আমার বাবা আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল খালেক তিন কি চার প্রজন্ম আগে মেঘনার পাশে কুমিল্লার লুদ্দা বাড়ি এবং বেকি তে বসতি গড়েন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। তাঁরা বিপুল পরিমাণ জমি ইজারা নিয়ে সেখানে কৃষিকাজ শুরু করেন। বন পরিষ্কার করে যাঁরা কৃষিকাজ করতেন, বাঘের সঙ্গে লড়াই করে জিতে আসতেন যাঁরা, তাঁদের বলা হতো মিয়াজী।
আমার বাবার দাদারা সেভাবেই মিয়াজী হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পান। মিয়াজী বংশের লোকজন মনে করতেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে জমিজমা বোঝার মতো পড়ালেখা জানলেই হবে। কিন্তু আমার বাবা এই ধারণার উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলেন। প্রাথমিক শেষ করে বাড়ি থেকে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।
এরপর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সেই সূত্রে তিনি তার অবিরাম পথ চলা শুরু করেছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগপর্যন্ত বজায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনের শেষ সময়ে তিনি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।
আমার বাবা নিজে শিক্ষা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করলেও তিনি চাইতেন, আমি যেন একজন প্রকৌশলী অথবা সরকারি অফিসার হই। কারণ হিসেবে পরে যেটা বুঝেছি, তিনি চাইতেন পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তিনি যেন সংসারের হাল ধরেন। আর ওই সময় সরকারি অফিসার ও প্রকৌশলীদের মূল্যায়ন ছিল সবচেয়ে বেশি।
তবে আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই আমার নিজের আর মাতা পিতার ইচ্ছায়। মা আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, আমি যে পেশাতেই যাব, সেখানেই ভালো করব। আমার মা সেই ব্রিটিশ আমলে ইসলাম এ আলিম পাস করেছিলেন। তাঁর কাছে জীবনপথের অনেক কিছু শিখেছি আমি।
বাবার চাকরি সূত্রে আমাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদলাতে হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল ছিল বেশ কিছু। বাবা ঢাকা তে স্থানীয় সমাজের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। বাবার বাসায় প্রতিদিন বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে কিছু অতিথি পাখি আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। বাবা তাঁদের সঙ্গে নানান তাত্ত্বিক বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপ করতেন।
কিন্তু আমার কখনো সেই আড্ডায় ঢোকার সুযোগ হয়নি। এমনকি আমি প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর যখন পানি, নদী ও পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করেছি, চারদিকে একটু একটু করে আমার নাম ছড়াচ্ছে, তখনো বাবা আমাকে সেই ছোট্টটি মনে করতেন। তাই তাঁর বন্ধুদের আড্ডায় আমার প্রবেশাধিকার থাকবে কী করে!
তবে আমার বাবা সারা জীবন যে কাজটি করে গেছেন, সেটি আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করেছে। বিষয়টি হচ্ছে, কোনো জটিল বিষয়কে সহজভাবে বলা ও বোঝানো। সারা জীবনে বাবা ইলেকট্রনিকস এর ওপর টুকটাক কাজ করে নিজের বাসা আর ছাদ বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। মসজিদে গেলেই আরবি চর্চা করতেন। তিনি বলতেন 'পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি।’ দেশের আইনজীবীরা যেভাবে আইনকে কঠিন করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন, বাবা সবসময় সেটি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন।
আমি নিজেও তাঁর কাছ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি। ইউনির্ভাসিটি থেকে পাস করার পর পানি, পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করার সময় আমি বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে শুরু করি। প্রকৌশল থেকে শুরু করে নাগরিকতার মতো জটিল-কঠিন বিষয়গুলো আমি, পরিবারের জন্য উপযোগী করে তোলার যে উদ্যোগ ব্যক্তিগতভাবে তখন নিয়েছিলাম, তার পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বাবার শিক্ষাই।
আমার মা ও বাবা দুজনই ধার্মিক ছিলেন, নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তিনি যেখানেই যেতেন, সেখানকার বড় লাইব্রেরিতে সময় কাটাতেন। তাঁর কাছ থেকে ধর্ম থেকে শুরু করে প্রকৌশলী আর ছাদ বাগানের অভ্যাস করেছি আমি। বাবার ব্যক্তিগত কাজের সংগ্রহশালাটি এখনো আমি আর বাবা মিলে রক্ষণাবেক্ষণ করছি
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২২ দুপুর ১:৫৫