বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। তাই কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এদেশের জন্য অপরিহার্য। কিন' নানারূপ প্রতিকূল অবস'া ও মানুষের উদাসীনতার জন্য কৃষি উৎপাদন আজ হুমকীর সম্মুখীন। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আবাদি জমির পরিমানও হ্রাস পাচ্ছে উলেস্নখযোগ্য হারে। সুতরাং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণার্থে ভিন্নধর্মী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস'ার সম্প্রসারণ আজ জরম্নরী হয়ে পড়েছে। হাইড্রোফনিক এমনই একটি ভিন্নধর্মী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস'া। এই পদ্ধতিতে নগরবাসী নগর কৃষক হিসাবে শখে বা পারিবারিক প্রয়োজনে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারেন বাসা বাড়ীর ছাদে বা বারান্দায়। প্রিয়দর্শক শ্যামল বাংলায় আজ আপনাদের দেখাবো হাইড্রোফনিক পদ্ধতি সম্পর্কে।
হাইড্রোফনিক একটি অত্যাধুনিক উৎপাদন ব্যবস'া। সাধারণত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করাকেই হাইড্রোফনিক পদ্ধতির চাষ বলা হয়।
হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কিছু উলেস্নখযোগ্য সুবিধা রয়েছে ঃ
ক্স হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে মাটির প্রয়োজন হয়না বিধায় সারা মৌসুমে ফসল উৎপাদন করা যায়।
ক্স মাটি ছাড়া ফসল উৎপাদিত হয় বলে ফসলে মাটি বাহিত রোগ ও কৃমি জনিত রোগ হয় না।
ক্স কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ায় কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না, বিধায় কীট নাশক মূক্ত সবজি উৎপাদন করা যায়।
ক্স এই পদ্ধতিতে ছোট এবং বড় পরিসরে স্বাস'্য সম্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়।
ক্স এটি হোম-ফার্মিং এর জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি বিধায় অধিক লাভজনক, অর্থকরি ও মান সম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক হাইড্রোফনিক পদ্ধতির ব্যবহার সম্পর্কেঃ
সাধারণত দুটি উপায়ে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।
১. সঞ্চালন পদ্ধতি
২. সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি
সঞ্চালন পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেওয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অনৱতপৰে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুষঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তি বছর থেকে শুধু রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে উৎপাদন ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পায়।
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিঃ সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। খাদ্য উপাদান সরবারহের জন্য এখানে কোন প্রকার পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এৰেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রব্য উহার উপর স'াপিত কর্কশীটের মাঝে ৫ থেকে ৭ সেমি. পরিমাণ ফাঁকা রাখতে হবে এবং কর্কশীটের উপরে ৪-৫ টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যেন সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনী অক্সিজেন কর্কশীটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। আমাদের দেশের মানুষ খুব সহজেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাষ্টিক বালতি, পানির বোতল মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদে, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালন বিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। তাছাড়া এতে খরচও তুলনামূলক কম হয়ে থাকে।
প্রিয়দর্শক আসুন এবার জেনে নেই হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে কি কি ফসল উৎপাদন করা যায়.......
ক্স পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, কলমি শাক, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপির চাষ উপযোগি।
ক্স ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, শসা, করলা, খিরাসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করা যায়।
ক্স ফলের মধ্যে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে স্ট্রবেরী চাষ সবচেয়ে লাভজনক।
ক্স এছাড়া ফুলের মধ্যে এ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমলিস্নকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ করা সম্ভব।
চারা উৎপাদন ঃ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জ বস্নক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্পঞ্জকে ৩০ সেমি. ইন্টু ৩০ সেমি. সাইজে কেটে নিতে হবে এবং এই স্পঞ্জকে ২.৫ সেমি. দৈর্ঘ্য ও ২.৫ সেমি. প্রস'্য বর্গাকারে ডট ডট করে কেটে নিতে হয় এবং এর মাঝে ১ সেমি. করে কেটে প্রতিটি বর্গাকারে স্পঞ্জ এর মধ্যে ১ টি করে বীজ বপন করতে হবে। তবে বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ১০% ক্যালসিয়াম অথবা হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ থেকে চারা গজানোর ২-৩ দিন পর প্রাথমিক অবস'ায় ৫-১০ মিমি. খাদ্য উপাদান সম্বলিত দ্রবণ ১ বার এবং চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর থেকে চারা রোপনের পূর্ব পর্যনৱ প্রতিদিন ১০-২০ মিলি. দ্রবণ দিতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের চারার বয়স ও পিএইচ মানের মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। তাই উলেস্নখযোগ্য ফসলের জন্য বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পিএইচ মান আসুন জেনে নেই
ফসলের নাম উপযুক্ত চারার বয়স পিএইচ মান
টমেটো ৩-৪ সপ্তাহ ৫.৫-৬.৫
লেটুস ২-৩ সপ্তাহ ৬.০-৬.৫
ক্যাপসিকাম ৪-৫ সপ্তাহ ৬.০-৬.৫
শসা ২-৩ সপ্তাহ ৫.৮-৬.০
বাঁধাকপি ৪-৫ সপ্তাহ ৬.৫-৭.৫
স্ট্রবেরী ২-৩ সপ্তাহ ৫.৫-৬.০
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য জলীয় খাদ্য দ্রবণ অপরিহার্য। তাই জলীয় খাদ্য তৈরীতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমান ও খাদ্য তৈরীর পদ্ধতি সম্পর্কে জানা অত্যাবশ্যকীয়। আসুন সেগুলো জেনে নেওয়া যাক ১০০০ লিটার পানিতে কি পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান মেশাতে হবে।......
রাসায়নিক উপাদান পরিমান
পটাসিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম
পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম
ক্যালসিয়াম নাইট্রেট ১,০০০ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম
ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম
ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম
বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম
কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম
অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ০.৩৮ গ্রাম
জিংক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম
মিশ্রণ প্রক্রিয়াঃ মিশ্রণ প্রক্রিয়ার ৰেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। প্রথমে স্টক সলিউশন তৈরী করার জন্য ১০ লিটার পানির দুইটি পাত্র নিতে হবে। এরপর ১০ লিটার পানিতে ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ইডিটিএ আয়রন মিশ্রণ করে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে। অপর পাত্রের ১০ লিটার পানিতে অবশিষ্ট রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে পানিতে দ্রবীভূত করতে হবে। এরপর ১০০০ লিটার পানির ট্যাংকিতে মিশ্রণ দুইটি এক এক করে একটি অধাতব দন্ডের সাহায্যে ভালো করে দ্রবিভূত করতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির লৰ্যণীয় বিষয় সমূহ ঃ মূলত হাইড্রোপনিক পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে এর সঠিক ব্যবস'াপনার উপর। দর্শক আসুন জেনে নেই এর ব্যবস'াপনা সম্পর্কে।
১. ইসি এবং পিএইচ এর মাত্রা ঃ সাধারণতঃ পিএইচ এর মাত্রা ৫.৮-৬.৫ এবং ইসি এর মাত্রা ১.৫-২.৫ ডিএস/এম এর মধ্যে রাখতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে মিশ্রণটি উলেস্নখিত মাত্রার বাইরে চলে গেলে গাছের শিকড় মারাত্মকভাবে ৰতি গ্রস' হবে।
২.গাছের খাদ্য উপাদানের প্রয়োজনীয়তা, স্বল্পতা কিংবা আধিক্য গাছের স্বাস'্য ও পাতার রং দেখে বোঝা যায়। সুতরাং গাছের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে খাদ্য উপাদান প্রদান করতে হবে।
৩. দ্রবণের তাপমাত্রার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সাধারণত দ্রবণের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী থেকে ৩০ ডিগ্রী সে.। যদি দ্রবণের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তবে শ্বসনের হারও বেড়ে যায়, ফলে অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত দুপুর বেলায় তাপমাত্রা বেড়ে যায় তাই সে সময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস'া করতে হবে।
৪. জলীয় দ্রবণে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস'া করতে হবে। কেননা এর অভাব হলে গাছের শিকড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৫. পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস'া থাকতে হবে এবং রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া চাষকৃত ফসলে পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে এজন্য নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে খুব কম খরচে বাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজি চাষ করে পারিবারিক প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে কোন রাসায়নিক সার বা কেমিক্যাল ও কীটনাশকের ব্যবহার করা হয় না বিধায় রাসায়নিক ও কেমিক্যালমূক্ত শাক-সবজির উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে এরূপ উৎপাদন ব্যবস'া পরিবেশগত দিক থেকেও ঝুঁকিমূক্ত বা একটি পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন ব্যবস'া।
সাঈদ হাসান/০১৭১৬৬৭৮৪৪৮
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৩