তিন দিন পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরছি! বাসে বসে ভাবছি ভাল ভাবে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা! সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দূর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে! আমার সিট পড়লো E-2! আমার বামপাশে E-1 সিটে সমবয়সী এক ছেলে বসা! তার কানে হেডফোন আর হাতে মোবাইলে ফেসবুকিং চলছে! আমিও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। গাড়ি ছাড়ার আগেই আমাদের একই সারির ৪র্থ সিটে আই মিন E-4 এসে বসলো এক তরুণী! তার বামপাশে E-3 সিট'টা খালি। গাড়ি চলা শুরু করলে কিছুক্ষণ পর পরের কাউন্টার থেকে ৫০+ এক লোক উঠে মেয়েটির পাশে বসলো। ভদ্রলোক বসলেন না একে বারে প্রায় শুয়ে গেলেন! ডানে তাকালে উনার ভূড়ি ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না! ভূড়ির ওপাশে মেয়েটি ঝড়সড় হয়ে বসে আছে! গাড়ি জ্যাম/জট উপেক্ষা করে কখনো হার্ডব্রেক করে ঝাঁকুনি দিয়ে থামছে আবার কখনো জোরে ছুটে চলছে! মেয়েটি ঝাপটি মেরে বসে আছে আর রাজ্যের চিন্তা তার চেহারায়! আমি নিজ কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছি অথচ গাড়িতে জেমসের গান বাজছে। জেমসের গান মানে তো হৃদয় অাকুতি করে ভালবাসার গান অথচ ঐ ভূড়ি ওয়ালার জন্য আমার ভালবাসা E-4 সিট পর্যন্ত যাচ্ছে না আবার E-4 থেকে ভালবাসা E-2 তে পৌঁছাচ্ছে না! এদিকে জেমসও থামছে না! ঘন্টাখানেক পর বাসে শুধু মাত্র তিনটি প্রাণী জীবিত বাকি সকলে ঘুম! আমি, রাজ্যের চিন্তায় কপাল কুচকানো মেয়েটি আর গুরু জেমস। যেই আমি বাসে বসা মাত্র ঘুম আজ সেই আমার ঘুমের কোন হদিস নেই! দু'চোখের পাতা কিছুতেই এক হচ্ছে না! এমন কি কোন সম্ভাবনাও দেখছি না! গুরুর গানের সাথে আজ আমার ঘুম উধাও।
এ দিকে গাড়ির ড্রাইভার মনে হয় তার বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে বের হয়েছে! বৌয়ের জন্য তার ভীষণ মন খারাপ, না হলে এই মধ্য রাতে কার জন্য এত ভালবাসা উতরাই পড়ছে তার? আমি না হয় খনিকের জন্য E-4 এ বাঁধা পড়ে গেছি তাই জেমসে আবদ্ধ রইলাম কিন্তু সে কেন?
জেমসের গানে ভর করে কখন যে গাড়ি কুমিল্লা চলে এলো বুঝতে পারিনি! সকলে গাড়ি থেকে নামলেও সে কপালে ভাজ নিয়ে একই অবস্থায় আছে। কি অধীর আগ্রহে সে বসে আছে। সে কি আমায় নিয়ে কিছু ভাবছে? সে অপরূপ চাহনী, একই ভঙ্গিতে বসে থাকা!
যাত্রা বিরতি শেষে গাড়ি যখন আবার চলা শুরু করলো তখন ড্রাইভারের আবেগের প্রেম রোমান্সে রূপ নিল। জেমস বাদ দিয়ে উনি হিন্দিতে চলে গেলেন। 'কাহোনা পেয়ার হে' দিয়ে যখন গান শুরু হল আমি বললাম, গাড়িতে উঠা মাত্র বলে দিলাম, মুঝে তুজছে পেয়ার হে লেকিন ঐ ভূড়িওয়ালার জন্য তা পাস হচ্ছে না। তারপর আরো কত হিন্দি গান আর আত্ম- কথোপোকথনে কখন যে গাড়ি চট্টগ্রাম এলে বুঝতে পারলাম না। অন্য যাত্রীদের মতো আমিও গাড়ি থেকে নেমে আপন পথে হাঁটা শুরু করলাম!
অথচ গল্পটা এমন হওয়ার কথা ছিল না! এর প্রেক্ষাপটও কিন্তু ভিন্ন ছিল। লং জার্নিতে আমি সাধারণত বাম পাশে জানালর পাশের সিট পছন্দ করলেও আজ কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কাটার সময় আমি কাউন্টার ম্যানেজার কে বলি আমাকে যেন E-3 সিট দেয়। কিন্তু তিনি জানান ঐ সিট খালি নেই। E-2 না নিলে পিছনের দিকে বসা লাগবে ঐ দিকে কিছু সিট খালি আছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে E-2 নিলাম।
টিকেট কেটে কাউন্টারে বসে থেকে/হাঁটাহাটি করে প্রায় ঘন্টাখানে কাটিয়ে দিলাম। একই কাউন্টার কিন্তু বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রী অপেক্ষামান থাকায় কে কার খোঁজ রাখে? হয়তো তারে কাউন্টারে দেখেছি কিন্তু নিজ গন্তব্যে ফেরার ব্যাকুলতায় সে দিকে লক্ষ রাখা হয়নি!
বাস থেকে নেমে আমি ভাবছি, কেন আমি E-3 সিট চাইলাম? হয়তো একটি নির্ঘুম রাত কাটানোর জন্য ঐ সিট চেয়েও পাইনি অথবা পথে হারিয়ে ফেলবো বলে E-3 সিট পাই নি! আমি যদি E-3 তে বসে আসতাম তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো! তার চিন্তা কারণ কি আমি হতাম কিংবা তার নিশ্চুপ থাকার কারণ আমি হতাম? আমি যদি E-3 তে বসতাম তাহলে সে কি এরকম নিশ্চুপ থাকতো? নাকি আমায় পেয়ে তার মৌনতা পথে হারিয়ে যেত?
এত সকল চিন্তার মাঝে আমি অনিক খানের মতো করে গাইতে লাগালাম,
'ছেলেটার নাম আকাশ-টাকাশ হবে
আর মেয়েটার বর্ষা-টর্ষা কিছু,
সেই ছেলেটার দৃষ্টি অপলকে
বাধ্য হয়েই মেয়ের মাথা নিচু!
তারপরেও হঠাৎ ফাঁকে-ফাঁকে
আড়চোখে সে তাকাচ্ছিল বটে,
চোখে-চোখে হয়নি যে- তা, না তো!
বাসস্টপে তা অহরহই ঘটে!
ইতিহাসের পাতাতে তাই - 'ওরা'
স্থান পাবে না বিপ্লবীদের মতো!'
সফিউল আযম কোরাইশীর অনুগল্প: বাস জার্নি
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৪