আপন শহরে ফেরা ( কাল্পনিক )
অনেকদিন পর ফরিদপুর ফিরছি । চাকরির ব্যস্ততায় কোথাও যাওয়ার সময় পাওয়া যায় না । ফরিদপুর ছাড়ার পর একটা সময় ছিল যখন ফরিদপুরের রাস্তা-ঘাট , মানুষজন ও বন্ধুদের অনেক মনে পড়ত । সময়ের সাথে সাথে আর ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে সেই অনুভূতিগুলোও মরে গেছে । তবে আজ বাসে বসে ধূসর স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে । সেই স্কুল জীবন আর কলেজ জীবন । সারাদিন শহর দাপিয়ে বেড়ানো সেই সময় । স্কুল পালিয়ে সাইকেলে নিয়ে বন্ধুরা সব ঘুরে বেড়াতাম আর কোচিং শেষে বাসায় ফিরতাম সন্ধায় । সারাদিন কাটতো হুড়োহুড়িতে । আর কলেজ জীবনে তো কখনো ক্লাস ই করা হয়নি । ক্লাস বাদ দিয়ে লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দিতাম । খেলাধূলা , মুভি , গান , প্রেম-ভালবাসা , সবই থাকতো আড্ডার টপিকে । কেও কেও তো কেন তার মোবাইল সেরা তা প্রমাণে যুদ্ধে নেমে যেত । আর বিকেলে সবাই মিলে স্কুলমাঠে বাস্কেটবল খেলতাম । কতইনা ভাল ছিল সেই দিনগুলো ! আজ শত চেষ্টা করেও সেই দিনগুলো ফেরাতে পারবো না । স্মৃতির এপিটাফ আজ ভারী হয়ে উঠছে ।
আমি একটি প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ অনার্স কমপ্লিট করে এখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছি । এরকম অগোছালো বাল্যকাল আর শৈশব যার তার রেজাল্ট নিশ্চয় ভাল হওয়ার কথা না । এস.এস.সি. তে ঠিকই ছিল কিন্তু এইচ.এস.সি. তে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট বাঁশটা খেয়ে গেলাম । তারপর শুরু হল জীবনকে সোজা লাইনে আনার যুদ্ধ । এতো আঁকাবাঁকা লাইনকি এতো সহজে সোজা করা যায়! তাই শত চেষ্টা করেও জীবনের লাইন এখনো আঁকাবাঁকাই আছে । তবে আগের মত ছন্নছাড়া ভাবটা আর নেই । চোখের চশমাটা চেহারায় একটা গাম্ভীর্য এনেছে ।
লিখতে লিখতেই বাস ঘাটে এসে পৌঁছল । ছয় বছর আগে পদ্মা সেতু হওয়ার কথা ছিল । সেই একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনীতিবিদরা এখনো নির্বাচন করে যাচ্ছেন কিন্তু কাজের কোন নমুনা নেই । রাজনীতিবিদরা হল এদেশের প্রকৃত ব্যবসায়ী । বাজারের ব্যবসায়ীরা তাও লোকসানের শিকার হয় কিন্তু এরা সর্বক্ষেত্রেই লাভবান । পদ্মা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে । আগে নদী পাড় হতে এক ঘন্টা লাগতো আর এখন আধাঘন্টাই দৌলতদিয়া ঘাটে পৌছে গেলাম । আর আধা ঘন্টা পরেই আমি পা রাখবো সেই চীরচেনা শহরে যেখানে আমার জন্ম আর বেড়ে উঠা । ব্যপারটা চিন্তা করেই মনটা ভাল হয়ে গেল ।
সেই কতক্ষণ ধরে নিজের কথাই বলে চলেছি । আমার পাশে আরেকজন বসে আছে আর চুপচাপ আমার লেখা পড়ে যাচ্ছে । আমার স্ত্রী রিদিতা । ভার্সিটি লাইফে পরিচয় , বন্ধুত্ব , পরবর্তীতে প্রণয় আর শেষমেশ বিয়ে । এবারের ইদের ছুটিতে ফরিদপুর আসাটা মূলত রিদিতার কারণেই । আমার কাছ থেকে ফরিদপুরের এতো গল্প শুনেছে যে বিয়ের আগেও কয়েকবার আসতে চেয়েছিল । কিন্তু তখন সময়-সুযোগ না হওয়ায় নিয়ে যেতে পারি নি । এবার ইদে বেশ কয়েকদিন ছুটি পেলাম , তাই ভাবলাম ফরিদপুর ঘুরিয়ে নিয়ে আসি । সব ইচ্ছে তো পূরণ করতে পারি না , অন্তত এই ইচ্ছেটা পূরণ করা যাক ।
আব্বু-আম্মু আগেই চলে এসেছে । বাসস্ট্যান্ডে নেমেই আগে চোখবন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিলাম । সেই চীরচেনা নির্মলতা ! একটা রিকশা নিলাম । আব্বু অবশ্য গাড়ি পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু রিকশায় ঘুরার মজা গাড়িতে কিভাবে পাবো ! আর পথও তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় । যাওয়ার পথে রিদিতাকে চেনা জায়গাগুলো চেনাচ্ছিলাম আর ও অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল । সব সময় নীরব মানুষটাকে এমন প্রাণচঞ্চল দেখে ও মনে হয় অবাক হচ্ছিল । আর আমি মজা পাচ্ছিলাম ওর এই অবাক দৃষ্টি দেখে । মেয়েটির চোখদুটি অসম্ভব সুন্দর!
বাসায় ফিরেই এক এক করে ফোন দেয়া শুরু করলাম সব বন্ধুদেরকে । ইদের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে অনেকেই । একটাও গালি দেয়া ছাড়া কথা বলে না ! তবে অনেকদিন পর সেই গালি শুনেও ভালই লাগে । সবাই মিলে ঠিক করলাম বিকেলে স্কুলমাঠে দেখা করব । ওদিকে রিদিতা এসেই আম্মুর সাথে রান্নাবান্নায় নেমে পড়েছে । আমি হালকা রেস্ট নিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম চেনা শহরটাকে নতুন করে চিনতে । শহরটা আর আগের মত নীরব নেই , রাস্তায় যানবাহন আর মানুষের ভীড় । অনেক নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে । রাস্তাগুলো আরো চওড়া হয়েছে , খেলার মাঠগুলোর জায়গায় এখন বহুতল ভবন । রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছগুলো এখন আর নেই ।
একটু ঘুরাফিরা করে স্কুলে ঢুকলাম । দেখলাম সব আগেই হাজির , আমিই সর্বশেষ । সবার মুখেই হাসি । কতদিন পর সবাই একসাথে সবাইকে পেলাম । সবার খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করলাম । কয়েকজন ডাক্তার , বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ার , কেও কেও ব্যবসা করছে । দুই-তিনজন তো দু-তিন সন্তানের বাপ হয়ে গেছে! ভাবতেই অবাক লাগে এইতো সেদিন এদের সাথে স্কুল-কলেজ চষে বেড়িয়েছি আর এখন যার যার জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত । সত্যি সময় থেমে থাকে না ।
ইফতারের সময় হয়ে গেল । সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম । বিল দেয়ার সময় লাগলো ঝামেলা , সবাই বিল দিতে চায় । পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ল । তখন কার উপর বিল দেয়ার দায়িত্ব ফেলা যায় সেইটাই খাওয়ার সময় ছিল চিন্তার মূল বিষয় । আমি কারো না কারো ঘাড়ে আমার বিল এর ভার ছেড়ে দিয়ে দোকান থেকে আগে বের হয়ে যেতাম । তাই আমিই শেষ পর্যন্ত দিলাম বিলটা । রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম ।
বাসায় ফিরতেই বেগম সাহেবা সামনে হাজির । এখন তাকে খাওয়ার পর আজকের সকল ঘটনা শোনাতে হবে নাহলে আমার শান্তি নাই । এটা আমার প্রতিদিনের অত্যাবশকীয় কাজ । এ পাগলীটা আমাকে যে কেন এতো ভালবাসে তা বুঝি না আমি । আমার মত ছন্নছাড়া আর বিরক্তিকর মানুষকে সহ্য করা ই তো কঠিন আমার মতে । মাঝে মাঝে নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে নিজ গালে চড় দিতে ইচ্ছা করে । এই পাগলীর কারণে অফিস থেকে ফিরে সারাদিনের সব কিছু না বললে আমারও ঘুম আসে না রাতে । দুজনের ছোট্ট সংসার আর আব্বু-আম্মু , ভালই কেটে যায় দিন-কাল ।
ইদের ছুটিগুলো ভালই কাটলো বন্ধু আর পরিবারের সাথে । কিন্তু আবার ফিরে যেতে হবে সেই যান্ত্রিক শহরে । আবার ধুলো পড়বে স্মৃতির পাতায় । হয়ত কোন অবসরে পাতা উল্টাবো আর মনে পড়বে মূহুর্তগুলো ।
(লেখাটি আবেগ আর কল্পনা নিয়ে লেখা । বাস্তব জীবনের সাথে মিল থাকতে পারে । ভবিষ্যৎ কেমন হবে কেও বলতে পারে না , কল্পনা করতে পারে মাত্র ।)