সকালবেলা ফেজবুকে ঢুকতেই একটা সংবাদ লিঙ্কে চোখ আটকে গেল। সাথে সাথে লিঙ্কে প্রবেশ করলাম। ঘটনাটি নেত্রকোণার। সেখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসককে কোনো এক ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ মারধর করেছে। কারণ হিসেবে জানা গেল, রিপ্রেজেন্টেটিভ তার কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য চাপ দিয়েছিল। আর চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে সেই কোম্পানির ওষুধের নাম নেই।
এই যে, চিকিৎসক আর রিপ্রেজেন্টেটিভের মধ্যকার সম্পর্কটা কিন্তু এমন নয়। কয়েক বছর আগে ঢাকার কয়েকটা হাসপাতালে আমাকে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। সেখানে দেখতাম রোগীকে বসিয়ে রেখে ৮-১০ জন করে রিপ্রেজেন্টেটিভকে চিকিৎসক সাহেব চ্যাম্বারে নিয়ে নিচ্ছেন। এখানেই কমপক্ষে ৪০-৪৫ মিনিট রোগীকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে!
এদেশের মার্কেটিং জবের মধ্যে ওষুধ কোম্পানির জবটাকে আমার কাছে বেশি অমানবিক মনে হয়। এখানে এন্টিবায়োটিক বিক্রির ওপরও টার্গেট দেওয়া হয়। আর একারণে একজন মার্কেটিং অফিসার রাত দিন ছুটে চলেন টার্গেট পূরণের লক্ষ্যে। আচ্ছা, মানুষ যদি অসুস্থ না হয় তবে কিভাবে টার্গেট পুরণ করবে? বসে বসে মানুষের অসুখ হওয়ার দোয়া করবে? আমি ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালের ফার্মেসীর সামনে রাত ২টার সময়েও ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভকে বসে থাকতে দেখেছি।
এইতো গত কয়েক মাস আগে চিকিৎসকের চ্যাম্বার থেকে বের হওয়ার পর, চিকিৎসকের কম্পাউন্ডার আমার প্রেসক্রিপশনের ছবি নিলেন। পাশাপাশি বলে দিলেন হাসপাতালের নিচে যেন আমি কাউকে প্রেসক্রিপশন না দেখাই। অথচ এই কম্পাউন্ডারকে দেখলাম সেই ছবিখানা কোনো এক রিপ্রেন্টেটিভকে দিয়ে টাকা কামাচ্ছে!
এদেশের চিকিৎসকও কিন্তু দুধে ধোয়া তুলসি পাতা নন। গতকাল এক চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন চোখে পড়ল। দেখলাম যতগুলা ওষুধ লিখছে ততগুলা ওষুধের প্রয়োজনই নাই। চিকিৎসক যখন নিজের চিকিৎসার ওপর ভরসা পান না তখনই হয়তো বেশি করে ওষুধ দেন। যাকে আমরা বলি ককটেল ওষুধ। কোনো না কোনো একটা ওষুধে কাজ হবেই এমন ধারণা থাকে। এছাড়াও প্রেসক্রিপশনের প্রায় সবগুলা ওষুধই আমার কাছে অপরিচিত। অপরিচিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যারা রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছ থেকে উপঢৌকন নেয় রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের কাছেই গিয়ে ওষুধগুলো প্রোমোট করে। আর যারা উপঢৌকন নেয় না, তাদের কাছে প্রোমোট করতেও হয়তো আসে না। আমি চাইও না কেউ আসুক আমার কাছে। আমি নিজ দায়িত্বে ওষুধের ভালো-মন্দ যাচাই করে নিই।
এভাবে চিকিৎসক ও রিপ্রেজেন্টেটিভের সম্পর্ক যখন ভালো ওষুধের জন্য না হয়ে উপঢৌকনের সাথে হয় তখন যা ঘটে-
১। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখা হয়। যে ওষুধটার হয়তো প্রয়োজনই ছিল না, অথবা না লিখলেও চলত এমন ওষুধ লেখা হয় শুধু উপঢৌকনের জন্য।
২। নামী-বেনামী ওষুধ লেখা হয়। যে ওষুধগুলা চিকিৎসকের আশপাশের দোকান ছাড়া পাওয়া যায় না। আশপাশের ওষুধের দোকানো না পাওয়া গেলে অনেক সময় দোকান ওষুধ পরিবর্তন করে দেন। যেটাও আবার অনুচিত।
৩। চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়। কারণ নিম্নমানের ওষুধে রোগ না ভালো হলে, পুনরায় চিকিৎসক ওষুধ পরিবর্তন করে অন্য ওষুধ দিয়ে দেন।
চিকিৎসক ও রিপ্রেজেন্টেটিভের সম্পর্ক বন্ধে করণীয়-
১। কোনো ওষুধ কোম্পানি রিপ্রেজেন্টেটিভকে ওষুধ বিক্রির জন্য টার্গেট দিতে পারবে না।
২। প্রেসক্রিপশনে ট্রেড নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম লিখতে হবে (ট্রেড নাম- যেমন নাপা, জেনেরিক নাম হচ্ছে - প্যারাসিটামল)। চিকিৎসক যদি প্যারাসিটামল লিখত তবে কাস্টমার যেকোনো কোম্পানির প্যারাসিটামল নিতে পারত। এক্ষেত্রে আবার অবশ্যই প্রতিটা ওষুধের মান ঠিক রাখতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকতে হবে। এইতো ২-৩দিন আগে ওরস্যালাইন চেয়ে অনুরূপ প্যাকেটের ওরস্যাইনড পেয়েছিলাম দোকানির কাছ থেকে।
পরিশেষে, আমাদের দেশের মানুষদের অর্থলিপ্সা ও নীতি-নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অন্যথায়, একটা সমস্যার সাথে আরেকটার লেজ লাগানো থাকায় সহজেই রিপ্রেজেন্টেটিভ-চিকিৎসকের মধ্যকার অমানবিক উপঢৌকন সম্পর্ক বন্ধ হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৮:৪০