হাসান মাহবুব বা আমাদের হামা। তার সাথে মানে তার লেখার সাথে পরিচয় সেই ২০০৮ থেকে। ২০০৮ থেকে ২০১৯ অনেক অনেক দীর্ঘ সময়। এই এতগুলো বছরে হামা ব্লগে বা ফেসবুকে এবং তার আগের প্রকাশিত বইগুলোতে যা যা লিখছে তাদের মাঝে আমার মতে তার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখাটাই আমি কিছুদিন আগে পড়ে শেষ করেছি। এবং বইটা শেষ করবার আগেই প্রথম পাতাটা থেকেই এই লেখার ফ্যান হয়ে পড়েছিলাম। পারলে তখনই এ কথা তাকে জানাই। এক এক পাতা ওলটাই আর আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে যাইহোক এক কথায় অসাধারণ লেগেছে আমার তার লেখা "ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা"।
"ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা" বইটা শুরুর প্রথম থেকেই আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম আমার ছেলেবেলা। হামা কি আমার চোখেই তার ছেলেবেলা দেখেছে! কি আশ্চর্য্য! আমি আমার ধ্যান ধারণা লাইফ স্টাইল কোনো দিক দিয়েই তো হামার সাথে আমার কিছুই মিল খুঁজে পাইনা! সত্যি বলতে হামাকে একটু কাঠখোট্টাই লাগে আমার, দারুন বাস্তববাদী মানুষ মনে হয় আর আমি তো ভাসি রূপকথার জগতে। তবে এই লেখাই কি করে এত মিলগুলো এসে গেলো! পড়তে গিয়ে আমি যেমনই ভেবেছি তেমনি হাসতে হাসতে মরেছি তার কৌতুকচ্ছলে বিশাল সিরিয়াস কথা বলে ফেলা দেখে। কৌতুক হলেও ব্যপারগুলো ছিলো তাৎপর্য্যমন্ডিত এবং ভাবগাম্ভীর্য্যপূর্ণ!
অন্যান্য অনলাইন লেখকদের মত আমি হামাকে আমার অদেখা বা চোখের সামনে কখনও দেখিনি বলবো না কারণ দু, বছর আগে এক রোজার বিকেলে হামাকে আমি হন্তদন্ত হয়ে স্কয়ার হসপিটালের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। তবে হামা আমাকে দেখেনি কারণ তাকে দেখেই আমি জানলা নামিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠতে গিয়েও শেষ মুহুর্তে আত্ম সম্বরণ করেছিলাম। যাইহোক কাজেই হামা বা হাসান মাহবুব নামের এই লেখক আর অন্য দশজন মানুষের মত শুধুই ব্লগ বা ফেসবুকে অদেখা কোনো লেখক নয় আমার কাছে।
সত্যি বলতে বইটার প্রচ্ছদ আর নাম দেখে আমি এটা শিক্ষামূলক ছোটদের বই নাকি ভূতের বই সেটা নিয়ে দ্বন্দে ছিলাম। যদিও প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমার অনেক প্রিয় একজন মানুষ নির্ঝর নৈশব্দ ভাই্য়া তবুও এই ভূত ভূত ছবি আর উদ্ভুতুড়ে নাম দেখে আমি কিছুই মেলাতে পারছিলাম না আমার আশা এবং আকাংঙ্খার সাথে। তারপর আসি উৎসর্গে। আমি আগেই জেনেছিলাম হামার আদর্শ প্রিয় মানুষ আমাদের ব্লগের আরেকজন সুপরিচিত ব্লগার ওরফে হামার কাজিন ভাইয়া রানা। সে কথা হামাই মনে হয় আমাকে অনেকদিন আগে বলেছিলো। এই উৎসর্গে সেই কথাটাই আমার মনে পড়ে গেলো। আমার ধারণা এই প্রিয় কাজিনভাইয়াকে দেখেই হামা গান লিখতে শুরু করেছিলো এবং গাইতেও।
যাইহোক এখন আসি কেনো এই বইটা আমার ভীষন প্রিয় একটা বই হয়ে গেলো-
বইটা খুলতেই প্রথমে সূচিপত্রে দেখলাম ২২ টি গল্পের মত নাম। যাইহোক সূচনাতে গিয়েই চমকে গেলাম! চমকানো শব্দটির কারণ "ঢোলকলমী" ঢোলকলমী পোকা।এই পোকার কথা আমার বেশ মনে আছে যদিও হামার বইটা না পড়লে আমার কখনও মনে পড়তো কিনা জানিনা। কিন্তু এখানে পড়েই আমার মনে পড়ে গেলো। হামা লিখেছে এই পোকার কথা প্রথমে সে পড়েছিলো সংবাদপত্রে। আমিও সেখানেই পড়েছিলাম। হামার মত আমিও খুব ছোটবেলায় পড়ার বই এর আগে গল্পের বই পড়তে শিখে যাই। আর অবশ্যই সেটা ছিলো রূপকথা আর হামা পড়তো সংবাদপত্র। এটুকুই প্রভেদ ছিলো হয়তো আমাদের। হামা লিখেছে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে ভয়ংকর বিপদের বর্ণনা পড়ার মত আনন্দ আর কিছুতে নেই। হা হা হা এমন করে কে আর ভাবতে পারে হামা ছাড়া! তারপর জ্বীন এসে মিষ্টি খাওয়া! আরে আমিও তো এমনই সব শুনেছিলাম আমার ছেলেবেলাতেও! তারপর কুষ্টিয়ার ভাষায় -কিয়ামতের আলামত বুইজলি? এসব তো আমারই দেখা সেই সময়গুলো। সূচনাতেই পেয়ে গেলাম ঢোলকলমী, জ্বীনভূত, ফ্লাইং সসার আর গরু। আসল মজাটা শুরু হলো এরপর থেকে।
১। প্রথম অধ্যায়েই শিরোনাম পড়েই আমি হাসতে হাসতে শেষ। এরপর আমি পুরোটাই মজে গেলাম গল্পে। তখন রাত ১টা বাঁজে। পড়ছি " মোরা একটি গরুর জন্যে কলম ধরি" সত্যি বলতে এমন যুক্তিপূর্ণ মজা আমি আসলেই মনে হয় আর কখনও পড়িনি।এই অধ্যায়টি পড়তে গিয়ে আমি এত জোরে হাসছিলাম যে কেউ শুনলে আমাকেই এই রাত দুপুরে জ্বীন ধরেছেই মনে করে বসতো! আসলেও তো একজন লেখকের বেসিক গড়ে ওঠার পেছনে গরুর দারুন অবদান! গরু এক ট্রানজিসন পয়েন্ট! গরুর রচনার মধ্য দিয়েই সূচনা থেকে উপসংহার পাওয়া যায়। এই মুখস্থবিদ্যা আর এই বিদ্যার তেজ লেখক যেভাবে দেখিয়েছে তাতে আমি মুগ্ধতার সাথে হাসতে হাসতে মরেছি! সারাজীবন তাইলে এই ছিলো......
তারপর আসলো ইংলিশ গরু রচনা লিখতে গিয়ে বিপত্তি এবং এই ইংলিশ নিয়ে বিরাগ ভাজনতার যুক্তি দেশপ্রেমী বাঙ্গালীত্ব! যুক্তিগুলি আমার এতই মনে ধরলো যে আমি বইটা না শেষ করে উঠতেই পারছিলাম না।
২। অধ্যায় ২ এ সাফল্য আর সংঘাতে প্রথমেই চোখ আটকে গেলো রবিঠাকুর আর কাজী নজরুল বিদ্রোহী কবির মাঝে তুলনামূলক যুক্তিতে বিদ্রোহী কবির প্রতি লেখকের আকৃষ্টতা দেখে। তার রবিঠাকুরের প্রতি বিরাগভাজনতার কারনগুলির মজাদার বর্ণনাতেও আমি আপ্লুত হলাম। বিদ্রোহী কবির কোনো বই না পেয়ে লেখক যে ম্যাকগাইভার মামা পড়েছে। লেখকের সেই ম্যাকগাইভারমামাকে তো আমি চিনি। মানে তার মামা কিন্তু আমারট ম্যাকগাইভারভাইয়াকে তো তখন টিভিতে দেখতাম! কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যপারটাই আসলো যখন জানলাম লেখক সুলেমানী খোয়াবনামা প্রিয় বই পড়েছিলো কিছু শিক্ষামূলক ক্রিয়েটিভিটি প্রদর্শনে। আর তার খালাম্মার স্বপ্নকে দুই এ দুই এ চার মিলিয়ে দেবার ঘটনাটা রীতিমত ক্রিয়েটিভ! আরও মজার ব্যপার হলো আমারও এই ক্রিয়েটিভ খোয়াবনামা জীবনের এক আশ্চর্য্য রহস্যময় বই মনে হয়েছিলো! আমিও দারুন অবাক হতাম এই খোয়াবনামা পড়ে! আর স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে এর মানে খুঁজে বেড়াতামও। এখনকার বাচ্চারা তো সেই খোয়াবনামার নামও কোনোদিন শুনেছে কিনা সন্দেহ! এরপর আসলো জীবন অতিষ্ঠ করা স্যার! উফফ আমার জীবনেও এমন শয়তান স্যারগুলি ছোটবেলাতেই এসেছিলো। যাইহোক যদিও তাতিন মানে এই বই এর নায়ক তাতিনের স্যারদের থেকে অবশ্য তাতিন নানা সময়ে নানা বিষয়ে শিখেছিলো যা তার লেখাতেই ফুটে উঠেছে। আমিও শিখেছি কিন্তু শয়তানীর অবদানগুলিও কি ভোলা যায়!
আমাদের ছোটবেলায় কেনো যেন বাবা মায়েদের প্রিয় পেশা ছিলো ডক্টর। ছেলেমেয়ার সবাই বলতো বড় হয়ে ডক্টর হবে। এখানেও তাতিনের মায়ের সেই ইচ্ছটাটাই ছিলো যা তাতিনের মোটেও পছন্দের ছিলো না। যাই হোক ট্যালন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার ব্যপারটাও যতখানি আনন্দের সেই বয়সে খেলা ছেড়ে সেই বৃত্তি পাওয়ার পিছে ছোটার জন্যটাও নিরানন্দের! সব মনে পড়ে যায়.....ঠিক এই বই এর তাতিনের মত বিতর্ক জিনিসটা আমার মোটেও পছন্দের ছিলো না আমার ছেলেবেলায়। সাইদূরস্যারের সাথে এইখানে আমিও একমত। যদিও ভারচুয়াল জীবনে হামাকে আমি যত বিতর্কে অংশ নিতে দেখেছি তাতে এই কথা তার নায়ককে মানায় না। তবে সবচেয়ে মজার সাইদুর স্যারের কবিতা লেখা শেখানোর ব্যপারটা! হা হা হা আহারে এত ভালো স্যারটার চাকরীটা গেলোই আনারস নিয়ে অনর্থ বাঁধিয়ে! তবে হ্যাঁ ছেলেবেলার এই আনারস ভীতি আমার এখনও কাজ করে।
৩। বই এর ৩ৃয় অধ্যায়ে এসে মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় আমার দেখা হারিকেন আর কুপির কথা। পোকানাশক এই আলোগুলি পোকার মতই আমাকে আকৃষ্ট করতো আমার ছেলেবেলায়। আর মাদাম তুসোর মোমের মানুষদের কথা জানবার অনেক আগে থেকেই আমিও গলে পড়া মোম দিয়ে মানুষ বানাতাম! সবচেয়ে হাসি পেয়েছে আলোকিত মানুষ নিয়ে লেখকের বর্ণনা পড়ে। যাইহোক শেষ মেষ লেখক গরুর রচনা স্টাইল কাজে লাগিয়ে আলোকিত মানুষ হবার পুরষ্কার জুটিয়ে নিয়েছিলো এবং আলোকিত মানুষ হয়েই ছেড়েছিলো ঠিকই। তবে তারপর এই অধ্যায়ে তার সবুজ চোখের এলিয়েনের বকাঝাকাগুলো! হা হা হা হা ।
৪। "শুভ প্রকল্পায়ন" এই অধ্যায়টি আমার বিশেষ মজা লেগেছে। কম্পিউটারকে সেই যুগে পর্দানশীন বানিয়ে রাখা এবং সেই কম্পিউটারের জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে অজ্ঞানদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করা আর সাথে সেই ভাবসাব সবই ভীষণ ভীষন মজার!!! তারপর আসলো আতিক ভায়ের আশ্চর্য্য রকেট কম্পপিউটার লার্নিং সেন্টার! রকেটের গতীতে অংবং শিখানো! আমার মনে অংবং কথাটা পড়ে একটা প্রশ্ন এসেছিলো!। অংবং কথাটা লেখক কি আমার থেকেই শিখেছিলো কিনা! একটু ভাবনায় পড়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম এই কথাটা আমার সৃষ্ট না আমিও কোথাও থেকেই শিখেছিলাম। কাজেই .....
যাইহোক এই অধ্যায়ের বিশেষ আকর্ষন হঠাৎ একদিন এই লার্নিং সেন্টারে গরু ঢুকে পড়া! হা হা হা এইখানে লেখক সুক্ষভাবেই গরুগাধাদের সাথে কম্পিউটারের ছাত্রছাত্রীদেরকে যোগ করে দিয়েছেন। সেটা ভেবেই আমি হাসতে হাসতে রাত আড়াইটায় হার্ট এটাক করে ফেলতাম! গরুটাকে দেখা মাত্রই লেখক চিনে ফেললো রচনার সেই গরু! হা হা হা তার জীবনে গরুটার প্রভাব লেখক কোনোভাবেই অস্মীকার করবেন না । এই সমাজে তার অনেক কিছুই দেবার আছে। আতিক ভাই যখন বললো এই সেন্টারে যদি গরুদেরকে কোনোভাবে শেখানো যায় তাহলেও কেল্লা ফতে মানে গরু এসেও এখানে কম্পিউটার শিখতে পারে। তার জন্য কোর্স কারিকুলাম। এইখানে এসে আমার এতই মজা লেগেছিলো সেই কথাটা তক্ষনাৎ জানাতে আমি লেখকের নাম্বার থাকলে সেটা এসএমএস করে জানিয়ে দিতাম বা ফোন করে ঘুম ভাঙ্গিয়েই বসতাম সেই মাঝরাতে ...
৫। এরপর আরও কয়েকটি অধ্যায় আছে। সবকটিই চিন্তার খোরাকের সাথে সাথে অসম্ভব মজার। অধ্যায় নয় থেকে শুরু হলো স্লাইড শো নামে লেখকের নানা বিষয়ে নানা রকম পান্ডিত্যপূর্ণ প্রেজেনটেশন। সেখানে নানা রকম অডিয়েন্সের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্টারনেটের উপকারিতা ও সাথে যে অপকারীতা ও তার থেকে বাঁচবার প্রতিকার দেওয়া হয়েছে তা পরে হাসতে হাসতে মরো আর বাঁচো যাই করো না কেনো তবে সত্যিই উপকারী! অডিয়েন্স অভিভাবক থেকে শুরু করে স্কুলের বাচ্চা, মফস্বলের বোকা সোকা ছেলেমেয়েরা নানা মানুষেরা। তবে নার্গিসের মোটাত্ব নিয়ে হাঁটার উপদেশ হা হা হা । প্রেজেন্টেশনের সময় অডিয়েন্সকে যাই বুঝাক না কেনো লেখক এলিয়েনদেরকে কথা বার্তা প্রশ্নে নট এলাউড করে দিয়েছে। এক্কেবারে মিউট থাকার নিয়ম ।
শেষ মেষ নায়ক তাতিন ফ্রিডম৭১ রকেট রিসার্চ সেন্টার দিয়ে যে কোর্সগুলোর ব্যাবসা শুরু করলো তাতে তার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু নিয়ম ছিলো -
শুধু মানুষ আর গরু সম্প্রদায় আবেদন করতে পারবে।
এলিয়েনরা পারবে না
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বিশেষ ছাড়.........
অবশেষ গরুর রচনার মত উপসংহারের শেষে লেখক লিখেছেন ধন্যবাদ আবার আসবো! হা হা হা এমন একটা লাইন অনেক আগে তার একটা লেখাতেও পড়েছিলাম এবং মাঝে মাঝেই মনে করে আমি হাসি। হা হা যাই হোক আবার আসো হামা। আরও এমন মজার মজার বই নিয়ে। আমার এই বইটা এতই ভালো লেগেছে যে আমি আমার পরিচিত কয়েকজনকে ইতিমধ্যে বইটা পড়তে দিয়েছি।
একটা কথা বলি শেষে এসে... আমি হামার লেখার বিশাল কোনো ভক্ত ছিলাম না, নিশ্চয়ই আমার নিজের অপারগতার কারণেই। এমনকি একবার আমি অনেক অনেক রাগ করেছিলাম মনে মনে তার উপরে। তবে সেই রাগ আমার মাটি হয়ে গেছিলো একেবারেই তার এক চমকে। এই বইটাও তার আরেক চমক আমার কাছে। দারুন মজার আর ভালোলাগার একটা বই। সত্যিই দারুন ভালো লেগেছে আমার।
হামা তোমার প্রতি রইলো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা! তুমি আরও আরও আরও বড় লেখক হও। একদিন অনেকদিন পরে যেন আমি বলতে পারি এই আমাদের হামা। হাসান মাহবুব। এক দারুন গল্পকার..... সে আমার অনেকদিনের চেনা একজন মানুষ....
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১০:১৯