মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
বিজয়ের একচল্লিশ বছরে পৌঁছে আমি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে রাজি নই। রাজি নই নৈরাশ্যবাদীদের কাতারে শামিল হতে। বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। বিশ্ব বিস্মিত হয় এ দেশের মানুষের এগিয়ে যাওয়া দেখে। আমি এ দেশের মানুষের ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল। আমাদের স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের। যে ভূখণ্ডে আমরা আমাদের আইন দ্বারা শাসিত হব। বাক, ব্যক্তি ও কর্মের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেরা নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্তারূপে মাথা উঁচু করে বাঁচব। একচল্লিশ বছর আগে অপরিমেয় আÍত্যাগ, অকুতোভয় সাহসের সঙ্গে হানাদার পাকসেনাদের পরাজিত করে আমরা বিজয়ী হয়েছি। অর্জন করেছি হাজার বছরের আরাধ্য স্বাধীন-সার্বভৌম এ বাংলাদেশ। আমাদের প্রত্যাশাকে আমরা পরিপূর্ণরূপে পেয়েছি। গত একচল্লিশ বছর অনেক দুর্যোগ-দুঃসময় চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা চেয়েছি পশুশক্তিমুক্ত স্বাধীন দেশ। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একথা কল্পনা করলেও লজ্জা পাই যে, ২৩ বছর আমরা ওদের সঙ্গে কিভাবে ছিলাম! আমরা পশুশক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়েছি।
আমি ভীষণভাবে আশাবাদী। আমাদের সবকিছু আছে। আজ ২০১২ সালে ঘুষ, দুর্নীতি, শাসক সমাজের ত্র“টি-বিচ্যুতি এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে সত্যি কিন্তু ২০২২ সালে এসব প্রতিবন্ধকতা থাকবে না; যখন জিডিপি বাড়বে, জিএসপি বাড়বে, রেমিট্যান্স বাড়বে তখন আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে। সেই বাংলাদেশ নির্মাণের দায়িত্ব আমাদের উত্তরসূরিদের।
গত ৪১ বছরে বাংলাদেশে তিন ধরনের সরকার ব্যবস্থা আমরা দেখেছি। গণতান্ত্রিক শাসন, সামরিক শাসন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। গত ৪১ বছরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে পারিনি, অনেক শহীদের কবর শনাক্ত পর্যন্ত করতে পারিনি। একেকটি সরকার আসে আর একেকটি তালিকা তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। এমন অনেক অক্ষমতা আছে। শাসকশ্রেণীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতাসহ গণমানুষের অধিকারের পক্ষে যথার্থ অঙ্গীকার পূরণের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও এ জাতি এগিয়ে যাবে, কেননা পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার নজির বাঙালি ছাড়া আর একটিও নেই। অনেক নেতিবাচক হিসাবের পরও অসংখ্য ইতিবাচক অর্জন রয়েছে আমাদের। সেগুলোর অন্যতম একটির কথা বলিÑ ভোটার আইডি কার্ড তথা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের মধ্য দিয়ে আমাদের তৈরি ডাটাবেজের উদাহরণ এখন অনেক দেশ অনুসরণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, কলহ-কোন্দল এগুলো আমাদের শাসকশ্রেণীর সৃষ্ট সংকট। এগুলো তাদের অপরিপক্ব মন-মানস ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরে।
আমাদের ছেলেরা ডিজিটাল পৃথিবী বিনির্মাণের অংশীদার। ওয়েববিশ্বে ইউটিউবের সহ-নির্মাতা জাভেদ করিম কিংবা খান একাডেমির ইকবাল খান এরকম মাত্র দুটি উদাহরণ। পৃথিবীব্যাপী শ্রম ও মেধার মর্যাদায় বাঙালি জাতি আজ অভিষিক্ত। আর এসবই স্বাধীনতার অর্জন। আমাদের সবকিছু আছে, মেধাবী মস্তিষ্ক, শ্রমের সুদৃঢ় পেশি, প্রকৃতির আশীর্বাদ দরকার শুধু সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তির। আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারি তাহলে কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। আর এজন্যই আমি ভীষণভাবে আশাবাদী। আমরা একাত্তরে পেরেছিÑ পারব এ একুশ শতকেও, অবশ্যই পারব! সব বাধাবিঘœ ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের মুখচ্ছবি গোটা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে। বাঙালির সেই ইচ্ছাশক্তি নতুন প্রজš§Ñ আমি তাদের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখি।
মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.) : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখক, গবেষক।