নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। ৭১এর মুত্তিযুদ্ধ আমরা দেখিনি। ভেবেছিলাম এরপর কোনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এবারের মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিতে পারছি না স্রেফ আদর্শগত পার্থক্যের কারণে। শুনেছি ৭১এর মুক্তিযুদ্ধেও ঠিক এমনি টানাপোড়েন-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল আদর্শভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে। তখন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি তাদের ভয় ছিল ফের হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের অত্যাচারের নিগড়ে বন্দি হবার। কারণ হিন্দুদের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে ১৯৪৭এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তারা স্বাধীনতা এনেছিলেন। সেই ইসলামী ব্যক্তিরা আজ বাংলাদেশে রাজাকার নামে ধিকৃত। হয়ত আগামী প্রজন্ম আমাদেরকেও রাজাকার বলে ধিক্কার জানাবে। সারা পৃথিবীর মানুষের ধিক্কার সহ্য করা যায়, কিন্তু নিজের পরিবারে, নিজের সন্তানের কাছে রাজাকার বা ঘৃণিত কিছু হওয়া সত্যিই কষ্টের। তাই আমার আগামী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই কেন আজকের কথিত মুক্তিযুদ্ধে আমি অংশ নিতে পারছি না।
আজকের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল গত মঙ্গলবার। ৫ই ফেব্রয়ারি।২০১৩। ঠিক যে দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল সেই দাবিটি মাত্র ৬দিনে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। তার বদলে স্থান করে নিয়েছে ভিন্ন কিছু দাবি; যার মূলে রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী আদর্শ। বলাইবাহুল্য সেই মুক্তিযুদ্ধ এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং জাতীয়ভাবে সারাদেশে বিস্তৃত হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার কয়েকজন ব্লগার শাহবাগ মোড়ে ছোট্ট একটি ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, কাদের মোল্লা নামের এক ব্যক্তির ফাসিঁর দাবিতে। ব্লগাররা মনে করেছিলেন আদালত কাদের মোল্লার প্রতি সুবিচার করেননি। তার প্রাপ্য সাজা ফাঁসি তাকে দেয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্লগার ও ফেসবুকের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করেছেন সরকারপক্ষ একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে কাদের মোল্লার রায়কে প্রভাবিত করেছেন। অর্থাৎ ব্লগার ও অনলাইন অ্যক্টিভিস্টদের সেই আন্দোলনটি ছিল মূলত সরকারের নীতিজ্ঞানহীন গোপন আঁতাতের বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে আন্দোলনকারীদের সুযোগ দিয়ে এবং তার পক্ষের মিডিয়াকর্মীদের ব্যবহার করে সেই আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। অতপর কতিপয় ব্লগার ও অনলাইন অ্যক্টিভিস্টের সেই ক্ষোভ সেই দাবি পরিণতি পেল ভিন্ন এক রাজনৈতিক মতাদর্শে। যা পরিপূর্ণভাবে ইসলাম বিদ্বেষী। শাহবাগের নতুন প্রজন্মের সেই মুক্তিযোদ্ধারা মহাসমাবেশ করার জন্য বেছে নেয় পবিত্র জুমআর দিন। এবং কোটি কোটি মুসলমান যখন পবিত্র জুমআর নামাজ আদায়ে ব্যস্ত তখনও বাংলাদেশের প্রাইভেট টেলিভিশনগুলো দেখায় শাহবাগ স্কয়ারে চলছে ফাঁসির দাবিতে উন্মাতাল নৃত্য-স্লোগান। আমি ওইসব মিডিয়াকর্মীদের প্রশ্ন করতে চাই, সেই জুময়ার নামাজে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের সংখ্যা বেশি নাকি তখন শাহবাগে নামাজ না পড়ে যারা কোনও এক ব্যক্তির বা বিশেষ দলের ব্যক্তিদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন তাদের সংখ্যা বেশি ছিল? তবু অনিবার্যভাবে নিজেদের চাওয়া ও মতাদর্শের অনুকূলে থাকায় ওই সমাবেশকেই (যদিও তখনও মহাসমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়নি)-লাইভ সম্প্রচার করে যারা মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলেন তাদের ওয়াসওয়াসা দিচ্ছিলেন মসজিদ নয় তোমাদের পথ হোক শাহবাগ! খুব শক্তিশালী ঈমানদার যুবকরাই পেরেছিলেন সেদিন শাহবাগের নারী-পুরুষের লাইভ আহ্বান উপেক্ষা করে পবিত্র জুময়ার নামাজে অংশ নিতে। বাকীরা ভেসে গেছেন গড্ডলিকাপ্রবাহে। আমি সেই ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষদের একজন। তাই আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। আমি আল্লাহপাকের এক নগণ্য বান্দা, যার কাছে আল্লাহর নির্দেশের চেয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি মোটেই বড় কিছু নয়।
এরপর সেই মহাসমাবেশ পরিণত হলো নাস্তিকদের এবং কমিউন্স্টি তথা বামপন্থীদের মহাসমাবেশে। যারা মহাসমাবেশে এসেছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রতি ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতি, ট্রাইব্যুনালকে প্রভাবিত করার অপরাধে সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাতে তারা তাদের মতকে উচ্চকিত করতে না পেরে বলি দিলেন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার শপথের কাছে। যারা সেই শপথে কণ্ঠ মিলাতে পারলেন না, বাম-কমিউনিস্ট-নাস্তিকদের আদর্শের কাছে নিজের মত কে বলি দিতে পারলেন না তারা হলেন এ প্রজন্মের রাজাকার। আমি তাদেরই একজন। কারণ আমার কাছে পবিত্র কোরআনের নির্দেশের চেয়ে বড় কোনও আদর্শ নেই। আর পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন হে নবী, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, কাফের ও মোনাফেকদের আনুগত্য করো না; অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সব কিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ কুশলী। সূরা আহযাব-১। হে নতুন প্রজন্ম তোমরাই বলো যারা মহান আল্লাহর কালিমায় বিশ্বাস করে এমন ঘোষণা দেয়া সত্বেও পবিত্র জুময়ার নামাজ না পড়ে মহাসমাবেশস্থলে বসে স্লোগান দিয়েছে তারা কি মুসলমান? নাকি মুনাফেক? নাকি কাফের?
নতুন সেই প্রজন্ম, তরুণ প্রজন্মের কাছে মানুষ আশা করেছিলো তারা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেচ্চার হবে। তাদের এ মহাসমাবেশ হবে ভারতের আন্নাহাজারের মতো কোনও দেশপ্রেমী আন্দোলন। কিন্তু কতিপয় বামপন্থী নাস্তিক ও অমুসলিম কতৃত্বশীল ব্যক্তির হাতে মাইক্রোফোন এবং অনুচর মিডিয়ার কাভারেজের প্রভাবে সেই মহাসমাবেশে দেশপ্রেমের ছিটেঁফোঁটাও দেখতে পায়নি জনগণ। যদি প্রাইওরিটির ভিত্তিতে সাজানো হয় তাহলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের মানুষ হারিয়েছে পদ্মাসেতুর মতো বড় সম্পদ, বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে চুরি হয়ে গেছে ৪হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশের মানুষ রাশিয়ার কাছে ঋণে আবদ্ধ হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশের নদীগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ফারাক্কা ও টিপাইমুখ ড্যামের কারণে, বাংলাদেশের দরিদ্র শ্রমজীবি মানুষ বন্দি সূদভিত্তিক অর্থনীতির কাছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিষ্পেশিত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কাছে, পুলিশের বুটের নীচে, স্বাধীন গণমাধ্যম হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী এবং গৃহপালিত, প্রতিদিন বর্ডারে জীবন দেয় ফেলানীর মতো নিরীহ বাংলাদেশী। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হলো না সেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে। তবে কি এটাকে গণজাগরণ বলবো নাকি চেতনার গণসহমরণ বলবো? নাকি স্রেফ গড্ডলিকাপ্রবাহ বলবো? আমি মনে করি যুবসমাজের জাগৃতি হতে পারে শুধুই আদর্শ ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে। কারও প্রতি হিংসা কিংবা বিদ্বেষের ভিত্তিতে নয়। সুতরাং আসুন প্রায় শতভাগ এই মুসলমানের দেশে আরও একটি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি, তৈরি করি ভিন্ন একটি প্ল্যাটফর্ম; যাদের আদর্শ হবে ইসলাম এবং যাদের চেতনায় থাকবে দেশপ্রেম।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




