যদি তুমি সজাগ থাকো, আমাকে একটা ফোন দাও। ঘুম ভেঙেই এই ক্ষুদে বার্তা দেখতে পেলে একটা অজানা আশঙ্কায় মন ঢেকে যায়। তাও যদি বার্তা আসে ভোর সাড়ে চারটায়। সাংবাদিকের মন অন্যদের চেয়ে একটু শক্ত বলে প্রচলিত কথাটি এ সময় কার্যকর মনে হয় না। কী ঘটল? প্রিয় কারও কি কিছু হলো? জানতে সেই বন্ধুকে ফোন করা হলো। জানা গেল একটি মৃত্যুসংবাদ। মারা গেছেন বন্ধুটির পীর সাহেব (ইন্না লিল্লাহিঃরাজিউন)। খবরটি স্ক্রলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। বন্ধুটির বিনীত অনুরোধ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে তার অগণিত ভক্ত, মুরিদ। তাদের জানা দরকার। তাই রাত শেষ হওয়ার আগেই বন্ধুটির ক্ষুদে বার্তা। সে নিজেও রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশে। টেলিভিশনের পর্দার নিচের দিকে এক থেকে দেড় ইঞ্চি জায়গায় যে লেখাগুলো সব সময় এগিয়ে যায়, তাকেই স্ক্রল হিসেবে উল্লেখ করেছে সেই বন্ধুটি। সম্প্রচার সাংবাদিকদের কাছে তা টিকার নামেই বেশি পরিচিত। টেলিভিশনের পর্দায় সাধারণত এই লেখাগুলো ডান থেকে বাঁয়ে চলমান থাকে। সংক্ষেপে সব শেষ খবর দেওয়ার জন্য বা অন্য কোনো কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। (নঈম তারিক, টেলিভিশন সাংবাদিকতা, জনান্তিক) কোনো কোনো চ্যানেলের টিকারে অবশ্য একটি বাক্য মুছে গিয়ে তার স্থলে আরেকটি বাক্য ফুটে ওঠে। আমাদের দেশে, কোনো ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, যা আরও অনেক দূর যেতে পারে এমন ব্রেকিং নিউজ বা পুরোনো ঘটনার নতুন মাত্রা টিকারে বেশ গুরুত্ব পায়। এর সঙ্গে কোনো চ্যানেলের অনুষ্ঠানসূচি, সংবাদের সময় জানিয়ে দেওয়ার কাজটিও করে এই টিকার। আর কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও টিকারের আভিজাত্য বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণ। এরই মধ্যে টিকার বেশ জনপ্রিয় এক শ্রেণীর দর্শকদের মধ্যে। তবে জোর কথা হলো, সঠিক টিকার ব্যবস্থাপনা একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে জনপ্রিয় করতে পারে। কীভাবে তা সম্ভব, বলার জন্যই এই লেখার অবতারণা।
আমার বন্ধুটি সাংবাদিকতার অনেক নিয়মই জানত না। তার পীর সাহেবের মৃত্যুর তথ্যটির জাতীয় সংবাদমূল্য কতটুকু, তা ভাবার প্রয়োজন মনে করেনি। সে শুধু জানত, টিকারে প্রচার হতে থাকলে অধিকাংশ মানুষ তা জানতে পারবে। আর এই জানার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সংবাদ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে টিকারের অসীম শক্তিমত্তা। যদিও টেলিভিশনের সব দর্শকই টিকারের দর্শক নন। একটি টেলিভিশনের মোট দর্শকের তূলনায় টিকারের মোট দর্শক অনেক কম। কারণ, টিকার থেকে তথ্য জানতে হলে আগ্রহীকে শিক্ষিত হতে হয়। সঠিক টিকার ব্যবস্থাপনা ২৪ ঘণ্টার সংবাদনির্ভর চ্যানেলের চেয়ে, একই সঙ্গে বিনোদন ও সংবাদ প্রচার করে, এমন চ্যানেলগুলোর জন্য বেশি দরকারি। কারণ, ২৪ ঘণ্টার চ্যানেলগুলো, ঘন ঘন সংবাদ প্রচার করে মানুষের সংবাদ জানার অভ্যাস বদলে দিতে পারে। বিনোদন চ্যানেলের নির্ধারিত সময়ে সংবাদ দেখার জন্য বসে না থেকে, যখন হাতে সময় পাওয়া গেল, তখনই সংবাদটি দেখে নেওয়া যাচ্ছে ২৪ ঘণ্টার চ্যানেলে। সঠিক টিকার ব্যবস্থাপনা ঠিক এই কাজটিই করতে পারে বিনোদন ও সংবাদ একই সঙ্গে প্রচার করা হয় এমন চ্যানেলের জন্য। দিনের পুরোটাজুড়েই সংবাদের সঙ্গে বেঁধে রাখতে পারে দর্শকদের। এখনো টিকারে সংবাদ পরিবেশন করে টেলিভিশনগুলো। অনলাইন বার্তা সংস্থা এমনকি পত্রিকাগুলো অনলাইন ভার্সনেও স্ক্রল আকারে সদ্য সংবাদ বা ব্রেকিং নিউজ বা নতুন সংবাদ প্রচার করা হয়। এর বাইরে গিয়ে নতুন আর কী করা যায়? নতুন যে কাজটি করা যায়, তা হলো টিকারে মনোযোগ দেওয়া। কোনো একটি সভা বা ঘটনার ক্রমাগত তথ্য দেওয়া। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক একটি সংবাদের উদাহরণ টানা যায়। ‘অব্যাহত দরপতনের জের ধরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শেয়ারের লেনদেন’। টিকারে এটুকু পড়েই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মনোযোগ টেলিভিশনে আটকে যায়। এই একটি লাইন টিকারে বারবার ঘুরলে বিনিয়োগকারী-দর্শকের আঙুল বারবার চাপ দেবে রিমোটে। কারণ সংবাদ জানার আগ্রহ তাকে পেয়ে বসেছে। ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল একটু পর পর শেয়ারবাজারের সংবাদ জানিয়ে সেই দর্শককে লুফে নিতে পারে। কিন্তু নিজেদের সংবাদ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত টিকার কাজে লাগিয়ে সেই দর্শক ধরে রাখতে পারে অন্যরা। এ ক্ষেত্রে টিকারে ক্রমাগত নতুন তথ্য দিতে হবে। হয় তথ্য বদলাতে হবে, না-হয় নতুন তথ্য যোগ করতে হবে। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে যেসব তথ্য দেওয়া যায়, তা হলো, বাজার শুরুর মাত্র ৫০ মিনিটের মাথায় বন্ধ করা হলো লেনদেন।
এ সময়েই চার শ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা পথে নেমে এসেছেনঃ
বিনিয়োগকারী-পুলিশ সংঘর্ষঃচার সাংবাদিক আহত।
সাংবাদিক পরিচয়েও বাঁচা যায়নি পুলিশের পিটুনি থেকেঃ
শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধঃ
বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা গাড়ি ভেঙেছেনঃ
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে নয়া পল্টনেঃ
এসইসিতে জরুরি বৈঠকঃ
বৈঠকে কারা যোগ দিচ্ছেন, কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে-এমন নানা তথ্য একটির পর একটি টিকারে সংযোজন করা যায়। অবশ্য মূল ঘটনাটি এক লাইন আগে বলে রাখতে হবে। তা না হলে সদ্য যোগ দেওয়া দর্শক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাহলে টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান চলল, একই সঙ্গে এনসিএ বা নিউজরুম মাত্র দেড় ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করে সংবাদ আপডেট দিতে পারল। দিনশেষে আর সকালের সংবাদ বা আগের দিনের সংবাদ টিকারে রাখতে হচ্ছে না। তরতাজা সংবাদ পেতে শিক্ষিত দর্শকের চোখ আটকে থাকবে টিকারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বলা যায়, প্রতিদিন তো আর এমন দিন হয় না। মাঝে মাঝে কোনো বিষয়ে এমনটি করা যায়। ধরা যাক চিনির দাম চড়ছে। সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার দিকে তাকিয়ে সবাই। তখন কোনো একটি দিনের টিকার ব্যবহার করা যায় ভালোভাবেই। সকালেই লেখা যায়, চিনির দর নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক সকাল ১০টায়ঃ
চিনির দর বিষয়ে মন্ত্রী-ব্যবসায়ী বৈঠক শুরুঃ
চিনির দর নিয়ে বৈঠকে মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদের উত্তেজনা, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় (যদি হয়)
দাম কমাতে সম্মত ব্যবসায়ীরা, প্রতি কেজি...টাকা।
এভাবে একটু পর পর আপডেট দিয়ে জনপ্রিয় করা যায় চ্যানেল। এখন অবশ্য বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানানো হয় টিকারে, সেটিই ঘুরতে থাকে দিনভর। প্রতিদিন টেলিভিশনের বিভিন্ন রিপোর্টার বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেন। কেউ আদালতে, কেউ সংগ্রহ করেন অপরাধের সংবাদ, কেউ অর্থনীতি, রাজনীতি, বিনোদনসহ নানা ক্ষেত্রের সংবাদ সংগ্রহ করেন। তারা সবাই যদি এভাবে ক্রমাগত সংবাদ পাঠাতে থাকেন, তবে টিকার হবে আরও প্রাণবন্ত। যত সহজে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের কথা বলা হলো, কাজটি করা তত সহজ নয়। এ জন্য দরকার খুবই শক্তিশালী টিমওয়ার্ক। প্রতিবেদক সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন। একটি তথ্য দ্রুত দিতে গিয়ে আরেকটি তথ্য হারিয়ে ফেলতে পারেন অমনোযোগের কারণে। এ ক্ষেত্রে অফিস থেকেই কাউকে না কাউকে যোগাযোগ করার সুযোগ ও পরিবেশ থাকতে হবে।
টিকার লেখার কাজটি সাংবাদিকতার অন্যান্য কাজের চেয়ে একটু আলাদা। প্রতিবেদক সংগ্রহ করেন সংবাদ। ন্যাশনাল/ ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে কর্মরত নিউজরুম এডিটররাও প্রতিনিধি/ মাধ্যমের সহায়তায় দেশ/বিদেশের বিভিন্ন স্থানের সংবাদ সংগ্রহ করেন। টিকারের ক্ষেত্রে নিউজরুম এডিটরদের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিবেদককে ফোন করে জেনে লিখে দিতে। এই কাজটি সাধারণত নিউজরুম এডিটরদের দেওয়া হয়। তারা সব সময় অফিসে থাকেন বলে এটা করা হয়। ভালো হয় টিকার লেখার জন্য আলাদা হাত নিয়োগ দেওয়া গেলে। তবে তা খরচসাপেক্ষ। যা হোক, টিকার দর্শক ধরে রাখার আরেকটি উদাহরণ শেয়ারবাজারের দামের প্রদর্শন। বাজার চলাকালে অনেক বিনিয়োগকারী অন্য চ্যানেলে তার প্রিয় অনুষ্ঠান না দেখে কিংবা সে অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে রিমোট টিপে, অন্তত দেখে নেন তার শেয়ারের দাম কত হলো। এ ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম প্রদর্শন অন্তত বিনিয়োগকারী দর্শককে চ্যানেল না বদলে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাৎক্ষণিক সংবাদে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
টিকার যেহেতু তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দেয়, তাই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার দরকার আছে। এ ক্ষেত্রে কর্তব্যরত নিউজ এডিটরকে দায়িত্ব নিতে হবে বেশি। খেয়াল রাখতে হবে, যেন বার্তা সম্পাদকের জ্ঞানের অগোচরে কোনো সংবাদ টিকারে স্থান না পায়।
@আনোয়ার সাদী, প্রথম প্রকাশ: মিডিয়া ওয়াচ...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




