somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দি গ্রেট আর্ক-মিথ অব নোয়া/নূহ(আ) কিংবা মৎস্য অবতার গাথা:দুরুপিনার বুকে রহস্য

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফ্লাড মিথ বা মহাপ্লাবন গাঁথা -ঘোর অবিশ্বাসীর মনেও কৌতূহল এবং অনুসন্ধিৎসা জাগানিয়া এক পৌরাণিক কাহিনী কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা। সত্যতার পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের মিশেলে নিরপেক্ষ অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে আজও যা রহস্যের চাদরে মুড়োনো। আর বিশ্বাসীদের কাছে এ হলো ঈশ্বরপ্রদত্ত এক ঐতিহাসিক শিক্ষা। ঐশী নির্দেশকে অমান্য করে পাপ এবং দূরাচারে নিমজ্জিত মনুষ্যজাতির অধঃপতনে ক্রুদ্ধ সৃষ্টিকর্তা মনস্থির করলেন পাপীদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীকে নবরূপে গড়ে তোলার। তাই তিনি আয়োজন করলেন প্রলয়ংকরী এক ধ্বংসযজ্ঞের, এক মহাপ্লাবনের। যার প্রকোপে দুনিয়া থেকে বিলীন হয়ে গেল তাঁর অকৃতজ্ঞ পাপী সৃষ্টিকূল,নিষ্কলুষ হলো পৃথিবী-বাঁচিয়ে রাখলেন কেবল তাঁর প্রিয় বান্দা নোয়া/নূহ(আ)/মনু ও তাঁর অনুসারীদের এবং প্রাণিজগতের কিছু সৌভাগ্যবান প্রতিনিধিকে;তাঁদের এবং এদের মাধ্যমেই নবরূপে প্রাণপ্রাচুর্যের সঞ্চার ঘটালেন ধরাপৃষ্ঠে।---মোটা দাগে এই হলো বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং পুরাণে বর্ণিত মহাপ্লাবন বা ফ্লাড মিথের সারসংক্ষেপ।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ধর্মগ্রন্থ এবং পুরাণসমূহে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ঐতিহাসিক মহাপ্লাবন বা ফ্লাড মিথকে।

ইহুদি এবং খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত মহাপ্লাবন:
সেমেটিক ধর্মসমূহে মহাপ্লাবনের বর্ণনায় খুব একটা তফাৎ নেই বললেই চলে।ঈশ্বরের প্রেরিত দূতের সতর্কবাণী অমান্য করায় রুষ্ট হলেন ঈশ্বর-
“আমার সৃষ্ট মানুষকে আমি দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেলব; আর তার সঙ্গে সমস্ত জীবজন্তু, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও আকাশের পাখীও মুছে ফেলব। এই সব সৃষ্টি করেছি বলে আমার মনে কষ্ট হচ্ছে।"(জেনেসিস-৬:৫-৮)

তাই তিনি নোয়াকে নির্দেশ দিলেন বিপুলায়তন এক জাহাজ নির্মানের-
"তুমি গোফর কাঠ দিয়ে তোমার নিজরে জন্য একটা জাহাজ তৈরি কর। তার মধ্যে কতগুলো কামরা থাকবে; আর সেই জাহাজের বাইরে এবং ভিতরে আল্কাত্রা দিয়ে লেপে দিবে। জাহাজটা তুমি এইভাবে তৈরি করবে; সেটা লম্বায় হবে তিনশো হাত, চওড়ায় পঞ্চাশ হাত, আর উচ্চতা হবে ত্রিশ হাত। জাহাজটার ছাদ থেকে নীচে এক হাত পর্যন্ত চারদিকে একটা খোলা জায়গা রাখবে আর দরজাটা হবে জাহাজের একপাশে। জাহাজটাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থাকবে। আর দেখ, আমি দুনিয়াতে এমন একটা বন্যার সৃষ্টি করব যাতে আসমানের নীচে যে সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে তারা সব ধ্বংস হয়ে যায়। দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীই তাতে মারা যাবে।"(জেনেসিস-৬:১৩-১৭)

“তুমি ও তোমার পরিবারের সবাই জাহাজে উঠবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, এখনকার লোকদের মধ্যে কেবল তুমিই সৎ আছ। তুমি পাকপশুর প্রত্যেক জাতের মধ্য থেকে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সঙ্গে নেবে, আর নাপাকপশুর মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে এক জোড়া করে নেবে। আকাশে উড়ে বেড়ায় এমন পাকপাখীদের মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সঙ্গে নেবে।"(জেনেসিস-৭:১-৫)
অতঃপর চল্লিশ দিন চল্লিশ রাতের প্রলয়ংকরী ভারি বর্ষণ এবং প্লাবনে বাকি সকল জীব পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।



আল কুরআনে বর্ণিত মহাপ্লাবণ:
আল কুরআনের সাথে ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনার একটি মৌলিক পার্থক্য কুরআনে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই প্লাবন সংঘটনের কথা স্পষ্টত বলা হয় নি , বরং কেবল নূহ(আ)এর কওমের উপর আজাবের কথা বলা হয়েছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাছাড়া জেনেসিসের জাহাজের আকার-আকৃতির বিবরণও নেই। হাদিসে চল্লিশ জোড়া বিশ্বাসী নারী-পুরুষ এবং প্রতিটি প্রাণি প্রজাতির একজোড়া করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
"তুমি আমারই তত্ত্বাবধানে আমারই ওহির আদেশে একটি নৌকা বানাও এবং যারা জুলুম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে (কোনো আবেদন নিয়ে) হাজির হয়ো না, নিশ্চয়ই তারা নিমজ্জিত হবে।"(সুরা হুদ, ১১:৩৭)
নূহ(আ) এর নামে আল কুরআনে একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও সূরা আ'রাফ,সূরা মুমিনুন,সূরা হুদ সহ বেশ কয়েকটি সূরায় এর বিবরণ পাওয়া যায়। ১২০ দিন ধরে বর্ষণ চলে এবং জাহাজটি জুদি পর্বতের কাছে নোঙর ফেলে।
বাদবাকি বিবরণ অন্যান্য সেমেটিক ধর্মের অনুরূপই।


সনাতন ধর্মের মৎস্যপুরাণেে বর্ণিত মহাপ্লাবণ:


সনাতন ধর্মের অবতারবাদ অনুসারে মৎস্য অবতার বিষ্ণুর প্রথম অবতার। বিষ্ণুভক্ত দ্রাবিড়রাজ রাজা সত্যব্রত (মনু) একদা নদীর জলে হাত ধোয়ার সময় ক্ষুদ্রকায় একটি মাছ তাঁর হাতে চলে আসে এবং তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। রাজা সত্যব্রত মাছটিকে একটি পাত্রে ছেড়ে দেন। তিনি লক্ষ্য করেন মাছটি বিস্ময়করভাবে ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। তিনি সেটিকে প্রথমে একটি পুকুরে স্থানান্তর করেন,পরে নদীতে এবং শেষে সমুদ্রে ছেড়ে দেন। কিন্তু মাছটি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে সকল আধারই পূর্ণ হয়ে যায়। অবশেষে মাছটি বিষ্ণুর রূপে আত্মপ্রকাশ করে সত্যব্রতকে জানান যে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রলয় সংঘটিত হবে এবং সমগ্র জীবকূলের বিনাশ ঘটবে। তাই সত্যব্রতকে নির্দেশ দেন সকল প্রকার ঔষধি, সকল প্রকার বীজ, সপ্তর্ষি,বাসুকি নাগ ও অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হতে এবং তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থী হতে। প্রলয় শুরু হলে মৎস্যরূপী বিষ্ণু পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে পুনরায় আবির্ভূত হন। তিনি সত্যব্রতকে একটি নৌকায় আরোহণ করতে বলেন এবং তাঁর শিঙে বাসুকি নাগকে নৌকার কাছি হিসেবে বাঁধতে বলেন।[ si](মৎস্যপুরাণ)
মৎস্যপুরাণের বিভিন্ন সংস্করণে বর্ণনার কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। তবে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পরিত্রাণই মহাপ্রলয়ের উদ্দেশ্য ছিল-তা সুনিশ্চিত।

বিভিন্ন আঞ্চলিক পুরাণে মহাপ্লাবনের উল্লেখ:

বিশ্বজুড়ে নানান অঞ্চলের আঞ্চলিক পুরাণে কেবল চরিত্রগুলোর নাম পরিবর্তন করে ফ্লাড মিথকে প্রায় একই আঙ্গিকে
বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সুমেরীয় গাঁথায় ঈশ্বর দেবতা এনলিল আর নূহ(আ)/নোয়ার স্থানে রাজা জিউসুদ্র; রোমান পুরাণে দেবতা জুপিটার;গ্রিক পুরাণে দেবতা জিউস;চৈনিক পুরাণে স্বর্গপিতা সিজুসিহ। পূর্ব আফ্রিকার মাসাই পুরাণে টামবাইনোতের কাহিনীকেও মহাপ্লাবনের অনুরূপ মনে করা হয়।

যদি সত্যিই ঘটে থাকে এ মহাপ্লাবন তবে কোথায় আছে ঐ আর্ক/জাহাজ?

সেমেটিক ধর্মগুলোর বিবরণ অনুযায়ী ঘটনাটি মধ্যপ্রাচ্যে ঘটেছিল। বাইবেলে সরাসরি আরারাত পর্বতের কাছে আর্কের অবস্থান নেওয়ার উল্লেখ রয়েছে,যা বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত। অধিকাংশ মুসলিম ঐতিহাসিকের মতেও টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীবেষ্টিত দোয়াব অঞ্চলেই নূহ(আ) এর কওমের বাস ছিল। প্রাচীনকালে এ নদীদ্বয়ে ঘনঘন বন্যার তান্ডবের প্রমাণও বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত। সবমিলিয়ে এটি ঈশ্বরপ্রদত্ত শাস্তি(বিশ্বাসীদের মতানুসারে)হোক,কিংবা আঞ্চলিক কোন বন্যার অতিকথিত রূপ(অবিশ্বাসীদের মতানুসারে)-প্লাবনটি টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর কাছাকাছি মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও হয়েছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়।

দুরুপিনার পাহাড়ের বুকে.........কী ওটা...........?



১৯১৬ সালে রুশ লেফটেন্যান্ট রস্কভিতস্কি তুরস্কের আরারাত পর্বতের আকাশ থেকে উপর আর্কের সদৃশ কিছু দেখতে পাওয়ার দাবি করেন। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে এ নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করা হয় নি তখন। তাই ঐ স্থানটিকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত অবধি করা যায় নি। তবে স্থানটি অনুসন্ধানে অভিযান থেমে ছিল না। অবশেষে ১৯৫৯ সালে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ের ওপরে হুবহু জাহাজ আকৃতির একটি জায়গার সন্ধান পান বিখ্যাত মানচিত্রকর ক্যাপ্টেন ইলহান দুরুপিনা । চার্চ থেকে শুরু করে অন্যান্য সেমেটিক ধর্মসমূহের বিশ্বাসীদের তরফ থেকেও জোর দাবি উঠলো-এর নিচেই নিহিত আছে নোয়ার আর্ক বা নূহ নবীর সেই নৌকার ধ্বংসাবশেষ। কেননা এতো আরারাত পর্বতেরই সন্নিকটে;বাইবেলের বর্ণনা এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের অনুমানের সাথেও যা মিলে যায়। দুরুপিনা ওই অঞ্চল আবিষ্কার করায় জায়গাটির নাম রাখা হয় দুরুপিনার পাহাড়।

তবে দুরুপিনারের ওই নৌকা আকৃতির জায়গাটির নোয়ার আর্কের ধ্বংসাবশেষ হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন ভূতত্ত্ববিদদের একটি বড় অংশ। তাদের দাবি,জায়গাটি পাহাড়ের অস্বাভাবিক এক ধরনের ভাঁজ বৈ আর কিছু না। কিন্তু বিশ্বাসীরা তাদের দাবিতে অনড়-বেছে বেছে কেন আরারাতেই থাকবে এহেন ভাঁজ? হয়তোবা এ ভাঁজের নিচেই লুকিয়ে আছে সে ঐতিহাসিক জাহাজ।



দুরুপিনা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা করে আসছেন গবেষক এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সেম সেরতেসেন ও তাঁর দল। ২০১৭ সালে এ নিয়ে তাঁর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দুরুপিনার নিচে জাহাজ পাওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে তিনি যুক্তি- প্রমাণ এবং ভূ-গর্ভের ত্রিমাত্রিক চিত্র উপস্থাপন করেন। তবে দুরুপিনার নৌকোটিই যে নোয়ার আর্ক-তার নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেন নি। তবে শীঘ্রই এ নিয়ে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণাদি নিয়ে হাজির হবার ঘোষণা দিয়েছেন এ গবেষক।



ডাচ শিল্পী জোহান হুইবার ২০১২ সালে জেনেসিসের বিবরণ মোতাবেক একটি আর্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেন ১৬ লাখ ডলার খরচে নির্মিত বিশাল নৌকা বা আর্কটি বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে রাখা হয়েছে।

আজকের কৃষ্ণসাগরের তলদেশে প্রাচীন বসতি ছিল?

নোয়ার আর্কের খোঁজ কেবল দুরুপিনাতেই থেমে নেই। ২০০০ সালে দুই মার্কিন সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম রায়ান এবং ওয়াল্টার পিটম্যান দাবি করেন,বর্তমান কৃষ্ণসাগর ২০ হাজার বছর আগে একটি ছোট্ট লেক ছিল। এর তীর ঘেঁষে জনবসতি থাকারও প্রমাণ পাওয়া যায়। শেষ আইস এজের সময় হিমবাহ গলে পানির উচ্চতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এটি অতিকায় কৃষ্ণসাগরে পরিণত হয়। ২০১৬ সালে বুলগেরিয়ার নেসেবার উপকূলে কৃষ্ণসাগরের এক হাজার থেকে ছয় হাজার ফুট গভীরে একটি প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে নোয়ার আর্ক সন্ধ্যানীদের কৌতূহলের কমতি নেই। কৃষ্ণসাগরের তলদেশে অক্সিজেনের মারাত্মক অভাবে প্রাচীন কাঠের জাহাজটি পঁচন ধরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি।

গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলম্যানের যুক্তিতে মহাপ্লাবনের বিবরণের অসংগতি:

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে শুরু করে চার্লস ডারউইন-অনেকেই ফ্লাড মিথের বর্ণনার অসংগতি প্রমাণে যুক্তি দিয়েছেন।
রুশ গণিতবিদ ইয়াকভ পেরেলম্যানের ব্যাখ্যাটা বোধহয় সবচেয়ে সহজবোধ্য। তাঁর 'মহাপ্লাবন অধ্যায়' অনুবাদিত সংস্করণেই যুক্তিগুলো পেয়েছি। দয়া করে ভুল বুঝবেন না। সাধারণ পাটিগণিতের সাহায্যে তাঁর উপস্থাপিত যুক্তিগুলো জেনে নেওয়া যাক:

১)জেনেসিসের বিবরণ অনুযায়ী কল্পিত ৩০০ হাত লম্বা ও ৫০ হাত চওড়া তিনতলা জাহাজটির বাসযোগ্য স্থান ছিল
(৩০০×.৪৫)×(৫০×.৪৫)×৩ বর্গমিটার=৯১২০ বর্গমিটার
অথচ কেবল স্তন্যপায়ী প্রাণিই রয়েছে অন্তত ৩৫০০ ধরণের। নোয়ার অনুসারী,অন্যান্য প্রজাতি এবং প্রয়োজনীয় খাদ্যকে স্থান দেবার জন্য এ স্থান পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া মাথায় রাখতে হবে জাহাজটিকে ২০০০০ টন পানি স্থানচ্যুত করতে হত।

২)প্রতি বর্গমিটার বায়ুস্তরে সর্বোচ্চ ২০ কেজি বাষ্প থাকতে পারে। যদি তার সবটুকুও পুরো পৃথিবীতে ঝরে পড়ে,তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হবে ২.৫ সেমি (পৃথিবী জুড়ে পানির গড় গভীরতা)। কাজেই এটি বড়জোড় একটি স্থানীয় মহাপ্লাবন হতে পারে,পুরো পৃথিবী জুড়ে হওয়া সম্ভব নয়।

তবে কি মহাপ্লাবন অকাট্যভাবে ডাহা মিথ্যে প্রমাণিত হয়???

না,বিষয়টি এতটাও সহজ নয়। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির আহবানে কয়েকটা যুক্তি কিংবা প্রশ্ন মাথায় আসে। এগুলো আজগুবি,হাস্যকর কিংবা ডাহা ভুল শোনালে ক্ষমা করে দিবেন।

১)নোয়া/নূহ(আ) তো নিশ্চয়ই ক্যারোলাস লিনিয়াসের সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রজাতি ধরে আনেন নি। মানে গ্রিজলি ভাল্লুক,মেরু ভাল্লুক,কালো ভাল্লুক আলাদা আলাদা প্রজাতি হলেও তিনি নিশ্চয়ই এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন ভৌগলিক পরিমন্ডলে একই প্রাণির আলাদা আলাদা প্রজাতিগুলোকে সংগ্রহ করতে পৃথিবী চষে বেড়ান নি। তাছাড়া,সে সময় প্রাণিজগতে প্রজাতি সংখ্যাও কি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব?

২)ইয়াকভ পেরেলম্যান এক হাত বলতে ০.৪৫ মিটারকে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এটা কি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব? সে সময়কার একহাতের মাপ ভিন্নও ধরা হয়ে থাকতে পারে। কাজেই,কল্পিত আয়তনের সাথে আর্কের প্রকৃত আয়তনের হেরফের থাকতেই পারে। বিশেষত এটা যদি আমলে নেওয়া হয় যে ঘনকাকার বস্তুর একমাত্রিক বাহুর দৈর্ঘ্য ২ গুণ করলে এর ত্রিমাত্রিক আয়তন ৮ গুণে বেড়ে দাঁড়াবে। আর তাছাড়া আল কুরআন এবং মৎস্যপুরাণে কিন্তু জাহাজের মাপ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় নি।

৩)বায়ুমন্ডলের বর্তমান অবস্থার সাথে সে সময়কার অবস্থানের তুলনা করা কতটা যৌক্তিক? আবার বৃষ্টির সাথে হিমবাহের বরফ গলেও যে এ প্লাবনে অংশ নেয় নি-তার নিশ্চয়তা কি? আইস এজে বরফ গলে সাগর তৈরির উদাহরণই বিবেচনা করুন। আচ্ছা,ঠিক আছে,তবু তা পুরো পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিতে হয়তো যথেষ্ট হত না,এটি না হয় আঞ্চলিক একটা প্লাবন। কিন্তু অন্তত আল কুরআনে আঞ্চলিক প্লাবনের তত্ত্বকে সমর্থন করা হয়েছে। তাছাড়া অনেক চার্চ বর্তমানে বৈশ্বিক প্লাবনের ধারণা থেকে সরে এসে একে রূপক আখ্যা দিয়েছে।

৪)বিষয়টি যেহেতু ঐশ্বরিক,কাজেই আপাত স্বাভাবিক যুক্তি মেনে চলতে এর বয়েই গেছে।

প্রধান ধর্মসমূহে মহাপ্লাবনের বিবরণ কি তবে সকল ধর্মের অভিন্ন ভিত্তিকে প্রমাণ করে?

সেমেটিক ধর্মসমূহের অভিন্ন ভিত্তির কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু হিন্দুধর্ম,চীনের উপকথা,গ্রিক পুরাণ,রোমান পুরাণ,গিলগামেশের কাব্য,আফ্রিকার মাসাই উপকথা-পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্ম এবং লোকগাথায় ফ্লাড মিথ স্থান পাওয়ার বিষয়টি সত্যিই চমকপ্রদ। যদি এটি বৈশ্বিক প্লাবন না হয়ে থাকে,তবে অবশ্যই মানতে হবে যে সবগুলো বিবরণের আদি উৎস একই। তাই যদি হয় তবে মহাপ্লাবনকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথকভাবে একেকটি ভিন্ন ধারার(যেমন সেমেটিক এবং প্রকৃতি পূজারি)ধর্মের উৎপত্তির পরিবর্তে একই উৎস থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরূপে ধর্মের বিস্তারের পক্ষে একটি যুক্তি (হোক না দুর্বল) বলে কি ধরে নেওয়া যায় না?


পরিশেষে কিছু কথা.......................

আমি আমার ক্ষুদ্র জীবন অভিজ্ঞতায় লব্ধ একটি অনুধাবনকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি,স্থান-কালের অসীমতট চাদরের দুটি অনন্য এবং সুনির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক বিন্দুতে অবস্থান নেওয়া যেকোন দুজন মানুষের জীবন এবং জগত নিয়ে পর্যবেক্ষণ অভিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। তাই সমগ্র মানবজাতির পক্ষে যুগপৎ ধ্রুব সত্য বলে কিছুকে স্থির করাটা অসম্ভব। কেউ হয়তোবা মানসিক প্রশান্তি পায় অদৃশ্যের প্রতি আনুগত্য এবং আত্মসমর্পণে; কেউ বা প্রমাণ বিনে কোন কিছুকে সত্যজ্ঞান না করার দম্ভে। ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার;মানুষের স্বাভাবিক যুক্তিগ্রাহ্যতা এবং জ্ঞানের অতীত অদৃশ্য সত্তাকে বিশ্বাসের নামই তো ঈশ্বরে বিশ্বাস। তাহলে ধর্মকে বিজ্ঞানের ছাঁচে ফেলে এর সত্যতা যাচাইয়ের কিংবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবার প্রয়াস চালানো কতটুকু যৌক্তিক? চলুক না ধর্ম এবং বিজ্ঞান আপন ছন্দে! দুরুপিনার বুক চিরে যে রহস্যই উন্মোচিত হোক,কিংবা ডারউইন-ভিঞ্চি-পেরেলম্যানরা যে যুক্তি নিয়েই হাজির হোক,তাতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই দলে দলে নিজেদের লালিত বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করবে না। কিছু বিষয় না হয় অমীমাংসিত বা রহস্যই থেকে যাক। তবু যে যার বিশ্বাসে অটল থাকবে; অন্যের মত,দর্শন ও বিশ্বাসের প্রতিও সহিষ্ণু এবং শ্রদ্ধাশীল হবে-এটাই তো পরমতসহিষ্ণুতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সৌন্দর্য-তাই নয় কি?

...........................................................................................................................................................................
তথ্যঋণ:
উইকিপিডিয়া(বাংলা সংস্করণে যদিও সরাসরি 'প্রমাণ পাওয়া যায় নি' লেখা);
মহাপ্লাবন অধ্যায়(অনুবাদিত)-ইয়াকভ পেরেলম্যান;
মহাপ্লাবনের বাস্তবতা:পৌরাণিক অতিকথন বনাম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধ্যান:অনন্ত বিজয় দাস।

(আমার সবশেষ পোস্টটিতে গঠনমূলক সমালোচনা এবং মূল্যবান দিকনির্দেশনা দেবার কৃতজ্ঞতায় এই লেখাটি শ্রদ্ধেয় নীল আকাশ ভাইয়াকে ভয়ে ভয়ে উৎসর্গ করছি। ভয়ে ভয়ে-কেননা বিষয় নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে আমি নিজেই শঙ্কিত,সেই সাথে কাঁচা হাতের অসংখ্য ভুলভ্রান্তি তো রয়েছেই।আশা করি,উনি এজন্য অসম্মানিত বোধ করবেন না এবং ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৬
৩০টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×