ হাল? কারণ আমাদের সমাজে বৃহন্নলার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই পরিবারের এক চিন্তা-মানসম্মান বাঁচাতে চাও তো ওটাকে ফেলে দিয়ে এসো। সমাজে ওর কোন স্থান নেই। আর এ অপক্রিয়াটিকে যুগের পর যুগ আমাদের সমাজব্যবস্থা লালন করে এসেছে-আর প্রতিটি ক্রিয়ার তো সমান প্রতিক্রিয়া থাকবেই,তাও আবার বিপরীতমুখী। তবে জেনে রাখুন,যদি কখনো বৃহন্নলাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন,তবে তা আপনার,আপনার পূর্বপুরুষে,আপনার সমাজব্যবস্থার অপক্রিয়ারই উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া!!

আমাদের অবশ্য যুক্তি প্রস্তুত থাকে,আজকাল তো অনেক 'হিজড়া'ই নকল।হ্যাঁ,তা সত্য।কিন্তু ওরা তো কেবল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এরকমটা করতে পারছে। তাতে তো আর আমাদের সমাজের 'ক্রিয়া'দোষ মিত্থ্যে হয়ে যাচ্ছে না। পরিস্থিতিটা তো আমরাই তৈরী করে দিয়েছি। কাজেই শাক দিয়ে মাছ ঢেকে লাভ কি?

বাস্তবতা হচ্ছে,সরকার এবং এনজিওগুলো যত যা-ই উদ্যোগ নিক না কেন,বৃহন্নলাদের জীবনমান এবং সমাজে ওদের উৎপাতের চিত্র খুব একটা বদলাবে না। ওদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে এ অসাধ্য সাধন করতে;যদিও রাতারাতি না সমাজ বদল সম্ভব,না তার ফল পাওয়া সম্ভব। যদি আমরা বৃহন্নলাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের বার্তা একটু একটু করে ওদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি,তবে তার প্রতিক্রিয়া কি ওদের থেকে পাওয়া যাবে না? অভিমানী মানবসন্তানগুলোর সমাজের প্রতি অভিমানের বরফ কি এতটুকুও গলবে না?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৫
২৫টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×