এসময়ের ভয়াবহ দুঘর্টনা পুরান ঢাকার নিমতলির অগ্নিকান্ড। অগ্নিকান্ডের সূচনা রাত দশটার আগেই। ফলে, অধিকাংশ স্যাটেলাইট টেলিভিশন তাদের রাতের বুলেটিনে সংবাদটি দিতে পেরেছে। রাত দশটা বা সাড়ে দশটা কিংবা এগারোটার বুলেটিনের গুরুত্ব অনেক। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর শহুরে অনেকেই সর্বশেষ সংবাদটি জেনে ঘুমাতে চান। তাদের জন্য এসব বুলেটিন বেশ কাজের। যারা একটু বেশী ব্যস্ত থাকেন তাদের জন্য অবশ্য রাত একটার বুলেটিন বেশী কার্যকরী।
রাত বারোটার মধ্যেই অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতির একটি ধারণা স্যটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে সারাদেশের মানুষ জেনে যায়। কোন কোন চ্যানেলে সংবাদ বিশ্লেষনের অনুষ্টানের কাঠামো সেদিন কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। ঘটনাস্হলে অবস্হানরত রিপোর্টারের সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলে জানিয়ে দেয়া হয় সর্বশেষ পরিস্হিতি।
ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ঘটনাস্হলে ছুটে যান। মেয়র পরিচয় বাদ দিলেও পুরান ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে তিনি একাজটি করবেন তা স্বাভাবিক। রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ছুটে গেলেন হাসপাতালে আহতদের দেখতে। ঘটনা এতই গুরুতর ছিলো যে, এমনিতেই এর সংবাদমূল্য ছিলো অনেক। এবার প্রধান বিরোধীদলের প্রধানের এই উদ্বেগও সংবাদ হলো।
নিরাপত্তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে রাতে ঘটনাস্হলে বা হাসপাতালে যেতে পারেননি। তিনি গেছেন পরে, দিনে। তবে সরকার প্রধানের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করতে না হলে তিনিও ছুটে যেতেন আহতদের পাশে, এ ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু, তিনিও সে রাতে ঘুমাতে পারলেন না। রাত জেগে থাকলেন টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে।
কোন ঘটনার তথ্য জানতে প্রধানমন্ত্রীর অনেক সোর্স থাকে। তিনি গোয়েন্দা সংস্হার মারফতে জানতে পারেন। সরকারের নির্বাহীদের মারফতে জানতে পারেন, এমনকী জানতে পারেন দলীয় লোকদের মারফতেও। এসব মারফতে তিনি তথ্য জেনেছেন এটা ধরেই নেয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের কাঁতারে এসে তথ্য নিলেন গণমাধ্যম থেকেও। নির্দেশনা দিলেন পরিস্হিতি মোকাবেলার।
এমনি একটি দুর্যোগের রাতে, পুরান ঢাকার অসংখ্য উদ্বেগাকুল মানুষের সঙ্গে জেগে রইলেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, ঢাকার মেয়র, সেনা বাহিনীর উদ্ধারকারী দল, RAB পুলিশের নিরাপত্তা রক্ষী, ফায়ার ব্রিগেডের সদস্য আর গোয়েন্দারা। সেই সাথে জেগে থাকলো স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা কক্ষ।
এমন ঘটনা ঘটবে তা কেউ জানত না। বিয়ে বাড়ীর আনন্দ বদলে যাবে এমন বিষাদে তা কেউ কামনাও করেনি। কাজেই এটি একটি ব্যতিক্রম এবং দুর্ঘটনা। এর সংবাদ সংগ্রহ করতে আবশ্যই একাধিক টিম জেগে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করবে এবং প্রচার করবে। টেলিভিশন চ্যানেলে এমনটিই হয়ে থাকে। এমনকী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের ঘোষনার রাতেও বিভিন্ন চ্যানেলের একাধিক সংবাদিক রাত জেগে কাজ করেছেন। দায়িত্ব পালনের এই ঘটনা দুটোকে নাইট ডিউটি বলার কোন কারণ নেই। এগুলো বিশেষ পরিস্হিতিতে বিশেষ দায়িত্ব পালন মাত্র।
তবে এমন দুঘটনা ঘটতে পারে সে আশংকায় সারারাতের জন্য টেলিভিশনের পুরো নিউজরুম জাগিয়ে রাখা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু ভালো- তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হতে পারে।
নিমতলি দুঘর্টনার সে রাতে সংবাদিক এবং সংবাদ কর্মীদের জেগে থাকা স্বাভাবিক এবং দায়িত্ব পালন প্রশংসার দাবিদার হলেও প্রতিরাতেই নাইট ডিউটির নামে সংবাদিকদের জাগিয়ে রাখা কর্মঘন্টার অপচয়ের নামান্তর নাকি তা কর্মঘন্টার যথাযথ ব্যবহার তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
দুই.
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নাইট ডিউটির প্রকৃতি সম্পর্কে একটু বলে রাখা ভালো। বিকেল তিনটায় অফিসে এসে রাত একটায় চলে যাওয়া-এটাকে বলা হয় লেট নাইট। পত্রিকাতে এটি করা হয়, অনুসরণ করা হয় টেলিভিশনেও। আর সন্ধ্যায় এসে সারা রাত জেগে সকাল আটটায় ঢুলু ঢুলু চোখে ঘরে ফেরার নাম করা যায় নাইট ডিউটি। যা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে।
সংবাদপত্রে একজন সাংবাদিক থাকেন যিনি শেষ মুহুর্তের ঘটনা বা দুর্ঘটনার শেষ খবরটি পাঠকের জন্য লিখে রেখে যান। এই আলোচনায় তাদের কথা বলা হচ্ছে না। কারণ পত্রিকা দিনে একটিই বের হয়। সেখানে সব সংবাদ রেখে না দিলে পাঠক তা আর পাবেন না। আলোচনা হতে পারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেবল টিভি রিপোর্টারদের নাইট ডিউটি বিষয়টিই।
সকালে ঘুম থেকে জেগে টেলিভিশনের দর্শক কি খুন বা দুঘর্টনায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষের ছবি দেখতে পছন্দ করবেন? নাকি দিনের প্রস্তুতি একটু ফুরফুরে মেজাজে নেয়া শুরু করবেন তা ভাবার সময় এসেছে। দিনের বিভিন্ন সময়ে কাজে আসবে এমন তথ্য একজন দর্শককে আগাম জানিয়ে বৈচিত্র আনা যায় সকালের বুলেটিনে। প্রতিদিন সকালের বুলেটিনটিই হতে পারে নতুন।
কিন্তু রাত একটার পর যে সব সংবাদ আসতে পারে তার একটা তালিকা করলে প্রথম দিকে থাকবে অপরাধ ও দুঘর্টনা সম্পর্কীত সংবাদ। অবশ্য অগ্নিকান্ডও রাতে হতে পারে, যা সব সময হয়না। এসব ক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহের উৎস থানা, হাসপাতাল এবং ফায়ার ব্রিগেড। কখনো বা নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান। অভিযান সরাসরি প্রচারে বা অভিযানের সময় বাহিনীর সঙ্গে সাংবাদিকরা থাকলে, অভিযান কতটুকু সাবলীল হবে তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে।
তিন.
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশন এমনকী অনলাইন বার্তা সংস্হায় শুধু নাইট ডিউটির জন্যই আলাদা লোক নেয়া হয়। লোক নিয়োগে আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন এবং সুযোগ সুবিধাও দেয়া হয়। সেসব দেশে রাতের শিফটে কাজ করার স্বাস্হ্য ঝুঁকি নিয়ে গবেষণাও করা হয়েছে অনেক। সে সব গবেষণায় বলা হয়েছে রাত একটা থেকে তিনটায় মেলাটোনিন নামের হরমোন তৈরী হয় সবচেয়ে বেশী। এই হরমোন যৌবন ধরে রাখার দায়িত্ব পালন করে। জৈব ঘড়ির উল্টা-পাল্টা হলে এই হরমোন তৈরীতে বাঁধা পড়ে বলে ইন্টারনেটে গবেষকদের তথ্য রয়েছে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ব্লগের ২০০৭ সালের ৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় কারা রজার্স একটি প্রাথমিক গবেষণার বরাত দিয়ে লিখেছেন, রাতের ডিউটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
Cancer on the Night Shift: Why Night Workers Are at Risk
Kara Rogers - December 7th, 2007
A preliminary study published in the December issue of the journal The Lancet Oncology provides a summary of scientific evidence of increased cancer risk in night-shift workers, as well as increased cancer risk in painters and firefighters. The study, conducted by the World Health Organization’s International Agency for Research on Cancer (IARC), emphasizes the impact of night-shift work on melatonin secretion, immune function, cancer risk, and disruption of circadian rhythm.
আর আমাদের দেশের চিকীৎসকরা বলেন, প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুম হলে কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
একটা কথা অবশ্য এখানে উল্লেখ না করলেই না। আমরা একটা প্রবাদ তৈরী করেছি, শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সওয়ায় তাহা সয়। এর সত্যতা প্রমাণ করে আমাদের দেশের নাইট গার্ডরা বহাল তরিয়তে ভালো থাকেন এবং দিনের পর দিন রাত জাগা দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অবশ্য মেধা খরচ করতে হয়না সাংবাদিকদের মতো।
চার.
ঢাকায় নাইট লাইফ নেই। রাত একটার পর চাইলেও সরকারের নীতি নির্ধারণী কারো সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করা যাবেনা। রাতে থানা বা ফায়ার ব্রিগেড জেগে থাকলেও সে আফিসগুলো রাতে কি ধরণের সংবাদ দিতে পারে তা আগেই বলা হয়েছে।
তবে হ্যা, রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক সন্ধ্যায় শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলতে পারে। রাজনৈতিক দল যেহেতু সংবাদের অন্যতম উৎস, সেসব বৈঠক আবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
আর বাকী থাকে ফিচার। রাতে কারা সজাগ থাকেন, কাদের ঘুম বিসর্জনের পরে নিরাপদ থাকে ঢাকার মানুষ, হোটেলের ফেলে দেয়া খাবার কীভাবে হয় মাছের খাবার – সেসব নিয়ে ফিচার হতে পারে। রাতের কাওরান বাজার নিয়ে ফিচার হতে পারে, তবে তার জন্য এক জন সাংবাদিককে পুরো রাত জাগিয়ে রাখা কতটুকু কাজের ?
একরাত জাগাতে সেদিনটি এবং নির্ঘুম রাতের পরের দিনটি সাংবাদিককে ছেড়ে দিতে হবে অফিস থেকে। এক রাতের অনিশ্চিত সাংবাদিকতার জন্য দুটো সম্ভাবনাময় দিনের ছুটি দেয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কতটুকু লাভজনক, তাও নিশ্চয়ই ভাবেন কেউ কেউ।
@আনোয়ার সাদী, মিডিয়া ওয়াচে প্রকাশিত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




